বাঁশের ভেলায় ভাসব বলে

বাঁশের ভেলাতেই যেতে হয় অমিয়াখুম। ছবি: লেখক
বাঁশের ভেলাতেই যেতে হয় অমিয়াখুম। ছবি: লেখক

শীতের বিকেল স্বল্পায়ু—এ কথা জপতে জপতেও সেদিন পথে নামতে দেরি হলো। কারণও অবশ্য ছিল, ২১ সদস্যের বিশাল দলটির অনেকেই অ্যাডভেঞ্চারে অনভ্যস্ত। তার ওপর দীর্ঘ রাতজাগা যাত্রা—ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান। সেখান থেকে ভোরের আলো গায়ে মেখে চাঁদের গাড়িতে থানচি। ট্রলারে যখন রেমাক্রি পৌঁছালাম তখন দুপুর; অনেকের শরীরে ক্লান্তি যেন জেঁকে বসেছে।

তাই রেমাক্রি থেকে জিন্নাপাড়ার উদ্দেশে রওনা দিয়ে অনেকের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিল না! হাঁটাপথে প্রায় দেড় ঘণ্টা সবাই এভাবেই চললাম। এরপরই সেই অবাক করা বিষয়টা, দূর থেকে ভেসে আসা ঝরনার শব্দ যেই না কানে বাজল, একেকজনকে দেখি নড়েচড়ে উঠলেন। তাঁরা যেন এক অদ্ভুত সুখের গর্জন শুনে জেগে উঠলেন। আরও কিছুক্ষণ এগোনোর পরই পেয়ে গেলাম ঝরনা। নাম তার নাফাখুম। ততক্ষণে রাত, আকাশে চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। সঙ্গে তার লাখো তারার মেলা। চাঁদের মৃদু আলোয় ঝরনা যেন সুরেলা হয়ে উঠল, রূপ মেলে ধরল। সেই ভালো লাগার মুহূর্ত ভাষায় বোঝানো সম্ভব নয়।

আমরা অবশ্য বেশি সময় সেখানে থাকতে পারিনি। কারণ, জিন্নাপাড়া পৌঁছার তখনো অনেক পথ বাকি। আবার হাঁটা শুরু। দলের খুদে সদস্য অনন্যা এমনিতেই কাহিল। তার মধ্যে আচমকা তার শরীরেই পড়ল জোঁকের নজর! তার চিৎকারে যেন পাহাড়টাও নড়ে উঠল! এমন করে প্রায় অনেককেই ধরল চিনেজোঁক ও টাইগার জোঁক।

জোঁকের আস্তানা পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে গায়ে হেঁটে রাত নয়টার দিকে পৌঁছালাম জিন্নাপাড়ায়। পাড়ায় পৌঁছেই সবাই শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়।

‘ভয়ানক সুন্দর’ দেখব বলে!

ভোরে ঘুম ভাঙল। দেখি, অন্য সবার সঙ্গে আমাদের গাইড এনভিল ঘুমাচ্ছেন। অথচ সবাইকে জাগিয়ে তোলার গুরুদায়িত্বটা ‘সেনাপতি’ নিজেই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাই যখন জাগলেন, মুখে শুষ্ক হাসি ফুটিয়ে অবিশ্বাসের সুরে বললেন, ‘পাঁচটা বেজে গেছে!’

রওনা হব, এমন সময় কয়েকজন বাগড়া দিয়ে বসলেন। তাঁরা যাবেন না। ভাবখানা এমন যেন, অনেক হয়েছে বাপু, একটু ঘুমিয়ে নিই! সেই না–যাওয়া মানুষের সংখ্যা এক, দুই করে কমে ছয়জনে দাঁড়াল। শেষমেশ ১৫ জনের দল নিয়ে পথ ধরলাম আমিয়াখুম ও ভেলাখুম দর্শনে।

ভয়ংকর সুন্দরে ঝাঁপ...
ভয়ংকর সুন্দরে ঝাঁপ...

পাহাড়ি পথে রচিত হলো হাজারো গল্প। গল্পের প্রতিটি শব্দে মিশে আছে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার ছোঁয়া। এমন গল্প সঙ্গী করেই দেবতা পাহাড়ে পা রাখি। এই পাহাড়ের একদিকে ভেলাখুম, অন্যদিকে আমিয়াখুম। দুর্গম পাহাড় বেয়ে নিচে নামতে হয়। নেমেই চলে গেলাম ভেলাখুমে। বাঁশের তৈরি ভেলায় প্রায় ২৫ মিনিটের পথ। বাঁশের ভেলায় ভাসব বলে কত প্রস্তুতি নিয়ে গেলাম। প্রস্তুতি বলতে সেখানে গিয়ে ভেলা তৈরি করে নিতে হয়। কিন্তু আবিষ্কার করলাম, একটি ভেলা সেখানে পড়ে আছে। হয়তো অন্য কোনো দল বানিয়ে রেখে গেছে। মনে মনে তাদের ধন্যবাদ দিয়ে উঠে পড়লাম ভেলায়। বড় বড় পাথরের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলল ভেলা। চলতে চলতেই গেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত খুম—আমিয়াখুমের কাছে।

আমিয়াখুম সত্যিই ‘ভয়ানক সুন্দর’ ঝরনা। পাহাড়ি ঝরনার সৌন্দর্যে ডুব দিতে একে একে নেমে পড়লেন সবাই।

পরাগ আহমেদ: পর্যটক