পেরুর ডায়েরি

পেরুর মাচুপিচু শহরে লেখক রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। ছবি: সংগৃহীত
পেরুর মাচুপিচু শহরে লেখক রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। ছবি: সংগৃহীত
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু ভ্রমণে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। ঘুরেছেন প্রাচীন নগরী মাচুপিচুতেও। সেই ভ্রমণের দিনলিপি তিনি লিখেছেন নিজের ছোট নোটবুকে। সেটারই কিছু অংশ পড়ুন এখানে।


২৭ আগস্ট ২০১৮

পেরুর রাজধানী লিমায় অবতরণ করল আমাদের বহনকারী উড়োজাহাজ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির নিওয়ার্ক লিবার্টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম বেলা ১১টায়। মধ্যে ঘণ্টাখানেক বিরতির সময়টা কাটিয়েছি আটলান্টা বিমানবন্দরে।

হোটেলের নাম হোসে আন্তোনিও। লিমার দে জুলিও রোডে অবস্থান। রাত ১২টা বাজল হোটেলে প্রবেশ করতে। সকাল আটটায় শুরু হবে আমাদের আনুষ্ঠানিক পেরু ভ্রমণ।

২৮ আগস্ট ২০১৮

সকাল সাড়ে আটটায় বেরিয়ে পড়লাম লিমা শহর ঘুরে দেখতে।

শহরটার পতন হয় ১৫৩৫ সালে। তখন আদিবাসী ইনকাদের দেশে ইউরোপের স্পেন থেকে মানুষ আসতে শুরু করে। স্পেনের রাজা প্রথম চার্লসের জন্য ফ্রান্সেসকো পিজারো (১৪৭১-১৫৪১) এই লিমা শহর দখল করেন এবং উপনিবেশ স্থাপন করেন। সে সময় তাঁকে বাধা দিতে পুরো লিমা শহরের বাইরে প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল। সেই প্রাচীরের কিছু অংশের দেখা মেলে এখনো।

স্প্যানিশদের শাসনামলের আগে পেরুর বাসিন্দারা ‘কিনুয়া’ খেতেন। খেসারির ডালের মতো কালচে ধরনের শস্য এটি। এই শস্য ফলাতে গুয়ানো বা পাখির বিষ্ঠা থেকে সার তৈরি করে ব্যবহার করা হতো।

দক্ষিণ আমেরিকার বলিভিয়া, চিলি, পেরু যুদ্ধে জড়িয়ে পরেছিল বিশেষ এই সারের কারণেই! পৃথিবীতে পাখির বিষ্ঠা নিয়ে একমাত্র যুদ্ধ!

প্রাচীন বিহারে

সেন্ট ফ্রান্সেসকো বিহার এবং চার্চটা ঘুরে দেখলাম। ১৫০০ শতকের স্থাপনা এটি। প্রতিষ্ঠার সেই সময়টাতেই প্রায় ৫০০ সন্ন্যাসী পড়াশোনা করতেন এখানে থেকে। এটাই ছিল দক্ষিণ আমেরিকার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। তখন এখানে পড়ার সুযোগ পাওয়া ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য সম্মানের।

চার্চটাও ঘুরে ঘুরে দেখলাম। স্থাপত্যশৈলীতে স্প্যানিশ সভ্যতার ছাপ। মুর মুসলিমদের ক্যালিগ্রাফির ছাপের দেখাও মিলল সেখানে। ছাদের সিলিংয়ের কাজে তুর্কি বা মুঘল সভ্যতার উঁকিঝুকি।

২৯ আগস্ট ২০১৮

লিমা থেকে কুসকো এলাম।

কুসকো বিমানবন্দর থেকে পথে নেমেই বিরাট এক ভাস্কর্য চোখে পড়ল। এটি ইনকা সম্রাট পাচাকুটির।

আমরা চিনচোরে নামের একটি গ্রামে যাচ্ছি। গ্রামটি ইনকা জাতিসত্তার মানুষদের গ্রাম। বাসে মোট ১৯ জন যাত্রী, আমরা পাঁচজন, চারজন জাপানি, অন্যরা আমেরিকান। আমাদের গাইড ব্যবস্থাপকের নাম হেনরি। স্থানীয় আরেকজন গাইড আছে। তার নাম জন ক্লড। সে পুরো পাঁচটি দিন আমাদের সঙ্গেই থাকবে।

চিনচোরে পৌঁছে প্রথমেই আমরা একটা স্কুলে গেলাম। এই স্কুলটিতে আমাদের ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানটি সহায়তা দেয়। স্কুলের চার কি পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা ইনকাদের বংশধর। নিজস্ব পোশাক পরে গান–বাজনা আর বাঁশি বাজিয়ে আমাদের বরণ করল। জানলাম, গ্রামের মেয়েরা পরিবারের পোশাক নিজেরাই তৈরি করে।

খাওয়াদাওয়ার পর্বটাও সে গ্রামেই সারলাম। ওদের নিজেদের ঐতিহ্যবাহী খাবার। ইনকাদের প্রধান খাবার আলু। খেয়েদেয়ে চিনচোরে গ্রাম ঘুরতে বেরোলাম।

টিটিকাকা হ্রদের পাশে
টিটিকাকা হ্রদের পাশে

অনেক মানুষের বাস এ গ্রামে। পাহাড়ের গায়ে এই প্রাচীন বসতি ইনকাদের সময় থেকেই ছিল। স্প্যানিশরা এটা ধ্বংস করেনি। তবে কূটচাল চেলেছিল। ইনকাদের মধ্যে থেকে অল্প বয়সী একজনকে রাজা বানিয়ে লাখ লাখ ইনকাবাসীকে শাসন করাত। সে রাজাও ছিলেন বন্দিদশায়; স্প্যানিশ শাসকদের একজন ক্রীড়নক হিসেবে।

কুসকো থেকে পুনোর পবিত্র শহরে রাতটা থাকব। এখানেই আছে বিখ্যাত হ্রদ টিটিকাকা। পরশু বা কাল কুসকোতে ফিরে আসব।

৩০ আগস্ট ২০১৮

সারা দিন উরুবাম্বা শহরে ছিলাম। রিসোর্টের নাম সোনেস্তা। পাহাড়ের ঢালে অপূর্ব সুন্দর একটা রিসোর্ট। বাড়িগুলো মাটির তৈরি। কিন্তু ভেতরে সব আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। ঘুম ভাঙে অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির ডাকে।

উরুবাম্বাতেই অনেক সেকরেড ভ্যালি বা পবিত্র উপত্যকা। দুপুরে আমাদের উরুবাম্বার একটি পবিত্র উপত্যকায় নিয়ে গেল। শহরটার নাম ওলান টাইটাম্বো। প্রাচীন ইনকা শহর।

ইনকাদের সম্রাট পাচাকুটি এটি তৈরি করেছিলেন ১৪৫০-১৪৬৫–এর মধ্যে। এটাকে পবিত্র উপত্যকা বলার কারণ, ইনকারা বিশ্বাস করত তাদের উৎপাদিত শস্য রক্ষা করার জন্য দেবতা পাহারা দিচ্ছেন। পাহাড়ঘেরা এলাকাটিতে চাষের জন্য ছিল সামান্য জমি। উৎপাদিত ফসল ইনকারা সারা বছরের জন্য জমিয়ে রাখত পাহাড়ের উঁচু ঢালে, বিশেষভাবে তৈরি ফসল রাখার গুদাম বানিয়ে। সেই বিশেষায়িত গুদামে হাওয়া-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা ছিল। পোকামাকড় যেন ফসলের ক্ষতি না করে সে জন্য গুদামের নিচ দিয়ে এক ধরনের তেল জ্বালিয়ে পোকা মারার ব্যবস্থা ছিল। কৃষিকাজে এরা কতটা উন্নত ছিল, ভাবা যায়?

পাহাড়ের মাথায় মাথায় আবার হিসাব করে সূর্যঘড়ি তৈরি করা হয়েছে। চাষাবাদের সুবিধার জন্য এসব সূর্যঘড়ি ব্যবহার করা হতো।

ইনকাদের ঘোড়া ছিল না, গরু ছিল না, চাকাও ছিল না। তারপরও কীভাবে উঁচু পাহাড়ে এত বড় বড় পাথর তুলে এগুলো নির্মাণ করেছে, ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।

সূর্য মন্দির

পেরুর একেক অঞ্চলের মানুষ একেকজন দেবতাকে মানে। পাচামামা উত্তরাঞ্চলের ইনকাদের দেবতা। শোনা যায়, এই দেবতার কথা বলে সম্রাট পাচাকুটি চাষিদের দিয়ে দুই মাস কাজ করিয়ে নিয়েছিলেন। চাষিরা জানত, দেবতা পাচামামাই তাদের দেখাশোনা করছে, পারিশ্রমিকও দিচ্ছে। মোটকথা, তারা পাশের পাহাড় থেকে পাথর কেটে এনে অত ওপরে তুলছিল দেবতার কাজ করছে ভেবেই।

সূর্য মন্দিরটা প্রায় ২০ স্তর ওপরে। একেকটা স্তর চার ফুট করে উঁচু। পাথরের উঁচু আঁকাবাঁকা সিঁড়ি ভেঙে ঘুরে ঘুরে উঠতে হয়। আমি পাঁচ স্তর পর্যন্ত উঠে আর পারিনি। ওখানেই বসে পড়লাম।

১ সেপ্টেম্বর ২০১৮

গতকাল রাত ১০টায় কুসকো পৌঁছালাম।

সকালে উরুবাম্বা প্রদেশের ওলান টাইটাম্বো শহর থেকে গ্লাস-ডোম ট্রেনে মাচুপিচু গিয়েছি। মাচুপিচু স্টেশনে নেমে বাসে করে ৩০ মিনিটের পথ। দর্শনীয় স্থানটি আমাজন এলাকার মধ্যে পড়ে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে গহিন অরণ্য। ঘন সবুজ জঙ্গল, অর্কিড আর নানা ধরনের বুনোফুল, পাখি। ১৪৫০ সালের দিকে স্থাপিত ইনকাদের একটা বসতি বা শহর বলা যেতে পারে এটাকে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে ট্রেস প্লানটেশন করার ব্যবস্থা। থাকার বাড়িঘর, সূর্য মন্দির। রাজার বক্তৃতা শোনার জন্য খোলা জায়গা। কিন্তু বহু বছর ধরে এই এলাকা ছিল মানুষের অজানা। ১৯১১ সালে একজন আমেরিকান এর অস্তিত্ব খঁুজে পান।

পেরুর কুসকো শহরে
পেরুর কুসকো শহরে

মাচুপিচু থেকে ফিরে ট্রেনে করে ফিরছি এখন ওলান টাইটাম্বো। ওখান থেকে বাসে করে রাতে কুসকো।

আজ সারা দিন একটু আরাম করলাম। কুসকো বড় এবং বাণিজ্যিক শহর। স্প্যানিশরা যখন দক্ষিণাঞ্চল আক্রমণ করে তখন এখানে তারা এতই প্রভাব বিস্তার করেছিল যে—চার্চ, বাড়িঘরের নকশা, চত্বরসহ শহরের পথঘাট তাদের নিজস্ব নির্মাণশৈলীতে তৈরি হয়েছিল।

 ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৮

আজ আমরা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাচ্ছি। একদম ভিন্ন জগৎ দেখলাম। পেরুতে পা ফেলার আগে ধারণাই ছিল না এমন অসাধারণ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরব। স্থানীয় মানুষগুলো এত সৎ, অতিথিপরায়ণ, তাদের চোখেমুখে সুখ খেলা করে। সারা জীবন মনে থাকবে এই ভ্রমণের কথা।

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা: রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী