আজ কী যেন আছে

জন্মদিন কিংবা বিবাহবার্ষিকীর কথা ভুলে গেলে ফুলের মতো উপহার দিয়ে সঙ্গীকে বোঝাতে পারেন। মডেল: বাপ্পা ও শ্যামা, ছবি: অধুনা
জন্মদিন কিংবা বিবাহবার্ষিকীর কথা ভুলে গেলে ফুলের মতো উপহার দিয়ে সঙ্গীকে বোঝাতে পারেন। মডেল: বাপ্পা ও শ্যামা, ছবি: অধুনা

প্রিয় নীতা
চক্ষুলজ্জায় যে গল্প তোমাকে বলা হয়নি, লোকলজ্জা ভুলে আজ তা বলতে বসেছি। এই বঙ্গদেশে কেবল মৃত্যুবার্ষিকীর সংস্কৃতির মধ্যে কতগুলো প্রজন্ম যে বড় হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। গ্রামগঞ্জ থেকে আমরা যখন শহরে এসে নাগরিক হওয়ার বাসনায় দিশেহারা, সেই জীবনে এসে প্রথম হানা দেয় জন্মদিন। অনভ্যস্তজনের জন্য এ যেন আড়ষ্টতা উদ্‌যাপন। তারপর বিয়ে-থা হলে আসল বিপদের উদয় হয়। বিবাহবার্ষিকী।

বিষয়টি দুজনের হলেও স্ত্রীরা এখানে পেশাদার কূটনীতিক। দিবসটি মনে থাকলেও তাঁদের একটা অংশ তা গোপন করে বসে থাকেন। যেন নাগরিক হয়েছ, সুনাগরিক যে হওনি মোক্ষম সময়ে তা হাতেনাতে ধরিয়ে দেব। ভুলোমনা চোর ধরাতেই এখানে যত আনন্দ। শাস্তি মামুলি; মান-অভিমানের খুনসুটি। এভাবেই চলছে সোনার বাংলা। আমি সৌভাগ্যবান। তুমি এসব থেকে অনেকটাই আলাদা। অনুযোগহীন, কিন্তু অনুভূতিপ্রবণ। আমি তো ভুলোমনা, মুখচোরা; কেমন-কেমন যেন! একটা বিবাহবার্ষিকী বা জন্মদিন ফসকে গেলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, পরেরটায় চমকে দেব। কিন্তু হায়! পরের বছরও...।

একটা বছরের ঘটনা তোমাকে বলি। সংবাদপত্রে সন্ধ্যার কাজের চাপ অন্তঃসত্ত্বা মায়ের শেষ মুহূর্তের যন্ত্রণার মতো। এই চাপ মাঝরাত অবধি চলে। সেদিনের সন্ধ্যাও ছিল তেমনই। এর মধ্যে হঠাৎ মনে হলো, আজ কিছু একটা আছে। মনে মনে পরের দিনের পত্রিকার চেহারা কল্পনা করছি, হাতে কাজ চলছে; আর মাথায় সেই ‘কিছু একটা আছে’ ঘুরপাক খাচ্ছে। রাত ৮টার দিকে পত্রিকার চূড়ান্ত ডামি গ্রাফিকস রুমে বুঝিয়ে দিয়ে আসার সময় মন বলল, আজ তোমার জন্মদিন। কিন্তু নিউজ রুমে গড়াগড়ি খেতে খেতে যা শিখেছি তা হলো, ‘নিশ্চিত হও’। ক্রস চেকের সুযোগ কই! নাবিহা (৪) ও যায়ান (১) অনেক ছোট। সম্পাদকের শিক্ষা মাথায় চেপে বসল-সন্দেহ করো, অবিশ্বাস করো, প্রশ্ন করো। তাহলে কি জন্মদিন নয়? একবার মনে হলো তোমাকে ফোন দিই। যদিও জানি, তুমি কিছু বলবে না, এড়িয়ে যাবে; ‘...আরে কাজ করো’। কখন যে সব ভাবনা ভেসে গেল কাজের স্রোতে।

রাত সাড়ে ৯টা থেকে ১০টায় নিউজ রুমে থাকে আসল চাপ। পত্রিকা প্রেসে পাঠানোর পূর্বক্ষণ। এই সময়টায় আমার মাথা সবচেয়ে দ্রুত কাজ করে। ভাবনা নিখুঁত হতে থাকে। মনকে বললাম, কেক একটা কিনে ফেলতে হবে। কিন্তু এটা বেশিক্ষণ মাথায় থাকবে না। দ্রুত একজনকে ডাকলাম-‘একটা কেক কিনতে হবে, মনে করিয়ে দিয়েন।’ তিনি বললেন, দোকান তো ১১টায় বন্ধ হয়ে যাবে। ‘আচ্ছা, আচ্ছা; ঠিক আছে। মনে রাইখেন।’ তাঁর হাতে টাকাটা দিয়ে দেওয়া হলো না।

রাত সোয়া ১টায় পত্রিকার নগর সংস্করণের কাজ শেষ হলো। শেষ জানুয়ারির শীতের রাত। বাসার কাছাকাছি পৌঁছানোর পর হঠাৎ মনে হলো, হায়-হায়! কেক তো কেনা হলো না। মনটা চেপে গেল। সঙ্গে থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুললাম। তোমার কক্ষ স্বাভাবিকভাবেই আলোহীন। ক্লান্ত থাকবে স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরতে আজকাল সন্ধ্যা হয়ে যায়। তারপর রান্নাবান্না, বাচ্চা সামলানো; কত কী? সন্তর্পণে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। কিন্তু মাথা তো বসে নেই-‘আজ কী যেন আছে’।

আজ কি আমাদের বিবাহবার্ষিকী। নিশ্চিত হব কী করে? শিল্পী সমীরণ দত্তের কথা মনে পড়ল। আমাদের বিয়েতে তিনি একটা উপহার দিয়েছিলেন। তাতে বিয়ের তারিখটি লেখা। কিন্তু সেই কাঠের টুকরাটি কই? রাত ২টা পার হচ্ছে। খাবার ছেড়ে দ্রুত কাজে নেমে পড়লাম। গামছায় নাকমুখ বেঁধে ফেললাম। তিন বছর ধরে যে বেডরুমটিকে আমার জিনিসপত্র জমাতে জমাতে স্টোররুম বানিয়ে ফেলেছিলাম, সেদিকে ছুটলাম। কিন্তু দরজায় তালা। সেখানে আমাদের বিয়ের অনেক উপহার এখনো অব্যবহৃত পড়ে আছে। সারা ঘর খুঁজে চাবির সন্ধান পেলাম। রুমে ঢুকতের মাকড়সার জালে আটকে গেলাম। বাতিও নেই। মোবাইলের আলো জ্বেলে অনুসন্ধান শুরু হলো। সবকিছু ধুলায় তলিয়ে আছে। একের পর এক জিনিস সরাতে সরাতে একসময় সমীরণ দার শিল্পকর্ম হাতে লাগল। কাঠের টুকরোটি বালুতে সাদা, লেখা বোঝা যায় না। বাথরুমে নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভেসে উঠল- ‘27th january, 2006, This is our Day. ’

হাতমুখ ধুয়ে ড্রয়িংরুমে গেলাম। মোবাইলে লিখলাম, হ্যাপি অ্যানিভারসারি। পাঠালাম তোমাকে। তারপর ১৫ মিনিট অপেক্ষা করলাম। প্রতি-উত্তর নেই। মোবাইল তোমার বালিশের পাশেই থাকে।

রাত আড়াইটা পেরিয়েছে। শীত গায়ে লেপ্টে গেছে। আমি আমাদের শোয়ার ঘরে ঢুকলাম। আবছা আলোয় দেখলাম, বাচ্চারা আদুরে মুখ করে ঘুমাচ্ছে। আমি চিকন হয়ে তোমার পাশে শুয়ে পড়লাম। ওমে ভরা পিঠটা আলগোছে সরিয়ে তুমি আমার ঠান্ডা শরীরটাকে জায়গা করে দিলে। বুঝলাম, জেগে ছিলে। আর বুঝলাম, পিঠ সরিয়ে যেটুকু জায়গা করে দিলে সেটুকু আমার ক্ষমার পৃথিবী।

প্রিয় ভুতু

আমি মুকেশ আম্বানি নই। এই ধরায় আমি মুখোশহীন এক আগন্তুক। উচ্ছ্বাসগুলো আমাদের জীবনের বিজ্ঞাপন, গোপনীয়তা আমাদের সৌন্দর্য। তাই এই গল্পটি যেন আর কেউ না জানে।

তোমাকে অনেক ভালোবাসি।

 শাহেদ। 