শিশুর বিকাশ কীভাবে হবে

শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। ছবি; অধুনা
শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য অভিভাবককে সচেতন হতে হবে। ছবি; অধুনা

শিশুর বিকাশের প্রশ্নে বাবা-মায়েরা সাধারণত বেশি নজর দেন শিশু কোন বয়সে হামাগুড়ি দিতে পারল, কখন হাটতে পারল, কখন কথা বলা শিখতে পারল—এসবের ওপর। এগুলো শিশুর শারীরিক বিকাশ। কিন্তু শিশুর বিকাশের আরও কিছু ধারা রয়েছে। মায়ের গর্ভে থাকার সময় থেকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুর যে বিকাশ ঘটে, তা হচ্ছে প্রারম্ভিক বিকাশ। শৈশব থেকে কৈশোর, বয়ঃসন্ধিকাল পার করে সে হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ মানুষ। প্রতিটি পর্যায়ে শরীরের পাশাপাশি তার মনেরও পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ব্যবহার ও ভাষা, চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি, জ্ঞান, বুদ্ধি, আবেগ, নৈতিকতা ও ভাবের আদান–প্রদানের ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে দক্ষ হয়ে ওঠাই শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশ।

 শিশুর বিকাশ পাঁচ রকমের

১. শরীরের বড় পেশির নড়াচড়ার সক্ষমতা (গ্রস মোটর ডেভেলপমেন্ট)—যেমন ঘাড় শক্ত হওয়া, দাঁড়ানো, কোনো কিছু ধরতে পারা হাঁটা, চলা, দৌড় ইত্যাদি।

২. শরীরের ছোট ছোট পেশির সক্ষমতা (ফাইন মোটর ডেভেলপমেন্ট)—জামার বোতাম লাগানো, জুতার ফিতা বাঁধা, চামচ ধরতে পারা, বইয়ের পৃষ্ঠা ওলটানো ইত্যাদি।

৩. ভাষা ও যোগাযোগের বিকাশ (স্পিচ ও ল্যাঙ্গুয়েজ ডেভেলপমেন্ট)—ভাষা শেখা, কথা বলতে পারা, মনের ভাব বোঝাতে পারা।

৪. ধারণার জগতের বিকাশ (কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট)—আশপাশকে চিনতে শেখা, বুঝতে শেখা, ছোট ছোট সমস্যার সমাধান করতে পারা, নৈতিকতাবোধ তৈরি হওয়া ইত্যাদি। মনোবিজ্ঞানী জ্যাঁ পিয়াজে গত শতকের তিরিশের দশকে এ ‘ধারণার জগৎ তৈরির তত্ত্বে’ চারটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ উল্লেখ করেছেন। যে ধাপগুলোতে জন্মের পর থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে একটি শিশু আশপাশকে নানাভাবে চিনতে শেখে। বিমূর্ত চিন্তা করার সক্ষমতা তৈরি হয়। এ সময় শিশুর নৈতিকতার বিকাশও ঘটে। নৈতিকতার বিকাশের পর্যায় ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মার্কিন গবেষক লরেন্স কোহলবার্গ তিনটি স্তরের বর্ণনা দেন। জন্ম থেকে প্রথম কয়েক বছর শাস্তি এড়াতে শিশুরা নিয়মকানুন মেনে চলে, এরপর বয়ঃসন্ধিতে সে নিজের কাজের স্বীকৃতির জন্য সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে একাত্ম হয়; ‘ভালো ছেলে’ বা ‘ভালো মেয়ে’ অভিধায় তারা ভূষিত হতে চায়। আর নৈতিকতার বিকাশের তৃতীয় স্তর যা শুরু হয় ১৬-১৭ বছর বয়সের দিকে। তখন সে নৈতিকতাকে নিজস্ব ধারণার জগতের সঙ্গে মিলিয়ে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা দিতে থাকে।

৫. আবেগীয় আর সামাজিক বিকাশ (সোশ্যাল অ্যান্ড ইমোশনাল ডেভেলপমেন্ট)—সামাজিক মিথস্ক্রিয়া করতে পারা, নিজের আবেগকে প্রকাশ করা, অপরের আবেগকে বুঝতে পারা ইত্যাদি।

শিশুর শারীরিক বিকাশের (বড় ও ছোট পেশিসমূহের সক্ষমতা) পাশাপাশি তার মনোসামাজিক বিকাশও (ধারণার জগৎ, যোগাযোগ সক্ষমতা, নৈতিকতা) গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর শারীরিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন গর্ভকালীন মায়ের যত্ন, মায়ের পুষ্টি ও শিশুর পুষ্টি নিশ্চিত করা, মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, নির্দিষ্ট বয়সে মায়ের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য পুষ্টিকর সুষম খাবার দেওয়া, ব্যায়াম, শারীরিক খেলাধুলা নিশ্চিত করা ইত্যাদি। অপর দিকে মনোসামাজিক বিকাশ নির্ভর করে শিশুর সঙ্গে বাবা-মাসহ চারপাশের মানুষের আচরণ আর শিশুর পারিপার্শ্বিকতা-পরিবেশ ইত্যাদির ওপর। শিশুর মনোসামাজিক বিকাশ ইতিবাচক আর অর্থবহ করে তুলতে শিশুকে ছোটবেলা থেকে সামাজিক দক্ষতা (ছোট ছোট সমস্যার সমাধান, স্বাবলম্বী হওয়া, সিদ্ধান্ত নেওয়া) শেখাতে হবে,। অভিভাবকেরা নৈতিকতার চর্চা করবেন। শিশুর সামনে অনৈতিক আচরণ করবেন না। শিশুকে কোনো স্তোকবাক্য দিয়ে ভুল কিছু শেখাবেন না। ভালো কাজের জন্য শিশুকে প্রশংসা, আদর ও পুরস্কার দিন এবং মন্দ বা অনাকাঙ্ক্ষিত কাজের জন্য আদর, প্রশংসা ও পুরস্কার বন্ধ রাখুন। শিশুকে বকা দেওয়া, মারধর করা এবং তার সমালোচনা বন্ধ রাখুন।

 শিশুর বিকাশে কি সমস্যা হচ্ছে?

ঠিক বয়সে ঘাড় সোজা রাখতে না পারা, বসতে না পারা, হাঁটতে না পারা, কথা বলতে না পারা বা কথা অস্পষ্টভাবে বলা, অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটা, বড় বয়সেও বিছানায় প্রস্রাব-পায়খানা করা, মুখ দিয়ে সব সময় লালা পড়া, বয়স অনুযায়ী নিজের যত্ন নিজে নিতে না পারা, অস্বাভাবিক আচরণ করা, মনোযোগের অভাব, আগ্রাসী-হঠকারী আচরণ করা, হঠাৎ উত্তেজিত হওয়া, অতিরিক্ত চুপচাপ বা অতিরিক্ত চঞ্চল হওয়া, সমবয়সী কারও সঙ্গে মেলামেশা না করা, আদর গ্রহণ না করা, চোখে চোখ না রাখা, খিঁচুনি হওয়া, টাকাপয়সার হিসাব রাখতে অপারগতা, নিজের শরীরে নিজে ক্ষতি করা (হাত কাটা, চুল ছেঁড়া, হাত কামড়ানো, দেয়ালে মাথা ঠোকা, আত্মহত্যার চেষ্টা), স্কুলে যেতে না চাওয়া, খুব বেশি মন খারাপ করে থাকা, যেকোনো ধরনের অস্বাভাবিক আচরণ করা ইত্যাদি লক্ষণ দেখলে বুঝতে হবে শিশুর বিকাশের সমস্যা হচ্ছে। শিশুর বিকাশের সমস্যার কোনো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। কারণ, যত দ্রুত শিশুকে পরিচর্যায় আনা যায় ততই মঙ্গল। 

আহমেদ হেলাল, সহযোগী অধ্যাপক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।