সবাই মিলেই কাজ করি

পরিবারের আনন্দ আয়োজনে সন্তানদেরকেও যুক্ত করুন। মডেল: সাইদা আহমেদ, আদিব, তারেক হাসান ও দৃণা। ছবি: সুমন ইউসুফ
পরিবারের আনন্দ আয়োজনে সন্তানদেরকেও যুক্ত করুন। মডেল: সাইদা আহমেদ, আদিব, তারেক হাসান ও দৃণা। ছবি: সুমন ইউসুফ

১১ বছর বয়সের মেয়ে সুহাইরা। ছোটবেলা থেকে মা যদি সুহাইরাকে একটি ছোট্ট কাজও করতে বলতেন, তখনই ওর বাবা হা হা করে উঠতেন, ‘এত ছোট মেয়ে, ও আবার কী কাজ করবে।’ এভাবে কোনো কাজ না করার কারণে সুহাইরা এখন কোনো কাজই করতে চায় না বা করতে পারে না। যেকোনো দায়িত্বকেই ভয় পায়। এমনকি তার নিজের দৈনন্দিন কাজগুলো, যেমন: স্কুলের বই গোছানো থেকে শুরু করে নিজের জামাকাপড় খুঁজে পাওয়া—সবকিছুতেই সে বাবা-মায়ের ওপর নির্ভরশীল। ছোট ছোট বিষয়ে সে কার্যকরী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

বাবা-মায়েরা সন্তানকে ভালোবাসেন। ভালোবেসে তাদের সব সময় আরামে রাখতে চান। কিন্তু এই আরামে রাখার প্রক্রিয়ায় সন্তানদের সামাজিক দক্ষতা গড়ে ওঠে না, অংশগ্রহণমূলক মনোভাব তৈরি হয় না, আর ছোট-বড় কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এ জন্য ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের তাদের বয়স উপযোগী দায়িত্ব ভাগ করে দিতে হবে। হয়তো সব কাজ সে নিখুঁত করে করতে পারবে না, কখনো ভুল হবে কিন্তু তার নিজের সক্ষমতা বাড়তেই থাকবে। একটি শিশু কৈশোর, তারুণ্য পার হয়ে পরিবার আর সমাজে যখন দায়িত্ববান সদস্য হিসেবে নিজের ভূমিকা রাখতে যায়, তখন কিন্তু তার শৈশবের শিক্ষাগুলো সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে। বাবা-মায়েদের মনে একটা ধারণা থাকে, ‘ও কি এই বয়সে কিছু করতে পারবে’ বা ‘ও এটা খুব ভালো করে করতে পারবে না’ কিংবা ‘এটা করতে গেলে ওর অনেক কষ্ট হবে।’ এই ধারণাগুলো শিশুর জ্ঞানীয় (কগনিটিভ) বিকাশ আর সামাজিক-আবেগীয় (সোশিয়ো-ইমোশনাল) বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে, দায়িত্ব নিতে শেখায় না। আবার শৈশবে বা কৈশোরে শিশুকে কোনো দায়িত্ব এমনভাবে দেওয়া যাবে না, তার প্রতি কোনো টার্গেট ঠিক করে দেওয়া যাবে না, যাতে তারা সেগুলোকে বোঝা মনে করে। এ জন্য সামাজিক অনুষ্ঠানের মোড়কে, দৈনন্দিন যাপিত জীবনের সাধারণ কাজের মধ্য দিয়ে শিশুদের দায়িত্ব দিতে হবে। তারা যেন বিষয়টিকে-দায়িত্বটিকে আনন্দ হিসেবে গ্রহণ করে, বাড়তি কাজ হিসেবে নয়। সবাই মিলে কাজ করার অভ্যাস যদি পরিবারে থাকে, তবে পারিবারিক বন্ধনগুলো দৃঢ় হয়, অপরের মতামতকে মূল্য দিতে শেখে আর সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারে।

 বাবা-মায়েদের করণীয়

* শিশু-কিশোরেরা কোনো কাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে করতে গেলে শুরুতেই তাদের নিরুৎসাহিত করবেন না। যদি মনে করেন কাজটিতে যুক্ত হওয়া তার জন্য সঠিক হচ্ছে না, তখন তাকে বুঝিয়ে বলুন।

* কাজের ফলাফল যা-ই হোক, তাদের প্রতি বক্রোক্তি, সমালোচনা কিংবা আরেকজনের সঙ্গে তুলনা করবেন না।

* পারিবারিক আর সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেরাও অংশ নিন আর শিশুদেরও অংশ নিতে উৎসাহিত করুন। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় দিবসগুলোতে শিশুদের নিয়ে অংশ নিন। পারিবারিক পিকনিক, একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, বিয়ে, জন্মদিনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিশুদের নিয়ে যান।

* পারিবারিক আর সামাজিক অনুষ্ঠানে শিশুদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়াটাই সব নয়—এসব অনুষ্ঠানে শিশুদের তাদের বয়স উপযোগী দায়িত্ব দিন। হতে পারে ট্রেন, বাস বা প্লেনের টিকিটগুলোর একটি কপি তাদের কাছে রাখতে দেওয়া এবং যথাযথ সময়ে তাদের দিয়েই সেগুলো ব্যবহার করানো। ছোটখাটো কেনাকাটায় তাদের হাতে অল্প টাকা দিয়ে কেনাকাটার অভ্যাস করা, এতে তাদের মানি ম্যানেজমেন্ট দক্ষতা বাড়বে।

* পিকনিকের আয়োজন থেকে শুরু করে খাবার তৈরি বা পরিবেশনায় তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করুন। হয়তোবা সবকিছু সুচারুভাবে তারা করতে পারবে না, কিন্তু আপনি মন খুলে তাদের প্রশংসা করুন, উৎসাহ দিন।

* যেকোনো পারিবারিক আয়োজনের বিষয়ে তাদের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবেন না। তাদের কাছ থেকে মতামত নিন। আপনার এবং তাদের মতের সুবিধা-অসুবিধাগুলো তাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিন।

* শিশু-কিশোরেরা যদি পড়ালেখার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক কোনো কাজ, হাতের কাজ শিখতে চায়, তবে তাকে উৎসাহ দিন। অনেক সময় দেখা যায়, মূলধারার পড়ালেখার চেয়েও শিশুদের জীবনে এই বৃত্তিমূলক শিক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

* কোনো শিশু-কিশোর যদি এ ধরনের ছোটখাটো কাজ করতে খুবই অনাগ্রহ প্রকাশ করে, তবে কেন সে অনাগ্রহী হচ্ছে, তা খুঁজে দেখার চেষ্টা করুন। তার মধ্যে সোশ্যাল অ্যাংজাইটি, স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা, মানসিক সমস্যা, থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি বা ব্যক্তিত্বের সমস্যা হচ্ছে কি না, তা নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।

* বাবা-মায়েদের মনে রাখতে হবে যে সন্তানের আরামের কথা চিন্তা করে তাকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া থেকে বিরত থাকলে পরবর্তী সময়ে তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে, দায়িত্বশীল নাগরিক হবে না এবং পদে পদে হোঁচট খাবে। এ কারণে শিশু-কিশোরদের ছোটবেলা থেকেই বয়স অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ দিলে বাবা-মায়েরা সেগুলো তদারকি করবেন আর কখনোই বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব তাদের দেওয়া যাবে না।

আহমেদ হেলাল                                     
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।