প্রেম তো মরে না

হঠাৎ দেখা হয়ে গেল পথে। তারপর...। মডেল: উল্কা হোসেন ও হাসান তারেক, ছবি: সুমন ইউসুফ
হঠাৎ দেখা হয়ে গেল পথে। তারপর...। মডেল: উল্কা হোসেন ও হাসান তারেক, ছবি: সুমন ইউসুফ

ধরুন, হঠাৎ দেখা হয়ে গেল রেলগাড়ির কামরায় বা বাসস্ট্যান্ডে। এমনকি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের সামনেও হতে পারে। অন্তত দশ বছর পর। চেহারায়, আদলে পরিবর্তন ঘটেছে অনেক। প্রাণবন্ত, চঞ্চল ছিপছিপে তরুণীটি এখন কিছুটা পৃথুলা, পূর্ণবয়স্ক নারী। সংসার-সন্তান সামলে পরিণত জীবনের অভিজ্ঞতার রেখাগুলোকে আড়াল করতে পারেনি প্রসাধনের প্রলেপ। কিন্তু এই নারীকে না চেনা তো অসম্ভব! চমকে উঠেছেন আপনি। ভেবেছেন দ্রুত নিজেকে আড়াল করবেন কিনা। কিন্তু ততক্ষণে চোখাচোখি হয়ে গেছে। আর আপনাকে অবাক করে দিয়ে হাত তুলে ডাকল। খুব সহজ-স্বাভাবিক গলায় জানতে চাইল, ‘কেমন আছ?’

‘ভালো। তুমি?’

এরপর পরস্পরের সংসার-সন্তানের কুশলাদি বিনিময় হলো।

আপনার মনে তখন স্মৃতির তোলপাড়। তাঁর মনের অবস্থা অবশ্য বোঝার উপায় নেই। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের কবিতার নারী হয়েই যেন সে জানতে চাইল, ‘আমাদের গেছে যেদিন, একেবারেই কি গেছে?’

কী উত্তর দেবেন আপনি, সেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা ধার করেই বললেন, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে।’

দশ বছর পর দশ মিনিটের এই আলাপের পর আবার দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেল বেঁকে। শুধু একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল বুক ফুঁড়ে। কত কথা ভিড় করে আসে মনে। চলচ্চিত্রের ফ্ল্যাশব্যাকের মতো অনর্গল ছবির পর ছবি ভেসে ওঠে। টিকিট হাতে সিনেমা হলের সামনে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকার দিন, লাইব্রেরির বারান্দায় বসে দুজনের ঘনিষ্ঠ মুহূর্তগুলো কিংবা নদীর কিনারে বসে দিগন্তলাল সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে রঙিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন বোনা...।

এর আগেও যে কখনো-সখনো ওর কথা মনে পড়েনি এমন তো নয়। কিন্তু আজ সে রাতের মতো স্মৃতিরা যেমন করে ছুটে আসছে, আগে তো এ রকম হয়নি।

এ রকম আপনার আমার সবার হয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, এর নাম ‘রিট্রাইভাল কিউ।’ একটি সূত্র আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্মৃতির কাছে। যেমন একটি চাবি হয়তো খুঁজে পাচ্ছিলেন না দীর্ঘদিন। হঠাৎ করে একটা বাক্স দেখে স্মৃতিটা উসকে উঠল, আরে এই বাক্সের মধ্যেই তো ছিল চাবিটা। অর্থাৎ বাক্সটা ছিল সূত্র।

কেন ভেঙে যায় প্রেম? কেন দূরে সরে যাওয়া? সাধারণভাবে প্রেমের কয়েকটি শর্ত আছে। কাছাকাছি থাকা, দায়বদ্ধতা ও বিশ্বাস। এর কোনো একটির অনুপস্থিতি বা ঘাটতি থেকে ভাঙন ধরে।

* কাছাকাছি থাকার ব্যাপারটিকে অবহেলা করা যায় না। বলা হয়, ছোট ছোট বিচ্ছেদ প্রেমকে গভীর করে দীর্ঘ বিচ্ছেদ প্রেমের মৃত্যু ঘটায়। দীর্ঘকাল প্রেমাস্পদের নৈকট্য বঞ্চিত হলে প্রেমের করুণ পরিণতি ঘটতে পারে।

* হালকা চালে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠল। কিছুদিন একজনের সঙ্গ উপভোগ করলাম, কিন্তু কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নেই, পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই—এ রকম সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয় না।

* বিশ্বাস হচ্ছে যেকোনো সম্পর্কের মূল ভিত্তি। সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কারণে সম্পর্কের সুতোটি ছিঁড়ে যায়।

এসব ছাড়া অনেক সময় বাহ্যিক কারণেও প্রেমের করুণ সমাপ্তি ঘটতে পারে। অভিভাবকদের জোরজবরদস্তি বা সামাজিক রীতির তীব্র ভ্রুকুটিও প্রেমিক যুগলকে পৃথক করতে পারে পরস্পরের কাছ থেকে।

মন ভাঙে, প্রেমাস্পদ দূরে সরে যায়। কিন্তু প্রেম তো মরে না। মনের গহিন কোণে, যাকে আমরা বলি অবচেতন, সেখানে সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়। ‘রিট্রাইভাল কিউ’র উসকানি পেলে আবার জেগে ওঠে সেই প্রেমের স্মৃতি। তবে সেই স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই মানুষ বেঁচে থাকে, তা-ও কিন্তু নয়। আবেগের কেন্দ্র থাকে মস্তিষ্কে। নতুন আবেগ এসে ঢেকে দেয় পুরোনো আবেগকে। ঢেকে দেয় বলে পুরোনো প্রেমের কথা ভুলে সুখের দাম্পত্য জীবন গড়ে তুলতে পারে মানুষ। এখানেও প্রেম আছে। আছে স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততা, সন্তানের প্রতি বাৎসল্য আর সংসার ঘিরে আশা ও আনন্দ।

অনেকেই স্বামী বা স্ত্রীকে তাঁর পূর্ব প্রেমের কথা জানাতে চান না। কারণ, সেটা সহজে গ্রহণ করতে পারেন না স্বামী বা স্ত্রী। কেন তাঁরা এ কথা বোঝার চেষ্টা করেন না যে, মায়ের কোল থেকে পড়েই তো কেউ স্বামী বা স্ত্রীর কোলে এসে পড়েন না। মধ্যখানে এত বড় জীবন ঘটনাবিহীন থাকবে এটা কী করে সম্ভব? তবে বুদ্ধিমানেরা বলেন, পুরোনো কাসুন্দি না ঘেঁটেই যদি দাম্পত্য সম্পর্ক ও সংসার নিরাপদ থাকে, তাহলে না জানানোই ভালো। ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে!’

শরৎচন্দ্রের উপন্যাস দেবদাস পড়তে ভালো, সঞ্জয়লীলা বনশালীর চলচ্চিত্র দেবদাসও দেখতে মন্দ নয়। কিন্তু প্রেমের ব্যর্থতায় বাঈজি বাড়ি ঘুরে আসা বা মাতাল হয়ে ‘পারু পারু’ বলে হাহাকারে পার্বতীর বাড়ির সামনে এসে জীবন বিসর্জন আদর্শ প্রেমিকের জীবন হতে পারে না। এ ধরনের চরিত্র মানুষের মনে সাময়িক করুণা জাগায়, সমীহ জাগায় না। এটা মনুষ্যত্বের অবমাননা ছাড়া আর কিছুই নয়।

মনোচিকিৎসক আহমেদ হেলালের পরামর্শ, ইগো-ডিফেন্স তৈরি করতে হবে। ব্যর্থতা, প্রতারণার বোধ থেকে নিজেকে আঘাত করা, নিজের ভবিষ্যৎকে বিপন্ন করা যেমন প্রকৃত প্রেমিকের কাজ হতে পারে না, তেমনি প্রেমাস্পদের সুখের জীবন দেখে ঈর্ষাপরায়ণ বা প্রতিহিংসাপ্রবণ হওয়াটাও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পরিচয় প্রকাশ করে না।

জীবনকে নদীর সঙ্গে যে তুলনা করেন কবি-লেখকেরা, তা এখন ক্লিশে মনে হতে পারে। কিন্তু এই তুলনার মধ্যে যুক্তি আছে। নদীতে ছোট-বড় ঢেউ ওঠে, তা মিলিয়েও যায়। কিন্তু যে ঢেউ নদীর পাড় ভাঙে, সেই আঘাত বা ক্ষতটাই দীর্ঘস্থায়ী হয়।

তবে সবচেয়ে ভালো হয় ‘প্রাক্তন’–এর সঙ্গে সহজ-সুন্দর একটি সম্পর্ক বজায় রাখতে পারলে। আগের মতো আবেগের তীব্রতা নেই, কিন্তু বন্ধুত্বের মাধুর্য আছে। পরস্পরের প্রতি অভিযোগ-অভিমান-ক্ষোভ নেই, নতুন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই, আছে ক্ষমা ও মমতা।

 লেখক: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক, কবি ও সাহিত্যিক