সাবাননামা

নার্গিস থেকে পারভিন, সুচিত্রা থেকে ঐশ্বরিয়া—অভিজাত সুন্দরীরা যে পণ্যটির বিজ্ঞাপন করতে কোনো কার্পণ্য করেননি, সেটি সাবান। সৌন্দর্য বাড়ুক আর না বাড়ুক, জল এবং সাবানের স্পর্শ শরীর ও মনে একধরনের স্নিগ্ধ প্রশান্তি আনে—যা মানসিকভাবে মানুষকে তরতাজা করে তোলে বলে ধারণা করা হয়। সৌন্দর্যের সঙ্গে তরতাজা বা ফ্রেশ ভাবের যোগাযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ। এখন শুধু তারকা সুন্দরীরাই নন, পৃথিবীর প্রায় সব মানুষ শারীরিক পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবান নিয়মিত ব্যবহার করে। আবার কাপড় বা অন্যান্য জিনিসপত্র পরিষ্কার রাখতেও লাগে সাবান।

রাসায়নিকভাবে সাবান হচ্ছে ফ্যাটি অ্যাসিডের লবণ। কোনো কিছু ধোয়া বা পরিষ্কার করার কাজ ছাড়াও সাবান বস্ত্রশিল্পে পিচ্ছিলকারক পদার্থ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেসব সাবান পরিষ্কারক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বর্তমানে সেসবের মূল উপাদান মূলত উদ্ভিজ্জ বা প্রাণিজ তেলের গাঢ় ক্ষারীয় দ্রবণ থেকে নিষ্কাশন করা হয়। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়াই শুধু নয়, উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পরিষ্কারক দ্রব্য হিসেবে সাবানের জনপ্রিয়তা পৃথিবীজুড়ে।

পৃথিবীতে অনেক ব্র্যান্ডের সাবান ব্যবহৃত হয় গোসল বা কাপড় ধোয়ার জন্য। কঠিন সাবান যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে তরল সাবানও। এককালে ‘টয়লেট সোপ’ নামে গোসলের সাবানের বিজ্ঞাপন করা হলেও এখন তা হয়ে গেছে বিউটি সোপ। বিভিন্ন ভেষজের নির্যাস আর রাসায়নিকের মিশ্রণে তৈরি এই বিউটি সোপ যেমন আছে, তেমনি আছে জীবাণুনাশক সাবান। আবার কাপড় পরিষ্কার করার জন্য লন্ড্রিবার মানে কাপড় কাচার সাবান যেমন আছে, তেমনি আছে গুঁড়ো সাবান বা ডিটারজেন্ট। সোজা কথা, সাবান মানেই পরিষ্কারক—সে শরীর হোক অথবা বস্ত্র বা অন্যান্য জিনিসপত্র।

এককালে সাবান ছিল বিলাসী পণ্য। ১৭৯১ সালের দিকে ফরাসি রসায়নবিদ লে ব্লঁ যখন সাবানের রাসায়নিক প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন, তার আগে পর্যন্ত অভিজাত পরিবারের বাথরুমে শোভা বাড়াত বহুমূল্যের এই পরিষ্কারক পদার্থ। শুধু তাই নয়, সাবানের ওপর কর বসানোর নজিরও রয়েছে সাবানের সুদীর্ঘ ইতিহাসের মধ্যে। লে ব্লেঁর আবিষ্কার করা রাসায়নিক প্রক্রিয়া এবং পরবর্তীকালে রসায়নবিদ মিশেল ইউজিন শেভ্রুলেরর গবেষণা সাবানকে ধনীদের বাথরুম থেকে বের করে সাধারণ মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে তোলে। জন্ম থেকেই সাবান মূলত পরিষ্কারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

‘সাবান’ শব্দটি বাংলা ভাষায় আসে ইংরেজদের হাত ধরে। ইংরেজি সোপ (Soap) শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ স্যাপো (Sapo) থেকে। এই স্যাপো শব্দটি প্রথম ব্যবহার করা হয় খ্রিষ্টীয় ’৭৭ সালে। আবার পর্তুগিজ ভাষায় স্যাব ও অথবা স্যাবোনেট নামে একটি শব্দ রয়েছে, যেটির অর্থ—তেল বা চর্বি এবং অন্যান্য উপাদানের একটি মিশ্রণ, মূলত ছোট আকারের টুকরা যা ধোয়াধুয়ির কাজে ব্যবহৃত হয়।

কেউ কেউ মনে করেন যে স্যাবো থেকে ব্রিটিশ ইংরেজিতে শব্দটি হয়ে যায় সোপ আর তা থেকে বাংলায় সাবান। ভারতীয় উপমহাদেশে সাবানের ব্যবহার খুব প্রাচীন নয়। মধ্যযুগের বিভিন্ন কাব্যের নায়িকাদের গলা জলে নেমে ‘গাত্র মাঞ্জন’ করার বর্ণনা থাকলেও সেখানে সাবানের কথা বলা নেই। তাঁরা ক্ষার-খৈল দিয়ে ‘গাত্র মাঞ্জন’ করতেন। এই কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিশেষ ধরনের মাটি বা খৈল দিয়ে নারীরা তাঁদের দীঘল কালো চুল পরিষ্কার করতেন। কাপড় পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করতেন ছাই ভেজানো ক্ষারীয় জল।

বিভিন্ন লেখাপত্র থেকে জানা যায় যে ভারতীয় উপমহাদেশে নিজেদের ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে লিভার ব্রাদার্স প্রথম সাবান পরিচিত করে তোলে ১৮৯৭ সালের দিকে। এরপর জমশেদ ভাই টাটা ১৯১৮ সালের দিকে কেরালায় নিজেদের সাবান কারখানা নির্মাণ করেন এবং এটিই প্রথম ভারতের স্থানীয় সাবান কারখানা। ১৯৩০ সালের প্রথম দিকে এই কারখানার নিজস্ব ব্র্যান্ডের সাবান বাজারে আসে। এ সবই মাত্র সোয়া ২০০ বছর আগের কথা।

ইতিহাসের কোন সময়ে, কোন জনপদে প্রথম সাবান আবিষ্কৃত হয় সেটা জানা না গেলেও, পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবান জাতীয় বস্তু ব্যবহারের প্রথম প্রমাণ মেলে খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০ বছর আগে, প্রাচীন ব্যাবিলনে। শুধু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাই নয়। একসময় সাবান ব্যবহার করা হতো বিভিন্ন চর্মরোগের চিকিৎসায়ও—এ তথ্য জানা যায় খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সালে প্রকাশিত চিকিৎসাবিজ্ঞান–বিষয়ক প্রকাশনা ইবার্স প্যাপিরাস থেকে। সে সময় মিসরে পশুর চর্বি, সবজির তেল এবং অ্যালকাইন লবণ মিশিয়ে সাবানের মতো দ্রব্য প্রস্তুত করা হতো। মেসপমেটিয়া, মিসর, মধ্যপ্রাচ্য সাবান তৈরি, ব্যবহার ও ব্যবসার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। প্রাচীন চীনেও সাবান ব্যবহারের কথা জানা যায়।

সুগন্ধী সাবান শরীর মন দুটোকেই সতেজ করে। ছবি: অধুনা
সুগন্ধী সাবান শরীর মন দুটোকেই সতেজ করে। ছবি: অধুনা

খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকের দিকে ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেনে সাবানের ব্যবহার শুরু হয় বলে জানা যায়। তবে ইউরোপের অন্যান্য অংশে সাবান প্রচলিত হয় আরও অনেক পরে—সতেরো শতাব্দীর দিকে। কাজেই এটা বলাই যায়, যে জনপদেই সাবান আবিষ্কৃত হোক না কেন, প্রায় সারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের কৃৎকৌশল সাবানকে সমৃদ্ধ করেছে।

জনপ্রিয় তথ্য হলো, সুগন্ধি সাবানের উদ্ভব হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যকে কেন্দ্র করে। প্রাচীন মেসপটেমিয়ান সভ্যতায় সাবান তৈরি ও ব্যবহারের ব্যাপক প্রচলন ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় প্রাচীন সিরিয়ার আলেপ্প শহরের অধিবাসীদের ছিল উৎকৃষ্ট মানের সাবান তৈরির দক্ষতা। আরবীয় রসায়নবিদেরা প্রথম উদ্ভিজ্জ তেল (ভেজিটেবল অয়েল) এবং সুগন্ধি যুক্ত তেল থেকে সাবান তৈরি করেন বলে জানা যায় বিভিন্ন প্রাচীন লেখাপত্রের সূত্রে। তাঁরা সুগন্ধি ও রঙিন সাবান তৈরি করতে দক্ষ ছিলেন। এ ছাড়া আরব রসায়নবিদেরা শেভ করার জন্য এক বিশেষ ধরনের সাবানও তৈরি করতেন।

অষ্টম শতকে ফ্রান্সের সাবান প্রস্তুতকারীরা সুগন্ধি সাবান তৈরি করতেন বলেও জানা যায়। খ্রিষ্টীয় ষোল শতকের দিকে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে উদ্ভিজ্জ তেল থেকে উন্নতমানের সাবান তৈরির প্রচলন হয় বলে জানা যায়। মূলত যুক্তরাজ্যে শিল্প বিপ্লব সূচিত হওয়ার পর সাবানে সুগন্ধি দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনেক উৎকর্ষ সাধন হয়। বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আমদানি করা পাম ও নারকেল এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরপর বিশ শতক থেকে সাবান একটি শিল্পপণ্য হিসেবেই উৎপাদিত হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে।

পৃথিবীর কোন প্রান্তে সাবান উৎপাদনের জন্য কোন ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছে, সাবান ব্যবহারকারী হিসেবে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আসলে কারও নেই। প্রতিদিনের কর্মক্লান্ত, ঘামে ভেজা শরীরকে শাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে অথবা বাথটাবের ফেনা ওঠা জলে সমর্পণ করে এক নিমিষে চাঙা করে তুলতে পারবে কোন সাবান, সেটা নিয়েই বরং মাথা ঘামানো যায়। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে সাবানের ব্যবহার ঠিক পোশাকের মতোই। প্রয়োজনের সঙ্গে যখন সংগতিপূর্ণ শৌখিনতা মিলে যায় সাবানের সুগন্ধ তখন মনকে প্রশান্তিতে ভরে দেয়। গোলাপগন্ধী হোক কিংবা লেবুগন্ধী, জলপাই তেলের কোমলতা হোক বা মেনথলের শীতলতা, সৌন্দর্য বর্ধকই হোক আর জীবাণূনাশক, সাবান আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে গভীর ভাবে, আষ্টেপৃষ্ঠে।

লেখক: লোকসংস্কৃতি–বিষয়ক গবেষক