ভুবন ভোলানো ভুটানে

ভুটানে যাব শুনে পরিচিত ভুটানফেরত অনেকেই পরামর্শ দিলেন সড়কপথে যেতে। তাঁদের দাবি, সড়কপথে ভ্রমণখরচ যেমন কম, তেমনি অনেক বেশি রোমাঞ্চকরও। সেই রোমাঞ্চের আশায় পা বাড়িয়েছিলাম। বাংলাদেশের বুড়িমারী, ভারতের চেংড়াবান্দা হয়ে জয়গাঁও সীমান্ত দিয়ে একদম ভুটান সীমন্তে চলে এলাম। ভারতের এই পথের রোমাঞ্চকর বৃত্তান্ত বলে, ভুটানবৃত্তান্ত ছোট করতে চাই না!

টাইগার নেস্ট ওঠার পথে পাহাড়ের ওপর মেঘের খেলা। ছবি : মোছাব্বের হোসেন
টাইগার নেস্ট ওঠার পথে পাহাড়ের ওপর মেঘের খেলা। ছবি : মোছাব্বের হোসেন

ভারত অংশ পেরিয়ে ভুটান ফটক থেকে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। দলের নতুন সঙ্গী হলেন সানম। তিনি আমাদের মাইক্রোবাসের চালক। পথের বাঁকে বাঁকে পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের আনাগোনা। উঁচু উঁচু পাহাড়ের বাঁক দিয়ে সাঁই সাঁই করে ছুটছে মাইক্রোবাস। রাস্তার নিচে গভীর খাদ দেখে ভয় ধরে যায়। মাইক্রোবাস নিয়ন্ত্রণ হারালেই...। এর মধ্যে সানম এমনভাবে চালাচ্ছেন, যেন খেলনা গাড়ি নিয়ে ছুটছে।

দুর্গম টাইগার নেস্ট
দুর্গম টাইগার নেস্ট

পারো পর্ব
পাঁচ ঘণ্টার যাত্রা শেষে আমরা সন্ধ্যায় পৌঁছাই উপত্যকা কোলের পারো শহরে। গাড়ি থেকে নামতেই কনকনে শীতের ঝাপটা এসে লাগে। যেন শহরটা আমাদের স্বাগত জানাল। হোটেল ঠিক করাই ছিল। ঠিকানা ধরে পৌঁছে গেলাম। রাতের খাবার খেয়ে জমে ওঠা আড্ডার ইতি টানতে হলো। কারণ সকাল সকালই ঘুরতে বেরোব।
সকাল ১০টায় বেরোলাম শহরটা ঘুরে দেখতে। প্রথমেই পারোর জাদুঘর। জাদুঘরের ভেতর ভুটানের বিখ্যাত সব মুখোশ। একেকটা একেক রকম। কোনোটা রাক্ষসের কোনোটা আবার ভয়ংকর জন্তুর। জাদুঘরের বাইরের বিশাল জংটিও (ধর্মীয় প্রার্থনার স্থান) দেখে নিলাম। জংটি গড়ে তোলা হয়েছে পাহাড়ের পাদদেশে। ওপর থেকে দেখা মেলে পারো শহরটা। রংবেরঙের বাড়ি। বাড়িগুলোর বিশেষত্ব হলো প্রতিটির গায়ে গায়ে হাতের নকশা করা।

পারোর চেলিলা পাসে তুষারপাত আর বরফ
পারোর চেলিলা পাসে তুষারপাত আর বরফ

সেখান থেকে আমরা চলে আসি হোটেলে। বিকেলে পারোতে দেখার কী আছে, সেই আভাস পাওয়া গেল চালকের কাছেই। একটা বিশেষ মন্দির। আর আছে টাইগার নেস্ট। টাইগার নেস্ট দেখতে পুরো একটি দিন লাগবে।
তাই আমরা মন্দির দেখেই বেরোলাম বরফ ছুঁতে। চালক বললেন, পাহাড়ে ৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলে ১৩ হাজার ফুট ওপরে চেলিলা পাস বা গিরিপথে গেলে বরফের দেখা পাওয়া যেতে পারে। তবে নিশ্চয়তা নেই। আমরা একটা সুযোগ নিলাম। চেলিলা পাসের পথে শুরু হলো যাত্রা। যতই উপড়ে উঠছি কান তালা লাগছে। চালক বললেন ভয়ের কিছু নেই। ওপরে উঠলে এমন লাগেই।
দেড় ঘণ্টা পর ২৫ কিলোমিটার পথ শেষ হতেই খুব মিহি তুষারপাতের দেখা মিলল। ছোট ছোট বরফস্তূপ পড়ে আছে রাস্তায়। আমরা কিছুটা ভরসা পেলাম। যতই এগোচ্ছি বরফ বাড়ছে। এভাবে ২৯ কিলোমিটার যাওয়ার পর বেশ সফেদ তুষারপাত। দেখি সামনের রাস্তায় বরফ প্রচুর ভাবে জমে আছে। চালক সতর্ক করে বললেন, সামনে গেলে ফেরার পথে সমস্যা হতে পারে। গাড়ি থেকে নামলাম। চারদিকে শুধু বরফ। তুষার বাড়তেই থাকল। একটা সময় এমন হলো ক্যামেরায় ঠিকমতো ছবিই তোলা যাচ্ছিল না। তুষারকণা এসে লেন্সের ওপর পড়ছিল। আমাদের সঙ্গে থাকা দুই শিশু সাদাব আর রাফিদ তুষারে ভিজেই বরফ দিয়ে বানিয়ে ফেলেছে ‘তুষারমানব’! একটা সময় তুষার এতই বাড়ল যে আমরা গাড়িতে বসে থেকে সেটি দেখতে থাকলাম। বেশি দেরি হলে ফিরতে সমস্যা হতে পারে ভেবেই সেখান থেকে লোকালয়ে ফিরতে শুরু করলাম।

ঝিরঝির করে পড়ছে তুষার
ঝিরঝির করে পড়ছে তুষার

পারো উপত্যকার আরেকটি দুর্গম স্থান—টাইগার নেস্ট। অষ্টম শতাব্দীতে তিন বছর, তিন মাস, তিন দিন, তিন ঘণ্টায় তৈরি হয়েছে এটি। নাম বাঘের হলেও এখানে বাঘের দেখা মিলবে না! সমতল থেকে পাক্কা ৫ কিলোমিটার ওপরে। হেঁটে উঠতে হয় ১০ হাজার ফুটের ওপর। পাহাড়ের ওপর এই বিশেষ স্থাপনা। এখানে যেতে হলে দৃঢ় মনোবল আর অপরিসীম ধৈর্য থাকতে হবে। উঠতে প্রায় ৪ ঘণ্টা লেগে যায়। স্থাপনার ভেতরে যে মন্দির আছে, সেটি দেখতেই এত দূরে আসা। নেমে আসতে লাগে দেড় ঘণ্টা। নেমে আসতে আসতে মনে হচ্ছে কিছু একটা জয় করে ফেলেছি! নামার পথেই দেখা গেল কাছের পাহাড়ের চূড়ায় বরফ রোদের আলোয় চিকচিক করছে। সেখানে খেলা করছে মেঘ!

শুভ্র তুষার মন ভালো করে দেয়।
শুভ্র তুষার মন ভালো করে দেয়।

থিম্পুর পথে পা, আরও রইল পুনাখা
পারো পর্ব শেষে আমরা চললাম ভুটানের রাজধানী শহর থিম্পুর পথে। সেই একই রকম রোমাঞ্চকর পথ। উঁচু পাহাড়ে ঘেরা রাস্তা। চোখ-মন জুড়িয়ে যায়। বিকেলে থিম্পুতে প্রবেশ করলাম।
থিম্পু শহরে এলেও আমাদের লক্ষ্য ছিল, পুনাখায় যাওয়ার। সকাল সকাল উঠে পুনাখা যাওয়ার তোড়জোড় শুরু হলো। ওখানে গেলে আলাদা অনুমতি নিতে হয়। অনুমতি মিলেছিল। টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই আমরা যেতে থাকলাম পুনাখা। এই পথই দোচলা পাস। ভুটানের রাজধানী থিম্পু থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান৷ উচ্চতা প্রায় ১০ হাজার ৫০০ ফুট৷ সেখানে নেমেও মন ভরে গেল এর সৌন্দর্য দেখে। এতে আছে সারি সারি ১০৮টি স্মৃতিস্তম্ভ। এখানেও বাড়তি হিসেবে মিলল তুষারপাত। এখান থেকে দুই ঘণ্টার পর পৌঁছালাম পুনাখাতে। দুপুরের খাবার খেয়েই বেরিয়ে পড়লাম।

পারোর জং গড়ে তোলাহয়েছে পাহাড়ের পাদদেশে
পারোর জং গড়ে তোলাহয়েছে পাহাড়ের পাদদেশে

পুনাখা জায়গাটা ভুটানের গ্রাম। এখানে একটি প্রাচীন জং আছে। পাশে বয়ে গেছে নদী। দুর্গের আদলে তৈরি এক স্থাপনা, যেখানে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা থাকেন। এখান থেকে কিছুদূর যেতেই মিলল পুনাখা সাসপেনশন সেতু। ফো চু নদীর ওপর নির্মিত এই ঝুলন্ত সেতু। ৩৫০ মিটার লম্বা এই সেতুর ওপর দেখা যায় নদী আর পাহাড়ের মনকাড়া দৃশ্য। এখানে নীল হয়ে গেছে নদীর পানি।

দোচলা পাস। ভুটানের রাজধানী থিম্পু থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান৷ উচ্চতা প্রায় ১০,৫০০ ফুট৷
দোচলা পাস। ভুটানের রাজধানী থিম্পু থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান৷ উচ্চতা প্রায় ১০,৫০০ ফুট৷

আমরা থিম্পুর পথে পথ ধরলাম। সন্ধ্যা নেমে এল পাহাড়ে। দোচলা গিরিপথের পাশে আসতেই গাড়িতে বসে দেখি আবার তুষার পড়ছে। গাছ রাস্তা সাদা সাদা হয়ে আছে।
ভুটানে এসে রোদ, বৃষ্টি, তুষার সবকিছুর দেখাই পেলাম। ভুটানে কোনো অস্থিরতা নেই। শান্ত এক দেশ। শান্ত দেশের শান্তির আবেশ নিয়েই ফিরেছি দেশে।

থিম্পু ঢুকেই দূর থেকে দেখা মিলল গৌতম বুদ্ধের বড় এক মুর্তির।মূর্তিটি ১৬৯ ফুট উঁচু (প্রায় ১৭ তালা ভবনের সমান)।চতুর্থ রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুকের ৬০তম জন্ম বার্ষিকী উদযাপনে উপলক্ষ্যে ভুটানের রাজধানী থিম্পুর কুয়েসেলফোদরং পাহাড়ে এই বিশালাকায় মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
থিম্পু ঢুকেই দূর থেকে দেখা মিলল গৌতম বুদ্ধের বড় এক মুর্তির।মূর্তিটি ১৬৯ ফুট উঁচু (প্রায় ১৭ তালা ভবনের সমান)।চতুর্থ রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুকের ৬০তম জন্ম বার্ষিকী উদযাপনে উপলক্ষ্যে ভুটানের রাজধানী থিম্পুর কুয়েসেলফোদরং পাহাড়ে এই বিশালাকায় মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

যেভাবে যাবেন
ভুটানে মূলত দুইভাবে যাওয়া যায়। স্থলপথে অথবা আকাশপথে। স্থলপথে যেতে ভারতের ট্রানজিট ভিসা নিতে হবে। ঢাকা থেকে বাসে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী সীমান্তে পৌঁছানো যায়। তারপর বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন হয়ে ভারতের চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্তে। চ্যাংড়াবান্ধা থেকে জয়গাঁওতে যেতে ভাড়া করা মিনি মাইক্রোবাস পাওয়া যায়। জয়গাঁও হলো ভারত-ভুটান সীমান্ত। সেখানে গিয়ে তাৎক্ষণিক ভুটানের ভিসা নিতে হয়। এরপর হেঁটে ঢুকে পড়তে হয় ভুটানে।

পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ বা সেতু। ফো চু নদীর উপর নির্মিত এই ঝুলন্ত সেতু । ৩৫০ মিটার লম্বা এই সেতুর ওপর দেখা যায় নদী আর পাহাড়ের মনকাড়া দৃশ্য। এখানে নীল হয়ে গেছে নদীর পানি।
পুনাখা সাসপেনশন ব্রিজ বা সেতু। ফো চু নদীর উপর নির্মিত এই ঝুলন্ত সেতু । ৩৫০ মিটার লম্বা এই সেতুর ওপর দেখা যায় নদী আর পাহাড়ের মনকাড়া দৃশ্য। এখানে নীল হয়ে গেছে নদীর পানি।

চাইলে সড়কপথে শিলিগুড়ি থেকে বাসে ঢাকা আসতে পারবেন। এটাও সাশ্রয়ী। বাসে ঢাকা থেকে শিলিগুড়ি ১ হাজার ৫০০ টাকা ভাড়া। সেখান থেকে জয়গাঁও মাইক্রোবাসে ২ হাজার টাকা।
ঢাকা থেকে সরাসরি পারোতে উড়োজাহাজ চলে। দ্রুক এয়ারের সে উড়োজাহাজেও আপনি চলে যেতে পারেন ভুটান।'

পুনাখার জং গড়ে উঠেছে নদী আর পাহাড়ের পাদদেশে।
পুনাখার জং গড়ে উঠেছে নদী আর পাহাড়ের পাদদেশে।
ভুটানের শুভেচ্ছা স্মারক।
ভুটানের শুভেচ্ছা স্মারক।
পাহাড়ের উপর থেকে দেখা থিম্পু শহর।
পাহাড়ের উপর থেকে দেখা থিম্পু শহর।