খেতে বসে কী করবেন না?

‘খেতে বসে পা নাড়ানো যাবে না, তাতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে’ কিংবা ‘খাবার ছেড়ে ওঠা যাবে না, তাতে অমঙ্গল হবে’—খেতে বসে নিজেদের অজান্তেই আমরা এ রকম সংস্কারের মুখোমুখি হই। কখনো সেগুলো মানি, কখনোবা হেসেই উড়িয়ে দিই। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি, কেন এসব সংস্কার তৈরি হয়েছে? কারা তৈরি করেছিল এগুলো কিংবা কোনো সামাজিক মনস্তত্ত্ব কাজ করে এসব সংস্কার তৈরির পেছনে?

যে কারণে খাদ্যসংস্কার
খাবার শুধু মানুষের ক্ষুধা নিবৃত্তিই করেনি, জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় ‘অনেক কিছু’ উদ্ভাবনের অনুঘটক হিসেবেও কাজ করেছে। যেমন: মর্গান মনে করেন, মাছ খাওয়া শুরু করার কারণেই হয়তো মানুষ আগুন আবিষ্কার করে। এরপর যতই সময় এগিয়ে গেছে, মানুষ যতই উন্নত হয়েছে, সংখ্যায় বেড়েছে ততই মানুষের খাদ্যের চাহিদা বেড়েছে। এই চাহিদার কারণেই মানুষ নতুন খাদ্যের সন্ধান করেছে, খাদ্য উৎপাদন-সংরক্ষণ-রন্ধনের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। মানুষ যতই উন্নততর সভ্যতার দিকে এগিয়ে এসেছে, ততই তার সমাজ জটিল হয়েছে। আর সেই জটিলতার কেন্দ্রবিন্দুতে থেকেছে খাদ্য। এর বড় উদাহরণ কৃষির আবিষ্কার। এই আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে খাবারের জগতে আসে বিশাল বৈচিত্র্য। এর সঙ্গে শুরু হয় সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার নতুন অধ্যায়, শুরু হয় নতুন নতুন শস্য উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা, শুরু হয় কৃষিকেন্দ্রিক দেবতার ধারণা, উদ্ভব ঘটে খাবার নিয়ে মানুষের নতুন সংস্কার এবং মিথের। যেহেতু খাদ্য মানুষের বেঁচে থাকার প্রধানতম অবলম্বন, তাই এর সর্বোচ্চ সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে চেয়েছে মানুষ। সে কারণেই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন বিধিনিষেধ, বিশ্বাস বা সংস্কার। কখনো কখনো সামাজিক মনস্তত্ত্বও প্রকাশিত হয়েছে এসব সংস্কার বা বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে।

কিছু প্রচলিত সংস্কারের ব্যাখ্যা

কখনো কখনো খাদ্য অপচয় না করার প্রবণতাকে কঠিনভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার বা পালন করার চেষ্টা করা হয়েছে আমাদের সমাজে। খাদ্যদ্রব্যের অপচয় রোধে বিভিন্ন উপায়ে চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, খাবার থালায় আঁকিবুঁকি কাটা মানা, খাবার ছুড়ে মুখে দেওয়া মানা, তাতে অভাবের কারণ ঘটতে পারে। আরও বলা হয়েছে, ভাতের কোল ভেঙে খেতে হয়, নয় তো অভাব যায় না কিংবা হাঁড়ি থেকে সরাসরি প্লেটে ভাত বেড়ে খেতে বা দিতে নেই। তাতে দারিদ্র্য কাটে না; খাবার সময় পা নাচাতে নেই, এতে অমঙ্গল হয়। অথবা রাতের বেলা ভাঁড়ার থেকে কাউকে চাল দিতে নেই, দিলে অভাবে পড়তে হবে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই প্রতিটি সংস্কারে খাবারের অপচয় রোধের কথা কোনো না–কোনোভাবে বলা হয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে নিজ পরিবারের মঙ্গল কামনাও। কখনো কখনো খাবার অপচয় রোধে আরও কঠিন কথা বলা হয়েছে। যেমন, ঝগড়া লাগলে খাওয়া রেখে তাতে যোগ দিতে নেই—পরিণাম অবধারিত মৃত্যু। খেয়াল করুন, এই সংস্কারে বলা হয়েছে, পরিণাম অবধারিত মৃত্যু। অর্থাৎ খাওয়া শেষ না করে তুমি ঝগড়া করতেও যেতে পারবে না।


কোনো কোনো সংস্কার পুরুষ আধিপত্যের কথাও বলে। যেমন, ছেলেদের ভেটকি মাছের মাথা খেতে নেই। অথবা চ্যাং (টাকি) মাছের মাথা পুরুষদের খেতে নেই। এখানে উল্লেখ করতে হয়, মাছ হিসেবে ভেটকি বা চ্যাং সুস্বাদু হলেও তাদের মাথা সুস্বাদু নয়। কাজেই স্বাদহীন এই মাথা পুরুষ মানুষের খাওয়া উচিত নয়। এই সংস্কারে চরম পুরুষ আধিপত্যের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে।


খাদ্য বা খাবার নিয়ে এ রকম বিভিন্ন সংস্কার গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জনপদে। এগুলো বিভিন্নভাবে আমাদের জীবনে খাদ্যের গুরুত্বের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে বিভিন্নভাবে। আর যেহেতু সংস্কার ব্যবহারিক বিষয়, তাই মানুষ তাদের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে এগুলো কোনো না কোনোভাবে ব্যবহার করে। উপকার পাওয়া কিংবা না পাওয়া এখানে মুখ্য নয়। মুখ্য বিষয় হলো জীবনচর্যার শৃঙ্খলা রক্ষা করা।

আরও কিছু সংস্কার

• খেতে খেতে হেঁচকি উঠলে ভাবা হয় কেউ তাকে মনে করছে/মিস করছে।
• খেতে খেতে জিবে কামড় পড়লে মনে করা হয় কেউ গাল দিচ্ছে।
• গোল গোল দলা পাকিয়ে ভাত খেতে নেই। তাতে অমঙ্গল হয়।
• খেতে বসে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়ার শব্দ পেলে থালার নিচে পানি দিতে হয়।
• দারকি (মাছ ধরার স্থানীয় যন্ত্র) দিয়ে মাছ ধরলে সধবাদের অভিশাপ লাগবে।
• আদা দিয়ে মিষ্টিকুমড়া রান্না করে খেলে মানুষ অসুস্থ হয়।
• কড়াইতে ভাত ভাজা করলে অলক্ষ্মী ঘরে ঢোকে।
• পিঠা খেয়ে কোনো শুভ কাজে গমন করলে তাতে বিঘ্ন ঘটে।
• মাংস নিয়ে যানবাহনে যাত্রা করলে দুর্ঘটনা ঘটে।
• কাঁঠাল নিয়ে যাত্রা অশুভ।
• ব্রাহ্মণদের ইলিশ মাছের লেজের মাঝখান কেটে খেতে হয়।
• খাবার শেষে পাতে পানি ঢেলে দিতে হয়। না হলে মায়ের বুক জ্বলে।
• খাওয়া শেষে থালায় টোকা দেওয়া বা আঙুল ঝাড়া নিষেধ। তাতে সৃষ্টিকর্তা রাগ করে।
• খেতে খেতে ঢেঁকুর উঠলে আর খেতে নেই।
• চন্দ্রগ্রহণের সময় গর্ভবতীর মাছ কোটা নিষেধ। তাতে বাচ্চা বিকলাঙ্গ হয়।
• হাঁড়ি থেকে ভাত নেওয়ার সময় হাতা দিয়ে আওয়াজ করা যায় না। তাতে সংসারে অমঙ্গল হয়।
• চৌকাঠে বসে খেতে নেই। তাতে অমঙ্গল হয়।
• সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণের সময় কোনো কিছু খাওয়া নিষেধ।
• খাবার খেতে খেতে কথা বললে সে মানুষ পাগল হয়ে যায়।
• দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পানি পান করতে নেই।
• আলু ও কচু একত্রে রান্না করে খাওয়া নিষেধ।
• গরম ভাতে পানি ঢেলে খাওয়া নিষেধ।
• চৈত্র মাস শেষ হওয়ামাত্র লাউ, লাউপাতা খাওয়া বন্ধ। লাউগাছটি কেটে ফেলতে হবে। নইলে ঝড়বৃষ্টিতে বাজ পড়বে।
• রাজহাঁসের মাংস খেতে খেতে কাশতে নেই। এতে রাজরোগ (T.B.) হয়।
• মেয়েদের নারকেলের পানি খাওয়া নিষেধ। খেলে মেয়েরা স্রাবসংক্রান্ত রোগে ভুগবে।
• মেয়েরা মাছের মাথা খেলে মায়ের মরা মুখ দেখার ভাগ্য হয় না।
• ফল খেয়ে পানি খাওয়া যাবে না। তাতে পেটের অসুখ হবে।
• ভাত খেয়ে পাতে পানি দিতে হবে।
• ভাত খেয়ে আড়মোড়া ভাঙা যাবে না।
• গরম ভাত খেয়ে গোসল করা যাবে না।
• ভাদ্র মাসের অমাবস্যায় বিষকচুর ঝোল খেলে গায়ের বিষব্যথা কমে।
• বৃহস্পতিবার মাছ পোড়া খেতে নেই। অঙ্গল হয়।
• ভাদ্র মাসে তালের পিঠা খেতে নেই। পিত্ত বাড়ে।
• বাজার থেকে কিনে আনা তরিতরকারি কুলায় ঢেলে রাখতে নেই। তাতে অমঙ্গল আর অভাব বাড়ে।
• শাক কুলায় বাছতে নেই, তিতা হয়ে যায়।