এই গরমে ডায়রিয়া থেকে সাবধান

পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা গেলে ডায়রিয়ার মতো রোগ প্রতিরোধ করা যায়। মডেল: শশী, ছবি: অধুনা
পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করা গেলে ডায়রিয়ার মতো রোগ প্রতিরোধ করা যায়। মডেল: শশী, ছবি: অধুনা

গরমের সময় পানির ব্যবহার অনেক বেড়ে যায়। সবাই পানি বেশি ব্যবহার করেন। সেটা পানি পান করার ক্ষেত্রেও। কারণ, গরমে মানুষের পানির তৃষ্ণা বাড়ে। ঢাকা শহরের পরিধি বাড়ছে না, কিন্তু জনসংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঢাকা শহরে আসে নতুন কাজের সন্ধানে। এসেই কিন্তু বস্তিতে থাকার জায়গা পায় না। সেখানে থাকারও অনেক সমস্যা। ফলে রাস্তার পাশে এবং এখানে–ওখানে থাকে। অনেকে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করে টিকে থাকার জন্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা যে পানি পান করছে, সেই পানি দূষিত। সে কারণে গরমের এই সময় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়ে যায়।

পানি ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়, সেগুলো সব সময় বিশুদ্ধ নয়। গরমে খাবারও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। রাস্তায় পাশে যে খাবার বিক্রি হচ্ছে বা বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় যে খাবার আমরা খাই, গরমের কারণে সেগুলোও বেশিক্ষণ খাবারের উপযোগী থাকে না। ঢাকা শহরে অনেকেই রেস্তোরাঁয় খাবার খান। কিন্তু সেই খাবার বাসি কি না, সেটা আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। অনেক সময় অনেক রেস্তোরাঁয় সুন্দরভাবে খাবার পরিবেশন করে। কিন্তু সুন্দরভাবে পরিবেশন করা খাবারটি বাসিও হতে পারে। অনেকে অভিযোগ করে, রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে তার পেট খারাপ ও ডায়রিয়া হয়েছে।

এরপর হলো আমাদের পানিপ্রবাহের বিষয়। ভূগর্ভস্থ থেকে পানি রিজার্ভারে তোলা হয়। রিজার্ভার থেকে আবার ওপরে তোলা হয়। এরপরে বাসায় বাসায় দেওয়া হয়। এখানে একটি কথা বলতে হয়। পানি জমিয়ে রাখার এই উপকরণগুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কম পরিষ্কার করা হয়। পরিষ্কার না করার ফলে তাতে শেওলা জমে। ভেতরে জীবাণু আশ্রয় নেয়। বিশেষ করে কলেরার জীবাণু। যখন প্রচণ্ড গরম পড়ে, তখন এই শেওলাগুলো অনেক ফুলতে ও ফাঁপতে থাকে। তখন নিজেদেরই খাদ্যের প্রয়োজন হয়। এরপর খাদ্যের অভাবে এগুলো ভেঙেচুরে মরে যায়। তখন জীবাণুগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়ে ওই পানিতে। জীবাণুগুলোর বাঁচার জন্য তাদের খাদ্য হচ্ছে মৃত শেওলা।
যেসব জায়গায় পানির সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ, সেই সব জায়গায় ছড়িয়ে যায়। এভাবে ডায়রিয়ার সংখ্যা বেড়ে যায়।

মূল কথা হচ্ছে, এই প্রচণ্ড গরমে পানির ব্যবহার করার হার বেড়ে যায়। বেশির ভাগ জায়গায় পানি দূষিত। আর খাবারদাবারও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়, সেটাও দূষিত। এ কারণে ডায়রিয়া হয়।

হওয়ার আগে সাবধানতা

যেহেতু এটা পানিবাহিত রোগ, তাই সব সময় বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। ফুটিয়ে পানি পান করা হলো সবচেয়ে ভালো। কিন্তু সবাই তো আর ফুটিয়ে নিতে পারবে না। রাস্তার পাশে বা বস্তিতে যারা থাকে, তারা সব সময় পানি ফুটিয়ে পান করতে পারে না। সেটা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে উন্নত দেশের মতো আমরা কল খুলে পানি পান করতে পারি না। ফলে দেখতে হবে যারা পারে তাদের প্রথমত ফুটিয়ে পানি পান করতে হবে। এ ছাড়া ফিল্টার ব্যবহার করা বা বোতলের পানি পান করতে পারে।

আমাদের বাসায় আমরা ফিল্টার ব্যবহার করে পানি পান করি। আমাদের বাসায় আমরা এটা লক্ষ করি, নিচের রিজার্ভার এবং ওপরের ট্যাংক নিয়মিত ভালোভাবে পরিষ্কার করা হচ্ছে কি না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সারা বছর হাত ধোয়ার অভ্যাসটা সব সময় রাখা। সাবান ব্যবহার উচিত টয়লেট করার পরে। যাদের কাছে সাবান নেই, তাদের উচিত প্রচুর পরিমাণ পানি দিয়ে হাত ধোয়া। আর খাবারদাবারের বিষয়ে সবার সতর্ক থাকতে হবে। ছোট বাচ্চা ছয় মাস পর্যন্ত শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করবে। এগুলো যদি থাকে, তাহলে ডায়রিয়া কম হবে। তবে ডায়রিয়া যে একেবারে হবে না, তা নয়। এর মধ্যেও কোনো না কোনো ডায়রিয়া হতে পারে। কিন্তু ডায়রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, খাবার আগে–পরে এবং টয়লেট করার পরে ভালোভাবে হাত ধোয়া উচিত। আশপাশের পরিবেশকে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার।

হয়ে গেলে কী করবেন

ডায়রিয়ায় যেটা হয় তা হলো লবণ আর পানি শরীর থেকে বের হয়ে যায়। এটা সময়মতো ফেরত দেওয়া গেলে ভালো। লবণ–পানি শরীরে ফেরত দেওয়ার ফলে যে জায়গা থেকে
এগুলো বের হয়, সেটা আবার পূরণ হয়ে যায়। বর্তমানে যেকোনো দোকানে খাওয়ার স্যালাইন পাওয়া যায়। ডায়রিয়া হলে সবার আগে স্যালাইন খাওয়ানো উচিত। ওরস্যালাইন খাওয়ার পরে যদি অবস্থার অবনতি হয়, তাহলে অতি দ্রুত কাছের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। শুধু আইসিডিডিআরবির কথা চিন্তা করলে হবে না।

ডায়রিয়া প্রতিরোধে ফিল্টারের পানি পান করতে পারেন। ছবি: অধুনা
ডায়রিয়া প্রতিরোধে ফিল্টারের পানি পান করতে পারেন। ছবি: অধুনা

ডায়রিয়া হয়ে গেলে দেরি করা যাবে না। এই গরমে তীব্র ডায়রিয়া হলে ওরস্যালাইনেই ভালো হয়ে যাবে, সেটা ভাবা উচিত নয়। অর্থাৎ ডায়রিয়া হয়ে গেলেই ওরস্যালাইন খাওয়ানো শুরু করতে হবে। খাওয়াতে খাওয়াতে হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। আর প্রথমে কাছের হাসপাতালেই নিয়ে যেতে হবে।

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ছয় মাস পর্যন্ত শুধু বুকের দুধ পান করানো উচিত। ডায়রিয়া হলে বাচ্চাকে বুকের দুধ পান করানোর পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে।

ডায়রিয়া হওয়ার আগে কলেরার ভ্যাকসিন খেতে পারেন। কিছুদিন আগে মিরপুরে কলেরার ভ্যাকসিন খাওয়ানো হয়েছে। এর ফলে ওই অঞ্চলে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হার কিছুটা কম।

পরিকল্পনাও প্রয়োজন

আরেকটা বড় বিষয় আছে, সেটা হলো ওয়াসা যেখান থেকে পানিটা ছাড়ছে, সেই পানি যদি আপনি পরীক্ষা করেন, তাহলে দেখবেন ক্লোরিনও ভালো আছে, জীবাণুও নেই। এখন সেই পানিটা একটা পাইপ দিয়ে এল কোনো এলাকায়। সেই এলাকায় ওই পানি নিয়ম অনুযায়ী ১০০ জনের ব্যবহার করা উচিত। দেখা গেল সেই পানি আরও ৯০০ জন মানুষ অবৈধভাবে ব্যবহার করছে। আবার যে পাইপ দিয়ে পানিটা আসছে, সেটা পুরোনো। ওই পাইপ আরও ৯০০ জনে সংযোগ নেওয়ার ফলে পাইপটি ফুটো হয়ে যায়। ফুটো হলে ওই পাইপের ওপর একটা নেতিবাচক চাপ পড়ে। এ কারণে আশপাশে যে সুয়ারেজ লাইন আছে, সেখান থেকে ময়লা ঢুকে যায় পানি সরবরাহের পাইপে। এই পানিটা যখন গরমের মধ্যে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে, তখন দেখা যায় ডায়রিয়া আরও বেড়ে যায়। ওয়াসার পানির এই পাইপের বিষয়টা তো আগামীকাল বা আজই ঠিক করা যাবে না।

এ বিষয়ের জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। বাংলাদেশ সব দিক থেকে অনেক উন্নতি করেছে কিন্তু এই খাতে কেন পিছিয়ে আছে। এটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। পরিকল্পনা করতে হবে এবং সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে। ডায়রিয়া দূর করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। আর ডায়রিয়ার জন্য স্বল্পমেয়াদি হলো ওরস্যালাইন খাওয়ানো শুরু করা এবং মাঝারি মেয়াদি পরিকল্পনা হলো ওরস্যালাইন খাওয়ানোর পাশাপাশি দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হলো অবকাঠামোর উন্নয়ন। 

চিফ ফিজিশিয়ান অ্যান্ড হেড হসপিটালস, অ্যান্ড প্রিন্সিপাল ইনভেস্টিগেটর, রোহিঙ্গা প্রজেক্ট, আইসিডিডিআরবি।