মায়েরও চাই যত্ন

মা হওয়ার পরও নিজেকে প্রাণবন্ত ও ফিট রেখেছেন উপস্থাপক ও মডেল শ্রাবণ্য। ছবি: অধুনা
মা হওয়ার পরও নিজেকে প্রাণবন্ত ও ফিট রেখেছেন উপস্থাপক ও মডেল শ্রাবণ্য। ছবি: অধুনা

বাড়ির সবার স্বাস্থ্যের দেখভাল করেন মা। কার ওষুধ শেষ হয়ে গেছে, কার কবে ডাক্তারের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল, কার কী খাওয়া নিষেধ, কার আবার কী খাওয়ার উপদেশ রয়েছে—এসবই মায়ের নখদর্পণে। খাবারদাবারের পরিচ্ছন্নতা, বাড়ির সবার জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা, পরিবারের স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস নিশ্চিত করা তাঁরই দায়িত্ব। কিন্তু তাঁর খবরটা রাখছে কে?

এখনো কিন্তু অনেক মা সবার খাবারদাবারের পর যা বাকি থাকে, তা–ই দিয়ে খাওয়া সারেন। সবার জন্য প্রতিদিন দুধ–ডিম বরাদ্দ করা তাঁর কাজ, কে কীভাবে খাবে, ডিম সেদ্ধ না ডিম পোচ, কার দুধ গরম হওয়া চাই, কারটা ঠান্ডা—এসবই মায়ের ভাবনা হলেও মাসে দু–একবারও তিনি নিজে দুধ–ডিম খান কি না, সন্দেহ। ছেলেমেয়ের টিফিনে মৌসুমি ফল কেটে দিচ্ছেন, খাবার টেবিলে দিচ্ছেন তাজা সালাদ, কিন্তু নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর নেই। স্বামী ভোরে উঠে হাঁটতে যান, ফিরে এসে খাবেন এক গ্লাস তাজা লেবুর শরবত; ছেলে যায় জিম করতে, তাই তার হাই প্রোটিন ডায়েট চাই, কিন্তু মাসে এক দিনও তাঁর ফুরসত হয় না ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করার। অনেকে বিশ্বাস করতে চাইবেন না হয়তো, কিন্তু পেশাগত কারণেই রোগীর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচরণের খোঁজ নিতে হয় আমার, শতকরা আশি ভাগের বেলায়ই এই অবস্থা। অথচ আজকাল তাঁরা জানেন না কিছু, তা কিন্তু নয়। তাঁরা পত্রিকায় স্বাস্থ্যবিষয়ক লেখা পড়েন, লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনে পড়েন স্বাস্থ্যকর খাবার আর ব্যায়ামের নিয়মকানুন, টেলিভিশনের স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠানের মূল দর্শক কিন্তু নারীরাই, ইউটিউবে বা ইন্টারনেটেও সার্চ করেন এসব বিষয়, তবে তার সবই অন্যের জন্য। নিজের জন্য নয় কিছুই। শহরের বেশির ভাগ নারী ভীষণ রকমের অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করে থাকেন। কর্মজীবী নারী হলে তো কথাই নেই। সকালবেলা তাড়াহুড়া করে রান্নাবান্না, বাচ্চাকে রেডি করা, স্বামী–সন্তানদের নাশতা–টিফিন গুছিয়ে দিয়ে ছুটতে ছুটতে অফিস এসে ব্রেকফাস্ট করার সময় হয় না বা হলেও খেতে হয় ক্যানটিনের তেলে মাখা পরোটা বা শিঙাড়া। খাওয়ারই ফুরসত নেই তো আবার ব্যায়াম?

গবেষণা বলছে, বিগত ২০ বছরে শহুরে নারীদের গড়পড়তা ওজন বেড়েছে অনেক। তাঁরা আগের চেয়ে অনেক বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন স্থূলতা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগের মতো রোগে। এর কারণ, নিজের বিষয়ে চূড়ান্ত রকমের অসচেতনতা। অথচ একটু সচেতন হলেই নিজেকে সুস্থ ও ফিট রাখা সম্ভব।

* বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ওজন বাড়তে থাকে, ঝুঁকি বাড়ে নানা ধরনের রোগবালাইয়ের। তাই ক্যালরি হিসাব করে দৈনিক খাবার গ্রহণ করুন। চর্বি ও শর্করা কমিয়ে দিন, আমিষ খান পর্যাপ্ত। সাধারণ বাঙালি নারীদের ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ গ্রাম ক্যালরিতে হয়ে যাওয়ার কথা।

* একটু বয়স বাড়লেই হাড়ক্ষয়, অস্টিওপোরোসিস ইত্যাদি আক্রমণ করে নারীদের। দাঁত ও হাড় মজবুত রাখার জন্য ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডির মজুত দরকার। তাই নিয়মিত দুধ, দুগ্ধজাতীয় খাবার (যেমন দই, পনির), সবুজশাক, ছোট মাছ খান। ভিটামিন ডি পেতে দিনের বেলা ৩০ থেকে ৪০ মিনিট রোদে সময় কাটান।

* রক্তশূন্যতা নারীদের বেশি হয়। মাসে মাসে পিরিয়ডের সঙ্গে ও সন্তান জন্মের সময় যে আয়রন চলে যায়, তা আর কখনোই সেভাবে পূরণ করা হয়ে ওঠে না। আয়রনযুক্ত খাবার, যেমন শাকসবজি, ফলমূল যেমন খেতে হবে, তেমনি আয়রন শোষণের জন্য চাই পর্যাপ্ত ভিটামিন সি, যা আছে লেবু, কমলার রস, পেয়ারা ইত্যাদিতে।

* নিজেকে ফিট রাখতে, ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে ও হাড়সন্ধির সুস্থতা বজায় রাখতে নিয়মিত হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট হাঁটা বা জগিং করাই যথেষ্ট। সময় না পেলে বাড়িতে কিছু ফ্রি–হ্যান্ড এক্সারসাইজ করা যায় বা ট্রেডমিল ব্যবহার করতে পারেন।

* চুল ও ত্বকের সুস্বাস্থ্য রক্ষা করতে, উজ্জ্বলতা বাড়াতে নিয়মিত তাজা ফলমূল খাবেন। প্রচুর পানি পান করবেন। নিয়মিত ত্বক পরিষ্কার রাখবেন ও ত্বকের আর্দ্রতা ঠিক রাখতে সঠিক ময়েশ্চরাইজার ব্যবহার করবেন। সপ্তাহে অন্তত এক দিন নিজের দিকে মনোযোগ দিন, চুলের যত্ন নিন।

* সংসার ও কর্মক্ষেত্রের শত কাজের মধ্যেও নিজের জন্য আলাদা করে খানিকটা সময় রাখুন। এ সময় রিলাক্স করুন, মিউজিক শুনুন বা বই পড়ুন। এই একান্ত নিজস্ব সময় আপনাকে বিষণ্নতা, অবসাদ ও ক্লান্তি থেকে রক্ষা করবে। বছরে অন্তত একবার নিজের শারীরিক পরীক্ষা–নিরীক্ষা করান।

লেখক: চিকিৎসক