ঈদের কাপড়ের খোঁজে নবাবপুরে

একসময় এ পথ দিয়ে ঘোড়া চলত, ঘোড়ার খুড়ের টকটক আওয়াজে মুখর হতো এলাকা। এখন কাপড় ওঠানো-নামানোর ধুপধাপ শব্দ আর কচকচ করে চলা কাঁচি বলে দেয়, নবাবরা নবাবপুরের সাম্রাজ্য হারিয়েছেন বহু আগেই। এই এলাকা এখন কাপড়ের ব্যবসায়ীদের।

রোজার মাস শুরু হতেই কাপড়ের এই সাম্রাজ্যে শুরু হয়ে যায় কেনাকাটার ধুম। শহরের নানান প্রান্ত থেকে জ্যাম ঠেলে বুড়িগঙ্গার পাড়ে আসেন অনেকেই। আশা, ঈদে সবচেয়ে কম দামে কিনবেন, সবচেয়ে সুন্দর পোশাকটা। সেই পোশাকের সরবরাহ দিতেই নবাবপুরজুড়ে বসেছে অসংখ্য মার্কেট—নূর ম্যানশন, সাউথ প্লাজা, গুলশান আরা সিটি, মনসুর ক্যাসেল, ইসলাম প্লাজা, হাবিবুল্লাহ মার্কেট… কত যে তাদের নাম। এসব মার্কেটের মধ্যে কোনোটায় কাপড় বিক্রি হয় পাইকারি মূল্যে, কোনোটাতে আবার খুচরা মূল্যে। আবার একই দোকানে পাইকারি দামেই পাওয়া যায় খুচরা কাপড়। সেই মোহে ঢাকার জ্যাম ঠেলাও যৌক্তিক মনে হয় অনেকের কাছেই।

দূর থেকে আসা ক্রেতাদের একজন লিপি আকতার, এসেছেন মাদারটেক থেকে। লিপি জানালেন, ইসলামপুরে কাপড়ের মান অন্য সবখানের থেকে ভালো, তা ছাড়া ইসলামপুরে যত প্রকারের পোশাক পাওয়া যায়, তা কোথাও পাওয়া যায় না। আর দাম তো সব সময় কম। তাই তিনি বোনকে নিয়ে চলে এসেছেন পরিবারের সবার জন্য ঈদের উপহার কিনতে।

নবাবপুরে বাজারে কেনাবেচায় ব্যস্ত ক্রেতা-বিক্রেতারা। ছবি: প্রথম আলো
নবাবপুরে বাজারে কেনাবেচায় ব্যস্ত ক্রেতা-বিক্রেতারা। ছবি: প্রথম আলো

আহসানউল্লাহ রোড ও নবাবপুর রোড তৈরিই হয়েছিল ঘোড়ার গাড়ির মাপে। সেখানে এখন একটির পর একটি মোটরগাড়ি মালপত্তর ভর্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় দুই কোটি মানুষের শহরে যে কত কাপড়ের জোগান লাগে, তার একটা চমৎকার চিত্র পাওয়া যাবে এই পথে দাঁড়ালে। তবে দাঁড়ানোর জো কই এই পথে? সবাই চলছে। কেউ কাপড় খুঁজতে, কেউ কাপড় তুলতে ভিড় ঠেলে পুরে দেবে কোনো একটা মার্কেটের ভেতরে।

সেই সরু পথ ধরে একজনের পেছনে আরেকজন করে রেলগাড়ির মতো চলছেন কেরানীগঞ্জ থেকে আসা হোসনে আরা, তাঁর মেয়েরা, বোন, বোনের মেয়ে এবং প্রতিবেশী। হোসনে আরার মেয়ে জুলি আক্তার আর তাঁর বোনেরা খুঁজে ফিরছেন এমন একটা কাপড়, যেটা দিয়ে বানানো যায় গাউনের মতো কোনো পোশাক। কাঙ্ক্ষিত সেই কাপড়ের স্যাম্পলও নামিয়েছেন নেট ঘেঁটে। এখন খুঁজে ফিরছেন সেই কাপড়।

নবাবপুরের পথ গোছালো না হলেও মার্কেটগুলো বিন্যস্ত। অন্তত কোন বাজারে কী পাওয়া যায়, এটা নিশ্চিত। কোনো মার্কেটে শুধু জামার কাপড় পাওয়া যায়, কোনোটায় প্যান্টের কাপড়। কিছু মার্কেটে পর্দা, বিছানার চাদর। পা রাখার জায়গা নেই কোনোটিতেই। সবখানেই লেগেছে ঈদের ধুম।

বাজার ঘুরতে ঘুরতে পাওয়া যায় নানান ধরনের ক্রেতা। তাঁদের প্রায় সবাই নারী। তবে সবাই শুধু ঈদের পোশাক কিনতে আসেননি, অনেকেই এসেছেন পোশাক পাইকারি কিনে খুচরাতে বিক্রি করতে। এমনই একজন জানালেন তার একটি শো রুম আছে মিরপুরে। এ ছাড়াও অনলাইনেও পোশাক বিক্রি করেন তিনি। সেই সব পোশাক কিনতে আসেন নবাবপুরে। বললেন, আমি প্রতি সপ্তাহেই এই বাজারে আসি আর যা কিনে নিই সব বিক্রি হয়ে যায়। তাই ফিরে আবার আসতে হয় এখানেই।

নবাবপুরে বাজারে কেনাবেচায় ব্যস্ত ক্রেতা-বিক্রেতারা। ছবি: প্রথম আলো
নবাবপুরে বাজারে কেনাবেচায় ব্যস্ত ক্রেতা-বিক্রেতারা। ছবি: প্রথম আলো

নবাবপুরের কাপড়ের বাজারটা আসলে একটা বাজার না, এটা একটা সাম্রাজ্য। এখানে এলে হারিয়ে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক। এমনই দাবি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সেতুর। তিনি বলেন, আমি একটা কামিজ খুঁজতে এসেছি কিন্তু মার্কেটটা এত বড় যে আমি খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছি কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু পাচ্ছি না।

বাজারে ঘুরতে ঘুরতে আবার দেখা হয়ে যায় হোসনে আরা ও তাঁর মেয়েদের সঙ্গে। সারা বাজার ঘুরে তাঁরা একটি মাত্র দোকানে খুঁজে পেয়েছেন ইন্টারনেট ঘেঁটে নামানো সেই কাঙ্ক্ষিত কাপড়। এরপর শুরু হয় দরাদরি। দোকানিরা দাবি, এটা পাইকারি মার্কেট, দাম এমনিতেই কম। জুলিও ছাড়ার পাত্রী নন। শেষে অনেক দর-কষাকষির পরে ঠিক হয়, প্রতি গজ কাজ করা লেসের কাপড় ৬২৫ টাকা গজে ১২ গজ কাপড় কেনা হবে।

কাপড় বাঁধা হয় পাটের সুতলি দিয়ে। এখন কাপড়ের দর্জিবাড়ি যাওয়ার পালা। তারপর শুধু ঈদের দিনের অপেক্ষা—যেদিন ঝলমলে পোশাক পরে চমকে দেওয়া যাবে সবাইকে। সেই দিনেই তো আজকের দিনের কষ্ট সফল হবে।