সন্তানের জন্য সময় আছে তো?

নিজের পেশা, সংসারের কাজ—সবকিছুর পরেও সন্তানকে সময় দিচ্ছেন তো? ছবি: অধুনা
নিজের পেশা, সংসারের কাজ—সবকিছুর পরেও সন্তানকে সময় দিচ্ছেন তো? ছবি: অধুনা

ঘুমপাড়ানি মাসি-পিসি গান কিংবা ঠাকুরমার ঝুলির গল্প শুনিয়ে শেষ কবে সন্তানকে ঘুম পাড়িয়েছেন? একসঙ্গে বসে আনন্দ-আড্ডায় মেতে ওঠার সময় কি আপনার আছে? কর্মজীবী মা–বাবাদের পক্ষে সন্তানদের জন্য অনেক সময় আলাদা করে সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। নিজেদের অজান্তেই সন্তানের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত দূরত্ব। এই ক্ষতিকর দূরত্ব দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলছে সন্তানের মানসিক গঠন ও গড়নে। সারা দিনের ব্যস্ততার মধ্যে কীভাবে সন্তানকে সময় দেবেন, বুঝতে পারছেন না।

সকাল শুরু হোক সন্তানের সঙ্গে

দৈনন্দিন ব্যস্ততা থাকবেই। সকাল থেকে শুরু হয় আপনার অফিস, সন্তানের স্কুল ইত্যাদি নানা কাজ। কিন্তু যত ব্যস্ততাই থাকুক, চেষ্টা করুন সন্তানের সঙ্গে সকালের নাশতা করতে। নাশতার টেবিলে সন্তানের সঙ্গে গল্প করুন। খেতে খেতেই জেনে নিন তার জমানো কথাবার্তা, স্কুলবন্ধু কিংবা তার প্রিয় কোনো কার্টুন নিয়ে ভাবনা। প্রতিদিন নিয়ম করে এই খাবার-আড্ডার পর্ব আপনার সন্তানের ভালো লাগবে। আপনিও পাবেন চমৎকার আনন্দের অনুভূতি। সময়ের তাড়াহুড়ো একটু কম থাকলে মাঝেমধ্যে সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে আসুন খানিকটা। দেখবেন আপনার সন্তানের কাছে উপভোগ্য সময় হয়ে উঠবে সকাল। বললেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার।

কাজের অবসরে খোঁজ নিন

কাজের মধ্যে পরিস্থিতি অনুসারে ফোন করে কিংবা অন্য কোনোভাবে সন্তানের খোঁজখবর জানুন। সারাক্ষণ সন্তানকে দেখাশোনার মানুষ থাকতে পারে। সে কারণে নিজেকে নির্ভার মনে করবেন না। বরং আপনার কণ্ঠস্বর সন্তানের জন্য স্বস্তির হতে পারে। এই নির্ভরতার জায়গা হিসেবে নিজেকে তৈরি করে নিন। ব্যস্ততার মধ্যে ছোট্ট একটু অবসর বের করা তেমন কষ্টকর হবে না।

ঘরের কাজে সন্তানকে সঙ্গে নিন

বাইরে থেকে ফিরে ক্লান্তি নিয়েই আপনাকে ঘরের কাজকর্ম সারতে হয়। তখন সন্তান বাসায় থাকলে তাকে সঙ্গে নিন। টুকটাক কথা বলতে বলতে কাজ করুন। ছোটখাটো কাজগুলোর দায়িত্ব তাকে দিন। আপনার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে নিজের কাজের অভ্যাস তৈরি হবে। দুজনের একসঙ্গে একটু সময়ও কাটবে।

বিকেলের নাশতার সময়কে হিসাবে রাখুন

বিকেল কিংবা সন্ধ্যায় হালকা নাশতা কিংবা চায়ের চল আছে প্রায় পরিবারে। আপনার বাসায় এই সময়কে কাজে লাগাতে পারেন। পরিবারের সবাই মিলে একসঙ্গে বসে নাশতা করুন। আড্ডা-খুনসুটি, গল্প করে কাটিয়ে দিন মুহূর্তটা। সন্তানকে সুযোগ দিন। তার কথা শুনুন। মতামত জানতে চান। তার কাছে যেন মনে হয়, তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এই মনোভাবটুকু সন্তানকে মানসিকভাবে সতেজ রাখবে।

পড়ার সময় সম্ভব হলে সঙ্গ দিন

আজকাল পড়াশোনার চাপে শিক্ষার্থীরা বেহাল। হোমওয়ার্ক আর নানান টিউশনের ব্যস্ততায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে তারা। আপনার সন্তানের এমন হচ্ছে কি না, লক্ষ রাখুন। তার হোমওয়ার্ক কিংবা ব্যক্তিগত পড়াশোনার সময় সম্ভব হলে সঙ্গ দিতে পারেন। তবে খেয়াল রাখুন যাতে তার বিরক্তি তৈরি না হয়।

রাতের খাবার একসঙ্গে খেতে ভুলবেন না

পরিবারের সবাই একসঙ্গে নির্ধারিত সময়ে রাতের খাবার খেতে চেষ্টা করুন। সেটা সম্ভব না হলে অন্তত সন্তানের জন্য সেই সময়টুকু বরাদ্দ রাখুন। নাশতার টেবিলের মতো রাতের খাবারের সময়ও সন্তানের সঙ্গে গল্প করুন। সারা দিন কেমন কাটল তার, কী কী হলো, নতুন কিছু ঘটল কি না ইত্যাদি জেনে নিন। সন্তানকে কোয়ালিটি টাইম দেওয়ার ক্ষেত্রে তার বন্ধু হয়ে ওঠার বিকল্প নেই।

রাতে ঘুম পাড়িয়ে আসার চেষ্টা করুন

শৈশবে মা-বাবা, দাদু-ফুপির কাছে গল্প শুনে আমরা ঘুমাতাম। রূপকথা রাজকন্য-রাজপুত্র, চাঁদের বুড়ি কিংবা ঠাকুমার ঝুলি ছিল আমাদের খুব প্রিয়। ঘুমের রাজ্যে আমরাও তখন হয়ে উঠতাম রূপকথার কোনো চরিত্র। আপনার সন্তান কি সেই আনন্দ পাচ্ছে? রাতে বিছানায় শুয়ে সন্তানকে গল্প শোনান। রূপকথা না হোক, অন্য কোনো গল্প হতে পারে। নিজের শৈশবের কথা, পুরোনো দিনের মানুষের কথা কিংবা হাল আমলে অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম–এর কাহিনিও হতে পারে। ঘুমিয়ে পড়ার আগে যেন সন্তান আপনার স্পর্শ পায়। এই ছোট্ট সময়টুকু সন্তানের জন্য মূল্যবান রসদ হয়ে ওঠবে। দৃঢ় হবে আপনাদের পারস্পরিক বন্ধন।

ছুটির দিনে একসঙ্গে

সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে বের হোন। সময়ের সীমাবদ্ধতা থাকলে কাছে কোথাও ঘুরে আসুন। সন্তানের প্রিয় খাবার খেতে পারেন একসঙ্গে। দেখতে পারেন প্রিয় কোনো সিনেমা। সারা দিন একসঙ্গে থাকুন। নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব দূর করে ঝালিয়ে নিন পারস্পরিক আন্তরিকতার সম্পর্ক।

জীবনে ব্যস্ততা, প্রতিদিনের নানা ঝামেলা ইত্যাদি থাকে। তার মধ্যেও যত্ন করে সন্তানের জন্য তুলে রাখুন কিছু চমৎকার মুহূর্ত। প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদনে সন্তান অভ্যস্ত না হোক, খানিকটা মানবিক আর আন্তরিক থাকুক আপনার সন্তান। ঘরে ফেরা তার জন্য আনন্দ আর স্বস্তির হোক।

গ্রন্থনা: হাফিজুল ইসলাম