তারুণ্য কীভাবে ধরে রাখবেন

অভিনেত্রী শম্পা রেজা মনে করেন, তারুণ্য ধরে রাখার আসল বিষয় হলো শরীর সুস্থ রাখা আর মনকে আনন্দে রাখা। ছবি: সুমন ইউসুফ
অভিনেত্রী শম্পা রেজা মনে করেন, তারুণ্য ধরে রাখার আসল বিষয় হলো শরীর সুস্থ রাখা আর মনকে আনন্দে রাখা। ছবি: সুমন ইউসুফ
>

প্রাকৃতিক নিয়মে মানুষের বয়স বাড়ে। সেই বেশি বয়সেরও আলাদা একটা সৌন্দর্য রয়েছে। বেশি বয়সেও তারুণ্য ধরে রাখার মূল ব্যাপার হলো শরীর সুস্থ রাখা আর মনকে আনন্দে রাখা। লিখেছেন চিকিৎসক তানজিনা হোসেন।

বয়সেরও একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। তারুণ্য পেরিয়ে যাওয়ার পর বয়সের সঙ্গে আমাদের সৌন্দর্যের মাত্রায় যুক্ত হয় আরও অনেক কিছু। যেমন: আত্মবিশ্বাস, ম্যাচিউরিটি, আভিজাত্য। বয়সের সঙ্গে পূর্ণতা আসে অবয়ব ও সৌষ্ঠবে। আমরা আরও পরিণত হই। আরও সুন্দর হতে থাকি। উদাহরণ দেওয়া যাক। স্মরণকালের সেরা সুন্দরী অড্রে হেপবার্ন। বয়স তাঁর চিরকালের ছেলেমানুষি সৌন্দর্যে এনে দিয়েছিল পরিপূর্ণতা, আভিজাত্য আর আত্মবিশ্বাস। বয়সকালে নানা ধরনের সামাজিক ও সেবামূলক কাজকর্মে তাঁর আত্মনিয়োগ সেই সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল।

একই কথা খাটে অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, টাবু বা অরুন্ধতী রায়ের বেলায়। বয়স যত বাড়ছে, তাঁদের সৌন্দর্যের যেন আরও খোলতাই হচ্ছে। কিন্তু বয়সের সঙ্গে এই যে সৌন্দর্য ধরে রাখা (বা আমি বলব আরও পূর্ণতা পাওয়া) এবং আভিজাত্য যোগ করার রহস্যটা কি? না, নিয়মিত জিম করা, ক্যালরি মেপে খাওয়া বা নিয়ম করে পারলারে–সেলুনে যাওয়ার মধ্যেই শুধু এই রহস্য নিহিত নেই, এটা আসলে একটা অ্যাটিচিউড। জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি। এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই আপনার চিরতারুণ্য ধরে রাখতে জরুরি। আসুন দেখা যাক, কীভাবে আমরা এই অ্যাটিচিউড তৈরি করতে পারি।

খাব ভালো, থাকব ভালো

বয়স যে বাড়ছে তাকে অস্বীকার করবেন না। বরং মেনে নিন যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে বাসা বাঁধতে চেষ্টা করবে নানা রোগবালাই, পেটে জমতে চাইবে চর্বি, রক্তে বেড়ে যেতে চাইবে শর্করা বা কোলেস্টেরল। তাই সত্যটা মেনে নিয়েই জীবনে শৃঙ্খলা আনুন। সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিন খাদ্যাভ্যাসে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যই খাওয়া, খাওয়ার জন্য বেঁচে থাকা নয়। তাই ওজন উচ্চতা অনুযায়ী নিজের কর্ম উপযোগী খাদ্যতালিকা তৈরি করে নিন। শর্করা ও চর্বিজাতীয় খাবার কমিয়ে ফেলে আমিষ, আঁশ, তাজা শাকসবজি ও ফলমূলজাতীয় খাবার বেশি করে খান। খাবারের ব্যাপারে টাইমটেবিল মেনে চলুন কঠোরভাবে। বয়সজনিত হাড়সন্ধির সমস্যা ঠেকাতে নিয়মিত খাবেন দুধ, দই, পনিরজাতীয় খাবার। মাছ, বেশি করে সামুদ্রিক মাছ সপ্তাহে অন্তত দুদিন। স্ন্যাকস বলতে বাদাম, ফল, দই ইত্যাদি। প্রচুর পানি পান করুন। ছেড়ে দিন কোমল পানীয়, উচ্চ ক্যালরিযুক্ত ডেজার্ট, ফাস্ট ফুড, ভাজাপোড়া খাবার। এগুলো কোনো জরুরি জিনিস নয় জীবনের জন্য।

চাই ফিটনেস, তাই ব্যায়াম

ব্যায়াম বা খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা শৈশব থেকেই। তা পেশা বা সংসার গোছাতে গিয়ে আগে শুরু না করা হলে ক্ষতি নেই। সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট হাঁটুন বা ব্যায়াম করুন। বাইরে যাওয়ার সময় না হলে বাড়িতে ট্রেডমিল ব্যবহার করুন বা খালি হাতের ব্যায়াম করুন। দরকার হলে সপ্তাহে এক দুদিন বা ছুটির দিনে ইয়োগা বা সাঁতার কাটুন। কেবল ওজন বা ফিটনেস ঠিক রাখতেই নয়, এই ব্যায়াম আপনাকে বাড়তি এনার্জি জোগাবে, স্টামিনা এনে দেবে, দূর করে দেবে অবসাদ। কাজের স্পৃহা বাড়াবে। এমনকি বিষণ্নতা কাটাতে সাহায্য করবে।

বিশ্রাম দরকার, ঘুমও

পরিণত বয়সে দায়িত্ব বাড়ে। কর্মক্ষেত্রে বা বাড়িতে ব্যস্ততাও বাড়ে। বাড়ে চাপ—স্ট্রেস। চারদিক সামলে চলতে হয় মেয়েদের। তারপরও দিনে অন্তত ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম বা ঘুম দরকার। যত কাজের চাপই থাকুক, রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবেন না। গবেষণা বলছে রাত জাগার সঙ্গে ঝুঁকি বাড়ে স্থূলতা, হৃদ্‌রোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগের। রাত জাগলে আপনার কর্মস্পৃহা যাবে কমে, কাজে মনোনিবেশ করতে পারবেন না। রাত দশটার মধ্যে বিছানায় যান, ভোর থাকতে উঠে কাজ শুরু করুন। ঘুমের সময় কম্পিউটার, মুঠোফোন, টেলিভিশন বা কোনো ধরনের স্ক্রিন ব্যবহার করবেন না।

ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তারুণ্য ধরে রাখতে পারে
ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তারুণ্য ধরে রাখতে পারে


নিয়মিত চেকআপ দরকার

আগেই বলেছি বয়সকে অস্বীকার করে লাভ নেই। চল্লিশের পর থেকে যত রোগবালাইয়ের আক্রমণ শুরু। কে কখন শরীরে বাসা বাঁধে ঠিক নেই। তাই বলে আমরা শরীরকে পর্যুদস্ত করতে দেব কেন? তাই প্রতিবছর অন্তত একবার নিজের চেকআপ করিয়ে নিন। রক্তে শর্করা, লিপিড প্রোফাইল, হিমোগ্লোবিন, থাইরয়েড হরমোন, রক্তচাপ ইত্যাদি পরীক্ষা করা চাই। চাই চোখ ও দাঁতের পরীক্ষা। শরীরটাকে ভালোবাসুন। এর যত্ন নিন। যত্ন নিন ত্বকের, চুলের, পায়ের, চোখের—সবকিছুর। কোনো সমস্যা ধরা পড়লে তাকে গ্রহণ করে নিন, আর সঠিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা নিন। রোগবালাই তো থাকবেই, এর সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে জীবনে।

চাই নিজের জন্য একটুখানি সময়

মানসিক চাপ ও স্ট্রেস কমাতে নিজেকে সময় দিন। হয়তো চাকরি-বাকরি, ব্যবসা, অফিস, সংসার, ছেলেমেয়ে নিয়ে হাঁসফাঁস অবস্থা, তবু নিজের জন্য আনন্দময় সময় বের করুন। বন্ধুদের ভুলে যাবেন না। পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে এক সন্ধের আড্ডা সারা মাসের ক্লান্তি ধুয়েমুছে দেবে। নিজের প্রিয় কাজগুলোকে (যেমন: বই পড়া, সিনেমা দেখা, বাগান করা বা গান শোনা) গুরুত্ব দিন। বয়স হয়েছে বলে আকাশ, প্রজাপতি, কৃষ্ণচূড়া বা জ্যোৎস্না ভালোবাসা নিষেধ তা কে বলল? মাঝেমধ্যে ছুটি নিন। প্রিয়জনদের নিয়ে বা স্রেফ একাই বেড়িয়ে আসুন কোথাও থেকে। পাহাড়, সমুদ্র আমাদের জীবনকে নতুন করে ভালোবাসতে শেখায়। ওই যে বলছিলাম, জীবনকে ভালোবাসাই একটা ইতিবাচক অ্যাটিচিউড, একটা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। আর এটাই সৌন্দর্য আর ফিটনেসের আসল রহস্য। আর কিছু নয়।

লেখক: চিকিৎসক