চিপা গলির ঈদ

আজ থেকে চার শ বছরেরও বেশি আগে মোগলদের হাতে ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন। সুদীর্ঘ সময়ে এর আয়তন বেড়েছে কয়েক গুণ। তবে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত মুঘল আমলের ঢাকাই বর্তমানে ‘পুরান ঢাকা’ হিসেবে পরিচিত। এই ঢাকা গড়ে উঠেছে অসংখ্য ‘মহল্লা’ নিয়ে। এগুলোকে শহরের এক একটি ‘গ্রাম’ বলা যেতে পারে! মহল্লাগুলোর বেশির ভাগের নামের সঙ্গে জুড়ে আছে বাজার শব্দটি, আর সেগুলো সরু সরু অলি-গলি দিয়ে সংযুক্ত বলে ঢাকাকে বলা হয় বায়ান্ন বাজার আর তিপান্ন গলির শহর।

ঐতিহাসিক কারণেই পুরান ঢাকার জীবনযাপন থেকে শুরু করে খাবার-দাবার আর ঈদ উৎসবের মধ্যে মোগলদের প্রভাব এখনো রয়ে গেছে। এখানে ঈদুল ফিতরকে ‘রোজার ঈদ’ নামে ডাকা হয়। প্রায় মাসখানেক রোজা শেষে যখন আকাশে ঈদের চাঁদ ওঠে, তখন শুরু হয়ে যায় ‘চাঁন রাইত!’ কান পাতলে হয়তো আজও শোনা যাবে, অল্পবয়সী কেউ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলছে: ‘আমাগো ছাদেও চাঁন উঠছে!’ এই ‘চাঁন রাইত’ও কম আনন্দঘন নয় কিন্তু। আর এটা বোঝা যায় এখানকার আদি মানুষজনের বুলিতেও। খুশির আতিশয্য বোঝাতে প্রায়শই বলা হয়ে থাকে, ‘চাঁন রাইতের মতো খুশি!’

ঈদের আগের দিন এই চাঁন রাইত মূল উৎসবের প্রস্তুতিতে কেটে যায়। মেয়েরা মেহেদি দেওয়ার আয়োজন করে। কয়েক যুগ আগে থেকেই পাটা-পুতায় মেহেদি বাটার চল লুপ্ত হয়েছে, নির্ঝঞ্ছাট টিউবের মেহেদির রাজত্বই এখন সবখানে। এ দিন প্রায় সব বয়সের পুরুষেরা ছোটে পাঞ্জাবি-পায়জামা আর আঁতর-টুপি কেনার জন্য। শেষবেলার এই কেনাকাটা এক রকম রীতিতে পরিণত হয়েছে। এখানকার অধিবাসীদের বেশির ভাগের পেশাই ব্যবসা, ফলে রোজার মাসটা তারা ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই ব্যস্ত থাকে বলে খুব কম মানুষই আগেভাগে নিজের কেনাকাটা সারতে পারে। ঈদের আগে ঢাকার বেশির ভাগ এলাকা ফাঁকা হয়ে গেলেও পুরান ঢাকায় এর প্রভাব কিছুটা কম পড়ে। ঈদের আগের দিন গভীর রাত পর্যন্ত মহল্লাগুলো থাকে বেশ সরগরম।

ঈদের দিন সকালে ছোটবড়, ধনী-গরিব প্রায় সবাই জামাতে নামাজ পড়ার চেষ্টা করে, ফলে অসংখ্য মসজিদের থাকা সত্ত্বেও স্থান সংকুলান হয় না, মসজিদের বাইরে, রাস্তার ওপরে শতরঞ্জি বিছিয়ে জামাত অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ শেষে কোলাকুলি করা ঈদ উৎসবের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এরপরই পুরান ঢাকার বাসিন্দারা ছোটে তাদের মৃত দাদা-দাদি, নানা-নানি, মা-বাবা কিংবা নিকটাত্মীয়ের কবর জিয়ারত করতে। ঈদ উৎসবের দিনেও এখানকার বাসিন্দারা মৃত স্বজনদের কথা স্মরণ করে। বিভিন্ন মহল্লার পঞ্চায়েতের রয়েছে শত বছরের পুরান নিজস্ব গোরস্থান।

উৎসবের দিন বলেই ঈদের সকালে নাশতার ‘মেনু’ দখল করে নেয় সুস্বাদু সব খাবার-দাবার। খিচুড়ি আর গরু-খাসি-মুরগির মাংসের সঙ্গে বিভিন্ন পদের সেমাই, জর্দা, ফিরনি খাওয়া হয়। আধুনিক কালে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোল্ড ড্রিংকস, আইসক্রিম আর পুডিং। হরেক রকমের কোর্মা-পোলাওয়ের রান্না করে বাড়ির মহিলারা, তবে সেগুলো দুপুর আর রাতেই বেশি খাওয়া হয়, আর অবশ্যই দুই-তিন দিন ধরে চলে এসব খানাপিনা।

সব দিক থেকে দেখলে ছোটরাই এই দিন বেশি লাভবান হয়। নতুন জামা পরার আনন্দ তো থাকেই, সেই সঙ্গে বড়দের কাছ থেকে নগদ টাকার ‘সেলামি,’ তথা ঈদি পাওয়াটা তাদের এই আনন্দকে নিঃসন্দেহে অনেক বাড়িয়ে তোলে।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, পুরান ঢাকায় আগে জন্মাষ্টমী এবং ঈদের মিছিল হতো; চকবাজার, আরমানিটোলায় পুরান বিভিন্ন জায়গায় বসতো ঈদের মেলা। সেই মেলার রূপ ছিল অনেকটাই গ্রাম্য মেলার মতো। নাগর দোলা, চড়ক গাছের পাশাপাশি, মাটির হাঁড়ি-পাতিল, পুতুল, খেলনা, বাঁশি আর বাদ্যযন্ত্র থেকে শুরু করে মিষ্টিজাতীয় নানান ধরনের খাবার বিক্রি করা হতো। সেই ঐতিহ্য হারিয়ে গেলেও কয়েক বছর ধরে নতুন করে আবার মিছিল এবং মেলার আয়োজন করার চেষ্টা করা হচ্ছে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে। তবে এখনো চোখে পড়বে রাস্তার পাশে শামিয়ানা টাঙিয়ে, চেয়ার বিছিয়ে চড়া ভলিউমে গান শুনছে আর আড্ডা দিচ্ছে উঠতি বয়সী ছেলেপেলেরা। অপেক্ষাকৃত বড়রা মহল্লার বিভিন্ন জায়গায় চেয়ার পেতে আড্ডা দিয়ে থাকে। আগে এ রকম আড্ডা দেওয়ার সুবিধার্থে রাস্তার পাশের অনেক বাড়ির সামনেই এক চিলতে জায়গা রেখে দিতে বসার জন্য, এখন সে সব একেবারেই নেই।

এক কালে ঈদের দিন ঘুড়ি ওড়ানো, হিজড়া নাচসহ খেলাধুলার আয়োজন করা হলেও বর্তমানে এসব দেখা যায় না। মানুষজন এখন বিনোদনের জন্য বেছে নিয়েছে নিজেদের বাড়ির ছাদগুলোকেই। সন্ধ্যার পর ছাদে ছাদে ডিজে শো করার প্রবণতা দিনকে দিন বাড়ছে। অনেকেই সিনেমা হল আর ফাস্ট ফুডের দোকানকে বেছে নেয় সময় বিনোদনের জন্য।

বর্তমানে পুরান ঢাকার অলিগলিতেও অ্যাপার্টমেন্ট কালচার ঢুকে পড়েছে, ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে মহল্লা সংস্কৃতি। তারপরও কিছু কিছু পুরান ঐতিহ্য এখনো বেঁচেবর্তে আছে এখানে। সম্ভবত এই অঞ্চলকে পুরান ঢাকা বলার এটিও একটি কারণ।