আমের জাতপাত

লখনা
লখনা

এখন ফলের বাজারে গেলে যেন আমের ঘ্রাণ পাগল করে। বাজারে থরে থরে সাজানো পাকা আম। কিন্তু কিনতে গেলেই অনেকের মনে খটকা লাগে, এত আমের মধ্যে আসলে কিনব কোন আম? কোনটা বেশি স্বাদের হবে—মিষ্টি রসের গোলায় মুখ ভরে যাবে?

িসন্দুরি। ছবি: লেখক
িসন্দুরি। ছবি: লেখক

আবার সন্দেহ জাগে, এগুলো খাঁটি আম তো? মানে কোনো রাসায়নিক দিয়ে আম দূষিত করা হয়েছে কি না? ফল খেলে বল বাড়ে সত্য, কিন্তু কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো এসব আম খেলে মনে হয়, এই বুঝি রসাতলে যেতে হবে।

হাঁড়িভাঙা
হাঁড়িভাঙা

আমের আসল স্বাদটাই যেন কেমিক্যালে পাকা আমে খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশেষ ক‌রে যদি আম পাকানোর জন্য কোনো রাসায়নিক বা রাইপেনিং হরমোন ব্যবহার করা হয়। এত সব চিন্তা করতে করতে কারও কারও হয়তো আর আম কেনার সাহসই হয় না। কিংবা সাহস করে কিনলেও সেই পাকা আম খেয়ে রসনার তৃপ্তি মেটে না। তাই বলে কি আমের মৌসুমে আম খাব না? দরদাম যা–ই হোক, খেতে চাই নিরাপদ আম। কীভাবে মিলবে তা? আসলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া সঠিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে না যে আম কিনছি, তা সম্পূর্ণ রাসায়নিকমুক্ত কি না। তবে কেনার আগে বা কেনার সময় কিছু বিষয় জানা থাকলে ও আম চিনলে ঝুঁকিমুক্ত নিরাপদ আম কেনায় তা কিছুটা সাহায্য করতে পারে। 

হাজার জাতের আম

সূর্যপুরি
সূর্যপুরি

বাংলাদেশে যত রকমের আম হয়, কারও প‌ক্ষেই তার সব চেনা সম্ভব নয়। এ দেশে একসময় দেশি জাতের প্রচুর আম ছিল। একসময় গবেষকেরা ভারতীয় উপমহাদেশে আমের প্রায় ১ হাজার ৬৫০টি জাতের একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন বলে জানা যায়। এ দেশে আমের সেই বৈচিত্র্যভরা ভুবনে এখনো রয়েছে হাজারখানেক জাতের আম। ঢাকায় কয়েক দিন আগে শেষ হওয়া জাতীয় ফল প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছিল আমের ৭৫টি জাত। প্রতিটি জাতের আমের চেহারা, রং, রূপ, ঘ্রাণ, স্বাদ, মিষ্টতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য আলাদা। এখনো চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় গেলে অনেক স্থানীয় জাতের আমের দেখা পাওয়া যায়। ভোলাহাট ও গোমস্তাপুরেও আছে অনেক জাতের দেশি আম। ক্ষীরভোগ, মোহনভোগ, রাজভোগ, রানিভোগ, রানিপছন্দ, সিন্দুরা, সুবর্ণরেখা, কুয়াপাহাড়ি, নাক ফজলি, ফজলি, চিনি ফজলি, সুরমাই ফজলি, চিনি মিছরি, জগৎমোহিনী, রাখালভোগ, রাঙ্গাগুড়ি, গোবিন্দভোগ, তোতাপুরি, মিশ্রিকান্ত, জালিবান্ধা, বোম্বাই, ভুতো বোম্বাই, পাহাড়িয়া, গোলাপখাস, কাকাতুয়া, দাদভোগ, চম্পা, সূর্যপুরি, কাঁচামিঠা, কলামোচা, শীতলপাটি, লক্ষ্মণভোগ, গোলাপবাস, কিষাণভোগ, বান্দিগুড়ি, কুয়াপাহারী, রাংগোয়াই, আশ্বিনা, ভাদুরিগুটি, বনখাসা বউ ফুসলানি, ক্ষীরমন, দুধসর, রঙভিলা, পারিজা, আনোয়ারা, দিলশাদ, আম্রপালি, মল্লিকা, বেগমবাহার, পূজারিভোগ, পলকপুরি, রাজলক্ষ্মী, দুধকুমারী, শ্যামলতা, খাট্টাশে, জাওনা, দমমিছরি, মিছরি মালা, মিছরিবসন্ত, মেসোভুলানী, আনোয়ারা, ফুনিয়া, গোলাপবাস, বাতাসাভোগ, ইটাকালি, গোল্লাছুট, পোল্লাদাগী, মোহনবাঁশি, পরানভোগ, বিড়া, ভারতী, বাদশাপছন্দ, বেগমপছন্দ, রাজাপছন্দ, বনখাসা, বাগানপল্লি, কালিগুটি, পাকচারা, কালিয়াভোগ, দুধসর, কোহিতুর, কালিগুলি, হাঁড়িভাঙা, বালিশা ইত্যাদি জাতের আম এখনো দেখা যায়।

আধুনিক ও বিদেশি জাতের আম

দেশি জাতের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে অনেক আধুনিক ও বিদেশি জাতের আম। কিন্তু সত্যি বলতে কি, দেশি বা স্থানীয় সেসব জাতের স্বাদই ছিল অন্য রকম। আজকাল তো টক বা চুকা আম খুঁজেই পাওয়া যায় না—সবই প্রায় মিষ্টি আর আঁশবিহীন। আগে যে দেশি ল্যাংড়া আম ছিল, তা দিয়ে দুধভাত খেলে অনেকক্ষণ সেই আমের ঘ্রাণ হাতে লেগে থাকত। এখন বড় বড় আধুনিক ল্যাংড়া জাতের আম থেকে আর সেরূপ সুমিষ্ট ঘ্রাণ তীব্রভাবে পাওয়া যায় না। তেমনি খুদি ক্ষীরশা ও ক্ষীরশা বা ক্ষীরশাপাতি আমের বেলায়ও। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী অঞ্চলে এ আম ক্ষীরশাপাতি নামে পরিচিত হলেও আসলে তা হিমসাগর জাতেরই একটি প্রকার। মিষ্টতা ও স্বাদে হিমসাগর বা ক্ষীরশাপাতি জাতের মতো জনপ্রিয়তা আর কোনো আমের নেই।

ব্রুনাই িকং
ব্রুনাই িকং

কোন আম কখন আসে

মৌসুমে সবার আগে দেখা যায় গোপালভোগ জাতের আম। গোপালভোগ আম মাঝারি আকারের, পাকা আমের রং হলুদাভ সবুজ, পাকলে খোসা পুরোপুরি হলুদ হয় না, আঁটি পাতলা, আঁশ নেই ও মিষ্টি। তারপর ওঠে হিমসাগর বা ক্ষীরশাপাতি আম। এ জাতের আমও পাকলে হলুদাভ সবুজ হয়, কখনো কখনো ময়লা হলুদ হয়, মাঝারি আকারের, কমলা শাঁস, খুব মিষ্টি, সুঘ্রাণযুক্ত ও সুস্বাদু। এটাই মনে হয় সেরা আম। ক্ষীরশাপাতি আমের আসল জায়গা হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ। এরপর ল্যাংড়া। ল্যাংড়া আম অনেকটা আয়তাকার গোল, হালকা সবুজ রঙের খোসা, পাকলেও হলুদ হয় না, খোসা পাতলা, হলুদ শাঁস, ভালোভাবে না পাকলে আম খেলে মুখ চুলকাতে পারে। সুঘ্রাণের সুখ্যাতি রয়েছে ল্যাংড়া আমের। এ সময় লক্ষ্মণভোগ বা লখনা আমও পাওয়া যায়। পাকলে এ জাতের আম উজ্জ্বল হলুদ হয়ে যায়, বোঁটার কাছে লালাভ রং ধরে। এ জন্য একে রঙিন আমও বলে। ঘ্রাণ ভালো। রাজশাহীতে পাওয়া যায় লখনা আম।

কাটিমন
কাটিমন

এরপর ওঠে হাঁড়িভাঙা আম—রংপুর অঞ্চলে এ জাতের আম পাওয়া যায়। ভরা মৌসুম শেষ হলেও গাছে ও বাজারে আরও কিছু জাতের আম থাকে। কিছুটা নাবি জাত হিসেবে ইতিমধ্যে আম্রপালি যেন আমের রানি হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ বলে রুপালি আম, আসলে আম্রপালি। আম্রপালি ছিল প্রাচীন ভারতের সেরা নর্তকী। তাই তাঁর সম্মানে সেরা জাতের এই আমের নাম রাখা হয়েছে আম্রপালি। আম্রপালি আমের খোসা মসৃণ বা তেলতেলে, ছোট থেকে মাঝারি আকারের আম, পাকা আম হলুদাভ সবুজ, অগ্রভাগ কিছুটা সরু, শাঁস কমলা ও অনেক মিষ্টি, পাকা আম্রপালি আম বেশ কয়েক দিন ঘরে রাখা যায়। সারা দেশেই আম্রপালি আম পাওয়া যায়। এখন পাহাড়ি অঞ্চলেও আম্রপালি ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। নাবি জাত হিসেবে ফজলি ও আশ্বিনা এখনো জনপ্রিয়। বলতে গেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জে যত আম হয়, তার অর্ধেকই আশ্বিনা। নাবি জাত আশ্বিনা কালচে সবুজ রঙের, ফজলি আম সবুজ রঙের। আশ্বিনা আমের স্বাদ টক-মিষ্টি, ফজলি টকগন্ধযুক্ত মিষ্টি স্বাদের বড় আম। এখন নাবি জাতের আম হিসেবে অনেকের কাছে প্রিয়। মাঝারি-বড় আকারের বারি আম-৪ জাত ও গৌরমতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ দুটি জাতের আমই সুমিষ্ট ও সুন্দর চেহারার। বছরে তিনবার ধরে, এমন জাত হিসেবে বারি আম–১১ ও থাইল্যান্ডের কাটিমন জাত চাষের প্রতি অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আশা করা যায়, কয়েক বছরের মধ্যে আমরা এ জাতের আমও বাজার থেকে কিনতে পারব। ছোট-বড় নানা আকার-আকৃতির আম রয়েছে এ দেশে। পাকা কাটিমন হলুদ সুঘ্রাণযুক্ত মিষ্টি। এ দেশের সবচেয়ে বড় জাতের আমগুলো হলো ব্রুনাই কিং, বালিশা, আরাজান, বোম্বাই ফজলি ইত্যাদি। ব্রুনাই কিং আম লম্বাটে, মুখের দিকটা সরু, একটা আমের ওজন তিন-চার কেজি। ফজলি আমও বড়, একটা আমের ওজন এক থেকে দেড় কেজি হয়।

বালিশা
বালিশা

আমের দিনপঞ্জি

আম তো আম-ই, অতশত জাতপাত চেনার দরকার কী? দরকার এ জন্য যে সব জাতের আম একই সময়ে পাকে না। তাই জাতগুলো চেনা থাকলে ও কোন অঞ্চলে কোন জাতের আম কখন পাকে, তা জানা থাকলে জোর করে পাকানো আবাত্তি আম কিনে আমের আসল স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হবে না। গোপালভোগ আম পাকা শুরু হয় ২০ মে থেকে। বিশেষ করে নাটোর ও রাজশাহীতে এ সময় থেকে ভালো পাকা গোপালভোগ পাওয়া যায়। লক্ষ্মণভোগ ২৫ মে ও ক্ষীরশাপাতি আম পাকা শুরু হয় ২৮ মে থেকে। ৬ জুন থেকে পাকতে শুরু করে ল্যাংড়া। ফজলি, সুরমা ফজলি, চিনি ফজলি, নাক ফজলি ইত্যাদি জাত পাকা শুরু হয় ১৬ জুন থেকে। এরপর পাকে আম্রপালি, ২০ জুনের পর থেকে ভালো পাকা আম্রপালি আম পাওয়া যায়। আশ্বিনা আম পাকে ১ জুলাই থেকে। বিভিন্ন জাতের আম কেনার সময় পরিপক্বতার এই সময়গুলো খেয়াল রাখলে ভালো পাকা আম পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান জেলার পাহাড়ের আমবাগানে প্রধানত আম্রপালি ও রাংগোয়াই জাতের আম হয়। পাহাড়ে এসব জাতের আম একটু আগে পাকে। স্থান ও আবহাওয়ার কারণে কোনো কোনো জাতের আম পাকার সময় কিছুটা হেরফের হতে পারে।

বোম্বাই ফজলি
বোম্বাই ফজলি

যেসব আম রাসায়নিক বা কেমিক্যাল দিয়ে পাকানো হয়, সেসব আমের রং বদলে যায়, হরমোনের প্রভাবে খোসায় চমৎকার আকর্ষণীয় রং তৈরি হয়। সেসব টসটসে রং দেখে সহজে মন ভোলে, কিন্তু সেসব আমের প্রকৃত স্বাদ আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই যে জাতের পাকা আমের স্বাভাবিক যে রং হওয়া উচিত, তা দেখে আম কেনা উচিত। এ জন্য কিছুটা অভিজ্ঞতা থাকলে ভালো হয়। ওটা না থাকলে পরিচিত লোকজনের সাহায্যে আমের বাগান থেকে সরাসরি আম সংগ্রহ করে কুরিয়ারে বাসায় নিয়ে আসা যায়। 

সূর্য ডিম
সূর্য ডিম


কিনতে পারেন বাগান থেকেও
এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর আমবাগান থেকে অনেকেই আম কিনছেন। কিছুটা খোঁজখবর নিয়ে বিশ্বস্ত কোনো বাগান থেকে আম কিনতে পারলে দূষণের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে বর্তমানে ল্যাংড়া ও ক্ষীরশাপাতি আম বাগানে এবং বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। ২০ কেজি আম ঝুড়িতে প্যাকিং করতে খরচ ৬০ টাকা, কুরিয়ারে ঢাকায় আনতে খরচ কেজি প্রতি ১০ টাকা। অন্যান্য জেলাতেও আছে কুরিয়ার সার্ভিস। নিজেদের গাড়িতে এবং বিভিন্ন পরিবহনের বাসে করেও আম আনা যায়। নিজেরা চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমসফর দিয়ে সেখান থেকে দেখেশুনেও আম কিনে আনা যায়। তাহলে একসঙ্গে রথ দেখা আর কলা বেচা—দুটোই হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে আমের বা ফলের মেলা হয়, সেসব জায়গা থেকেও আম কেনা যেতে পারে।

লেখক: কৃষিবিদ