আমের দেশে আমের হাটে

সাইকেলে চড়ে আম আসে হাটে। ছবি: লেখক
সাইকেলে চড়ে আম আসে হাটে। ছবি: লেখক

প্রাচীনকালের কংসহট্ট পরবর্তী সময়ে কানসাট নাম ধারণ করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের রাজবাড়িকে বলা হয়ে থাকে কুঁজা রাজার বাড়ি। এই রাজার শতাধিক বছর বয়সী একটি আমবাগান রয়েছে। বিরাট বাগানটি ‘কানসাট রাজার বাগান’ নামেই পরিচিত। আমের মৌসুমে কানসাটের আরেক পরিচিতি ফুটে ওঠে দেশের বৃহত্তম আমবাজার হিসেবে। তাই আমের রাজ্যে বেড়াতে এসে কানসাট আমের বাজার দেখলেন না, তা কি কখনো হয়!

জেলা সদর থেকে মহানন্দা নদীর ওপর বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতু পাড়ি দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-সোনামসজিদ সড়ক ধরে যেতে হবে শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাটে। শিবগঞ্জ যেতে পথের দুই ধারে সারি সারি আমগাছ আপনাকে স্বাগত জানাবে। যেতে যেতেই চোখে পড়বে গাছে গাছে থোকায় থোকায় আম। হাতের নাগালে অনেক আম। এমনকি শুয়ে-বসেও ছোঁয়া যায় এসব আম। আমবাগানের এমন অপরূপ শোভা চোখ জুড়াবে আপনার। পথ চলতেই আরও চোখে পড়বে আমের ডালিবোঝাই বাইসাইকেল আর রিকশাভ্যানের সারি। সবাই ছুটছেন কানসাট আমবাজারের দিকে। দূরদূরান্ত থেকেও আসেন এসব রিকশাভ্যান ও সাইকেলওয়ালা। আসেন আশপাশের উপজেলাগুলো থেকেও। তাঁরা আগের দিন বিকেল থেকে আম পাড়েন গাছ থেকে। এরপর ডালি সাজান। রওনা দেন ভোরের আলো ফোটার আগেই। তবে আশপাশের বাগানগুলো থেকে খুব সকালে আম পেড়ে কানসাট বাজারে নিয়ে আসা হয়। সাইকেলের দুই চাকার মধ্যে চেইনকভারের ওপর বসানো পাটাতনের দুই পাশে বড় দুই ডালিতে পাঁচ মণ পর্যন্ত আম বহন করা হয়। দূরত্ব বিচারে নির্ধারিত হয় মজুরি। কানসাটের বাজারে আমের সরবরাহ এই সাইকেল ও রিকশাভ্যানওয়ালাদের ওপর নির্ভরশীল। 

খ্যাতে নাই খইলানে জড়ো

১৭ জুন কানসাট আমবাজারে গিয়ে দেখা যায়, বাজারে বিরাট এলাকাজুড়ে সারি সারি আমবোঝাই রিকশাভ্যান ও বাইসাইকেল। এসবের মধ্য দিয়েই এই গরমে গা ঘেঁষে চলাফেরা করতে হচ্ছে ক্রেতাদের। এখানকার আমচাষি ও আমের আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার আমের উত্পাদন গত বছরের তুলনায় অনেক কম। কারও মতে অর্ধেক, কারও মতে আরও কম। তবে আগে স্বীকার না করলে এখন পরিস্থিতি দেখে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জানালেন, এবারের উত্পাদন গত বছরের তুলনায় ৭০ শতাংশের বেশি নয়। এই হিসাব মানতে রাজি নন আমচাষিরা। তাঁদের বক্তব্য, টানা তিন বছর আমের দরপতনের কারণে পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব অসংখ্য আমচাষি ও ব্যবসায়ী আমবাগান পরিচর্যার জন্য ব্যয়বহুল ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। যাঁরা করেছেন, তাঁরাই কেবল ফলন পেয়েছেন। আবার আবহাওয়াও ছিল কিছুটা বৈরী। কিন্তু কানসাট গিয়ে আমের এত সমারোহ দেখে ফলন কমের বিষয়টি মোটেও বোঝার উপায় নেই। এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শ্যামপুর ইউনিয়নের ভবানীপুরের আমচাষি জালাল উদ্দীন বলেন, ‘হারঘ দ্যাশে একটা কথা চালু আছে, খ্যাতে নাই খইলানে (ফসল মাড়াইয়ের বড় উঠান) জড়ো। সে রকুমই হয়্যাছে এবারকার আমের অবস্থা। কানসাটের বাজারে আম দেখ্যা বুঝা যাইবে না ফলনের অবস্থা।’ 

আম বহনকারী সাইকেলওয়ালা

আমবাগান থেকে আম পেড়ে ডালি সাজিয়ে বাজারে বিক্রি পর্যন্ত কাজ করেন সাইকেলওয়ালারা। দূরত্বভেদে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা। সঙ্গে দুপুরে খাওয়া। কানসাট আমবাজারে কথা হয় তাঁদের মধ্যে মনাকষার গোপালনগরের ডালিম, সাহাপাড়ার তৌহিদুর রহমান, শ্যামপুর আজগুবির মিকাইল, ভবানীপুরের ইব্রাহিমসহ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, এ সময় শিবগঞ্জের শত শত সাইকেলওয়ালা আড়াই-তিন মাস কাজ করে অন্তত ছয় মাসের খোরাক জোগাড় করেন। এই বাজারে আম বিক্রির সময় কয়েকবার হাতবদল হয়। শেষ পর্যন্ত আমবোঝাই সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন তাঁরা। প্রতি হাত বদলে বাড়তি আয় হয় ১০০ টাকা করে। দু-তিন থেকে সর্বোচ্চ পাঁচবার হাতবদল হয়ে থাকে। 

সকালে কাঁচা, বিকেলে পাকা

কানসাটের আমের বাজারে সকালে বসে কাঁচা আমের বাজার। সকালের দিকে পাকা আমের খোঁজে হয়রান হলেও আপনি কোনো পাকা আম পাবেন না। তবে বিকেলে মিলবে নানা বর্ণ, গন্ধ ও স্বাদের রসাল সব আম৷ 

ছোট ‘মণ’ বড় ‘মণ’

কানসাট আমের বাজার ও আড়তগুলোতে কাঁচা আম বিক্রির ক্ষেত্রে মণ ধরা হয় ৪৬ থেকে ৪৮ কেজিতে। বহু বছর থেকেই এ ব্যবস্থা চলে আসছে। জেলা প্রশাসন আমচাষিদের কাছ থেকে ৪০ কেজিতে মণ ধরে আম কেনার সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু বাইরে থেকে আসা আমের ব্যাপারীরা ৪৬ থেকে ৪৮ কেজিতে মণ দরে আম কিনতে অভ্যস্ত হওয়ায় তাঁরা কানসাটের বাজারে না এসে অন্য বাজারে চলে যাচ্ছেন। এতে কানসাটের আমের ব্যবসা ক্ষতির মুখে পড়ছে। এ অভিযোগে তাঁরা গত রোববার আম বেচাকেনা বন্ধ রাখেন। সেদিন বাজারে আম নিয়ে এসে ভোগান্তির মধ্যে পড়েন। পরে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার আম ব্যবসায়ীদের বৈঠকের মধ্যে সমঝোতা হয় যে আগের নিয়মেই বেচাকেনা হবে। তবে পাকা আমের ক্ষেত্রে এ মণ ছোট। অর্থাৎ ৪৩ কেজিতে মণ ধরে পাকা আম বিক্রি হচ্ছে এ বছর থেকে। আগের বছরগুলোতে বিক্রি হতো ৪২ কেজিতে মণ ধরে। 

কীভাবে যাবেন

ঢাকার শ্যামলী, কল্যাণপুর, আবদুল্লাহপুরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে হানিফ, দেশ ট্রাভেলস, ন্যাশনাল ট্রাভেলসসহ বিভিন্ন বাসযোগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেতে পারেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের বড় ইন্দারা মোড়ে হোটেল স্কাই ভিউ ইন, শান্তির মোড়সংলগ্ন আল নাহিদ ও মহাসড়কের পাশে স্বপ্নপুরী আবাসিক হোটেলে পাবেন থাকার সুব্যবস্থা।