লন্ডনের বৈশাখী মেলা

সাংস্কৃতিক পর্বে নৃত্য পরিবেশন করছেন এক শিল্পী।
সাংস্কৃতিক পর্বে নৃত্য পরিবেশন করছেন এক শিল্পী।

বিশাল এক খোলা ময়দান। সেখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে হাজার হাজার বাংলাদেশির সমাগম। সারি সারি দোকানে বিরিয়ানি, চটপটি, ফুচকা আর হালিম বেচার ধুম। ডাব খেতে সারি ধরেছে মানুষ। বেনারসি শাড়ি, কাচের চুড়ির দোকানগুলোতে তরুণীদের উপচে পড়া ভিড়। আর চারদিকে কেবল বাংলা গানের মূর্ছনা। ৩০ জুন লন্ডনে অনুষ্ঠিত বৈশাখী মেলার দৃশ্য এটি। এ যেন বিলেতের বুকে এক খণ্ড বাংলাদেশ!

বিলেতের বাংলাদেশিরা বরাবরই বিশাল আয়োজনে বৈশাখ উদ্‌যাপন করেন। তবে সেটা বৈশাখে নয়, বাংলাদেশে তখন আষাঢ় কিংবা শ্রাবণ। বাংলাদেশে বৈশাখের সময়টায় যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া থাকে বৈরী। বিরূপ আচরণ করে প্রকৃতি। তাই যুক্তরাজ্যের বাঙালিদের উদ্‌যাপনটাও কিছুটা বিলম্বিত। তাঁরা অপেক্ষায় থাকেন ঝলমলে একটি রোদেলা দিনের। গত ৩০ জুন রোববার ছিল সেই কাঙ্ক্ষিত দিন।

বাংলাদেশি-অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটসের সুবিশাল উইভার্স ফিল্ডসে বসে এবারের বৈশাখী মেলা। বিলেতের বাংলাদেশিদের কাছে এ মেলা এখন আর কেবল নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিচর্চার নয়। এর মাধ্যমে ভিন্ন সংস্কৃতির যুক্তরাজ্যে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেন তাঁরা। 

বৈশাখী শোভাযাত্রা

পূর্ব লন্ডনের ব্রিক লেনের সরু পথ ধরে ধীরলয়ে এগিয়ে চলছে ইয়া বড় এক বাঘের প্রতিকৃতি। পেছন পেছন এগোচ্ছে বিশাল আকৃতির মাছ, কচ্ছপ ও কুমিরের প্রতিরূপ। সঙ্গে রংবাহারি পোশাকে বিচিত্র সাজে নারী-পুরুষ ও শিশুদের সারি। তাঁদের হাতে গ্রামবাংলার নানা অনুষঙ্গ। নেচে-গেয়ে বাঙালির চিরায়ত এই উৎসবের বার্তা জানান দিচ্ছেন তাঁরা।

বাঘের সঙ্গে ছবি না তুললে কি চলে! ছবি: সংগৃহীত
বাঘের সঙ্গে ছবি না তুললে কি চলে! ছবি: সংগৃহীত

মঙ্গল শোভাযাত্রার আদলে সাজানো এমন বৈশাখী শোভাযাত্রার মধ্য দিয়েই শুরু হয় বিলেতে বৈশাখী মেলার আনুষ্ঠানিকতা। স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় শুরু হয় এ শোভাযাত্রা। বাঙালিদের প্রাণকেন্দ্র বাংলা টাউনের ব্রিক লেন এবং আশপাশের নানা রাস্তা প্রদক্ষিণ করে তা পৌঁছায় উইভার্স ফিল্ডসে। চারদিকে জানাজানি হয়ে যায় আজ উৎসবে মেতেছেন বাংলাদেশিরা।

টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়র জন বিগস, স্পিকার ভিক্টোরিয়া ওভেজসহ বাংলাদেশি কমিউনিটির বিশিষ্টজনেরা এ শোভাযাত্রায় অংশ নেন। যুক্তরাজ্যপ্রবাসীদের সংগঠন উদীচী, চারণ, সত্যেন সেন স্কুল অব আর্টস, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রসহ স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীরা শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। ভিন্ন সংস্কৃতির লোকেরাও উপভোগ করেন বাঙালির এই অনন্য উদ্‌যাপন। 

জেলের বেশে
জেলের বেশে

যেন এক খণ্ড বাংলাদেশ
বৈশাখী শোভাযাত্রা এসে পৌঁছাতেই জমে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। বেলা তিনটা নাগাদ একেবারে লোকে লোকারণ্য উইভার্স ফিল্ডস। মাঠের এক পাশে বিশাল মঞ্চে চলছে একের পর এক বাংলা গানের পরিবেশনা। মাঝেমধ্যে নাচ। মঞ্চে স্থানীয় বাংলাদেশি শিল্পীদের পাশাপাশি বিশেষ আকর্ষণ ছিলেন ইমরান মাহমুদ, লাভলী দেব ও বেলী আফরোজ।
লার স্টলগুলোতে বাঙালি খাবারের ছড়াছড়ি। বিরিয়ানি, ফুচকা, চটপটি, হালিম কিংবা কাঁচা ডাব—কী নেই সেখানে! শাড়ি, চুড়ি, বেনারসি কিংবা বাচ্চাদের খেলনার দোকানগুলোতে ক্রেতাদের জটলা। কে বলবে এটা ভিনদেশে বিলম্বিত বৈশাখ উদ্‌যাপন! 

মেলায় আরও যত আয়োজন
লন্ডনের বৈশাখী মেলায় বাঙালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতি তুলে ধরতে ছিল আরও নানা আয়োজন। বাউলদের জন্য বাউল আখড়া, কবিতা ও গল্পবলিয়েদের বিশেষ মঞ্চ, শাড়ি পরিধান প্রশিক্ষণকেন্দ্র, যোগব্যায়ামাগার এবং ক্যারম ও দাবা খেলার আলাদা আলাদা পরিসর। শিশুদের জন্য ছিল বিশাল রাইডস পার্ক এবং সৃষ্টিশীল বিনোদনের নানা আয়োজন। 

বহু সংস্কৃতির প্রতীক

বাঙালি যেখানেই যায়, সঙ্গে করে নিয়ে যায় নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে। বিলেতে আসা বাংলাদেশিরা একসময় কেবল ঘরোয়া পরিবেশে বৈশাখ উদ্‌যাপন করতেন। ১৯৯৮ সালের ১০ মে ব্রিক লেনে বৈশাখী মেলার যাত্রা শুরু হয়। আয়োজন ও পরিসরে বেড়ে তা বর্তমান রূপ নিয়েছে। এবার মেলায় ৪০ হাজারের বেশি মানুষের সমাগম ঘটে। সময়ের চাহিদায় এই মেলার আয়োজক এখন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল। কাউন্সিলের নির্বাহী মেয়র জন বিগস বলেন, বৈশাখী মেলা এখন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের গ্রীষ্ম কর্মসূচির অন্যতম দিন। এ আয়োজন যুক্তরাজ্যের বহু সংস্কৃতির অন্যতম নিদর্শন।

ঠিক তাই। কেবল বাংলাদেশিরা নন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর লোক শামিল হন বাঙালির এই উৎসবে।