হেপাটাইটিস: রোগনির্ণয় জরুরি

হেপাটাইটিস পানিবাহিত রোগ, তাই পানি পান করার সময় সচেতন হতে হবে তা জীবাণুমুক্ত কি না। মডেল: সজীব, ছবি: সুমন ইউসুফ
হেপাটাইটিস পানিবাহিত রোগ, তাই পানি পান করার সময় সচেতন হতে হবে তা জীবাণুমুক্ত কি না। মডেল: সজীব, ছবি: সুমন ইউসুফ

 বিশ্বের মানুষের মধ্যে ভয়াবহ সংক্রামক রোগ হেপাটাইটিস সম্পর্কে সচেতনতা এবং এর প্রতিরোধ, রোগনির্ণয় ও চিকিৎসা বিষয়ে সবাইকে উৎসাহী করার লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বব্যাপী ২৮ জুলাই পালিত হয়েছে ‘বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস’। বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসে এ বছরের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘আসুন খুঁজি লাখো অজানা রোগীকে’।

সারা পৃথিবীতে প্রায় ৩২ কোটি ৫০ লাখ মানুষ ভাইরাল হেপাটাইটিস বি এবং সি আক্রান্ত। প্রতিবছর এ রোগগুলোতে মারা যাচ্ছে অন্তত ১৪ লাখ মানুষ। মৃত্যুর দিক থেকে পৃথিবীতে যক্ষ্মার পরে হেপাটাইটিস মূল কারণ হিসেবে রয়েছে। অথচ হেপাটাইটিস নিয়ে বসবাস করা ৮০ শতাংশ মানুষ রয়েছে প্রতিরোধ, পরীক্ষা–নিরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবার আওতার বাইরে। প্রতি ১০ জন রোগীর অন্তত ৯ জন রোগটির ধরন সম্পর্কে একেবারেই অবহিত নয়। 

বাংলাদেশে জনসংখ্যার প্রায় ৫.৫ শতাংশ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত। এ জনসংখ্যার ৮০ লাখের বেশি মানুষ ক্রনিক (দীর্ঘমেয়াদি) হেপাটাইটিস বি-তে ভুগছে। এসব রোগীর অনেকেই পরবর্তীকালে লিভার সিরোসিস কিংবা লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। 

কীভাবে আপনি আক্রান্ত হতে পারেন

সন্তান প্রসবের সময় হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত মায়ের মাধ্যমে নবজাতক শিশুর মধ্যে হেপাটাইটিস বি সংক্রমণ ঘটে বেশি। মহিলা এবং অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের হেপাটাইটিস বি–তে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও অনেক বেশি। সংক্রমিত নবজাতকের প্রায় ৯০ শতাংশ জন্মের এক বছরের মাথায় ক্রনিক হেপাটাইটিস বিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। হেপাটাইটিস বি-তে আক্রান্ত ১০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে ক্রনিক হেপাটাইটিস বি দেখা দেয়। 

 অপরিশোধিত রক্ত এবং রক্তজাত সামগ্রী, একই ক্ষুর বা রেজর দিয়ে শেভ করার মাধ্যমেও হেপাটাইটিস বি ছড়াতে পারে। তবে নবজাতককে খাওয়ানো মায়ের দুধের মাধ্যমে যেমন হেপাটাইটিস বি ছড়ায় না, তেমনি একই পানির গ্লাস, থালাবাসন, জামাকাপড়, গামছা, টাওয়েল, টয়লেট, গোসলখানা ব্যবহার, কোলাকুলি, হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে হেপাটাইটিস বি ছড়ায় না। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে অরক্ষিত যৌনমিলনে ভাইরাসটি ছড়ায়। 

কীভাবে বুঝবেন

হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত রোগীদের প্রায়শই কোনো লক্ষণ থাকে না। কখনো কখনো পেটের ডান পাশে অস্বস্তি, ক্লান্তিবোধ, অরুচির কথা বলে থাকে। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত রোগীদের অনেকেই অতীতে জন্ডিস হয়েছে, তেমন ইতিহাস দিতে পারে না। কিছু রোগী সরাসরি লিভার সিরোসিস কিংবা লিভার ক্যানসার নিয়েও আসতে পারে। তাই স্ক্রিনিং ছাড়া কেউ এই ভাইরাসের বাহক কি না, তা বোঝা মুশকিল। যদি ইতিমধ্যে টিকা না দিয়ে থাকে, তবে উচিত হবে আজই হেপাটাইটিস বি স্ক্রিনিং করা।

প্রতিরোধক টিকা নিন

হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে রয়েছে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানি হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের আন্তর্জাতিক মানের ভ্যাকসিন তৈরি করে থাকে। এটি নিরাপদ, সারাজীবন সুরক্ষা দিয়ে থাকে। গর্ভাবস্থায় কিংবা মাতৃদুগ্ধকালীন মাকে হেপাটাইটিস বি নিশ্চিতকরণ পরীক্ষা করে ভ্যাকসিন দিতে কোনো বাধা নেই। হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত মায়ের সন্তান জন্মের পরপর কিংবা ২৪ ঘণ্টার ভেতর নবজাতককে হেপাটাইটিস বি প্রতিরোধে ভ্যাক্সিন এবং অ্যান্টিবডি দিতে হবে।

মাকে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় লিভার বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে থাকা উচিত। ডেলিভারি অবশ্যই হাসপাতালে হতে হবে, না হলে অনেক ক্ষেত্রে ঘটতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা, এমনকি মৃত্যু। সঠিক তাপমাত্রায় সংরক্ষিত হয় এমন জায়গা থেকে ভ্যাক্সিন না নিলে ভ্যাকসিনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো কার্যকারিতা পাওয়া যায় না। যাদের নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয়, ডায়ালাইসিস নেয়, সিরিঞ্জ দিয়ে নেশাগ্রস্ত ব্যক্তি, হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত রোগীর গৃহের সব সদস্য ও পরিবার, স্বাস্থ্যকর্মী এবং চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা, যাঁরা রক্ত এবং রক্তসামগ্রীর সংস্পর্শে আসেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মী; তাঁদের সবাইকে অবশ্যই ভ্যাক্সিনেশনের আওতায় আনতে হবে। বর্তমানে নবজাতকদের টিকা কর্মসূচির আওতায় আনা হয়েছে এই টিকাকে। তাই শিশুকে সব কটি টিকা দিতে ভুলবেন না। 

হেপাটাইটিস বি বা সি–এর চিকিৎসা আছে

হেপাটাইটিস বি একটি চিকিৎসাযোগ্য রোগ এবং এর ওষুধ সহজলভ্য। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ বাংলাদেশেই তৈরি হয় ও স্বল্পমূল্যে পাওয়া যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানের এসব ওষুধ এক শর বেশি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। লিভার সিরোসিস কিংবা লিভার ক্যানসারের মতো রোগ দেখা দেওয়ার আগেই রোগনির্ণয় হলে কার্যকর চিকিৎসা দিয়ে নিরাময়ের সম্ভাবনা রয়েছে। ঝাড়ফুঁক, কবিরাজি, হোমিওপ্যাথি, গাছগাছড়ার রস খেয়ে জটিলতা তৈরি হয়ে থাকে, রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে।

আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের গবেষকদের গবেষণার ফলাফললব্ধ হেপাটাইটিস বি–এর নতুন ওষুধ ‘ন্যাসভ্যাক’ হেপাটাইটিস বি চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে। ওষুধটির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে এবং এর কার্যকারিতা প্রচলিত ওষুধের চেয়ে অনেক বেশি। কিউবাসহ লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বেশ কিছু দেশে ওষুধটি ইতিমধ্যে বাজারজাত হয়েছে। জাপানে ন্যাসভ্যাকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ন্যাসভ্যাকের রেসিপি অনুমোদন করেছে। ন্যাসভ্যাক বাংলাদেশে ডেভেলপ করা প্রথম ওষুধ, যা বাংলাদেশে রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে। শিগগিরই ওষুধটি দেশের বাজারে আসবে বলে আশা করা যায়। 

ক্রনিক হেপাটাইটিস বি যদিও এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও লিভার সিরোসিস ও লিভার ক্যানসারের প্রধান কারণ, সারা পৃথিবীতে হেপাটাইটিস সি লিভার ক্যানসারের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত। সারা বিশ্বে ৭১ মিলিয়ন মানুষ হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত। এ দেশে প্রায় এক কোটি লোক হেপাটাইটিস সি ভাইরাসে আক্রান্ত। 

হেপাটাইটিস সি প্রতিরোধের কোনো কার্যকর ভ্যাকসিন নেই। একই সিরিঞ্জ শেয়ার করে নেশা করা, মেডিকেল যন্ত্রপাতি যথার্থভাবে স্টেরিলাইজ না হওয়া, স্ক্রিনিং ছাড়া রক্ত-রক্তজাত সামগ্রী পরিসঞ্চালন, সমকামিতা, অরক্ষিত যৌনমিলন, হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত মায়ের প্রসবকালীন বাচ্চার শরীরে হেপাটাইটিস সি সংক্রমিত হতে পারে। তবে মায়ের বুকের দুধ, খাওয়ার, পানি, কোলাকুলি, চুম্বন, খাবার কিংবা থালাবাসন, গ্লাস শেয়ারের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে হেপাটাইটিস সি সংক্রমণের ঝুঁকি নেই। 

সরকার সিডিসি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, হেপাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশের হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত রোগীদের অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ বিতরণ করে আসছে। যেখানে ক্ষেত্রভেদে রোগীদের ৮৪ হাজার টাকা থেকে ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকার ওষুধ বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে।

সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের অন্যতম গোল হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে হেপাটাইটিস বি ও সি নির্মূল করা। এই উপলক্ষে ২৮ জুলাই সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও পালিত হয়েছে বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস। মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা তৈরি করে লাখ লাখ অজানা রোগীকে খুঁজে বের করে চিকিৎসার আওতায় আনা এবং সরকারি–বেসরকারি খাত ও জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে ভাইরাস দুটিকে পৃথিবী থেকে একেবারে নির্মূল করাই এই দিবসের মূল প্রতিপাদ্য।

ডা. শেখ মোহাম্মদ নূর-ই-আলম : সহকারী অধ্যাপক, লিভার বিভাগ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।