খাবার পাতে ফুলের স্বাদে

কুমড়া ফুল
কুমড়া ফুল

ফুল মানেই কল্পনার এক মায়াবী জগৎ। পবিত্রতা, প্রেম, বন্ধুত্বের প্রতীক এই ফুলের সঙ্গে সৌন্দর্যের রূপকল্প জড়িয়ে আছে। কালিদাস থেকে দ্বিজ কানাই, রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জীবনানন্দ সবাই নারীর সৌন্দর্যের সঙ্গে ফুলের রূপকল্প চিত্রিত করেছেন দুহাত খুলে। কবির কল্পনায় চিত্রাঙ্গদার গায়ের রং ছিল শিশিরভেজা মহুয়া ফুলের মতো। রন্ধনপটীয়সী দ্রৌপদীর ছিল পদ্মপাপড়ির ডাগর আঁখি আর ছিল নীল পদ্মের মতো গায়ের রং! কালিদাসের যক্ষ তাঁর দূত মেঘকে ‘কদম্ব বৃক্ষ’ শোভিত উপত্যকায় বিশ্রাম নিতে বলেছেন, যেখানে ফুলেরা মেঘেদের স্পর্শে মনোরম হয়ে ওঠে। কবির কল্পনায় নারীর পদাঘাতে ফোটে অশোকের ফুল, হাসিতে উছলে ওঠে চম্পক আর দৃষ্টিপাতে ফোটে তিলক! এত উপমা, এত বন্দনা কিন্তু কী আশ্চর্য, কোনো কবি কোনো দিন বলেননি, সঠিক প্রণালিতে রান্না করা ফুল অতীব সুখাদ্যও বটে!

অবশ্য কবির তা বলার কথাও না, কাব্যেও আসার কথা না। বিশেষ করে সৌন্দর্যের প্রতীক কিংবা উপমা হয়ে ওঠা ফুলগুলোর সঙ্গে খাওয়া–দাওয়া মেলানো একটু কঠিনই। তবে নানাভাবে বেশির ভাগ ফুলই খাওয়া হয় দেশে দেশে। আমাদের দেশে যে ফুলগুলো খাবার হিসেবে সুস্বাদু সেগুলোও কম সুন্দর নয়। ভোরের সূর্যের মতো হলুদ কুমড়ো ফুল কিংবা বেগুনি রঙের কাঞ্চন ফুল—বেসন বা চালের গুঁড়োর মিশ্রণে ডুবো তেলে ভাজা ভাজা হয়ে যখন আপনার পাতে পড়বে—মাথায় তখন অনুরণন তুলবে খাবারের স্বাদ। আপনি এই স্বাদের উত্তরাধিকারীমাত্র।

গবেষকেরা জানাচ্ছেন, ১৪০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে মানুষ খাওয়ার জন্য ফুল ব্যবহার করে আসছে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায় খাদ্য হিসেবে ফুলের উপস্থিতির কথা জানা যায়। জুঁই, চন্দ্রমল্লিকা, ল্যাভেন্ডার, ডেইজি, গোলাপ, লাইলাক ইত্যাদি যেটিই আপনার প্রিয় ফুল হোক না কেন, জেনে রাখুন, আপনার প্রিয় ফুলটি খাওয়া যায় কোনো না কোনোভাবে।

আমাদের দেশে খাদ্য হিসেবে বেশি ব্যবহার হওয়া ফুলগুলো হলো কুমড়ো ফুল, বক ফুল, রক্তকাঞ্চন, কচুর ফুল, শাপলা ফুল, কলার মোচা, কচুরিপানার ফুল, ফুলকপি, পেঁয়াজকলি, মেস্তা ফুল, শজনে ফুল, সরষে ফুল। এগুলোর বড় অংশই সবজির ফুল। শহর থেকে গ্রাম সব জায়গায় বিভিন্ন প্রণালিতে এই ফুলগুলো খাওয়া হয়ে থাকে আমাদের দেশে। আমাদের খাদ্যসংস্কৃতিতে দুইভাবে ফুল খাওয়া হয়—ভেজে এবং তরকারি হিসেবে রান্না করে। ইউরোপে সালাদ হিসেবে বা খাবার পরিবেশনের সময় সাজানোর উপকরণ হিসেবে ফুলের পাপড়ি ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে সে ঐতিহ্য নেই। বাংলাদেশে প্রচলন না থাকলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় জুকিনি ফুল, দোপাটি, ডালিয়া, পদ্ম, গাঁদা, জবা ইত্যাদি।

কচুরিপানা ফুল, কচু ফুল, শাপলা ফুল
কচুরিপানা ফুল, কচু ফুল, শাপলা ফুল

বর্ষাকালে শাপলা তো শীতকালে পেঁয়াজকলি। আবার শীত ও গ্রীষ্ম উভয় ঋতুতেই কুমড়ো ফুল পাওয়া যায়। শীতের শেষ থেকে গ্রীষ্মকালের বিভিন্ন সময় রক্তকাঞ্চন ফুটে থাকে। এ ছাড়া প্রায় সারা বছর পাওয়া যায় বক ফুল আর কলার মোচা। শীতকালে পাওয়া যায় সরষে ফুল। পুরো বছরের বিভিন্ন সময় খাবার উপযোগী বিভিন্ন ফুল পাওয়া যায় আমাদের দেশে। ফুল খাওয়ার প্রচলন সম্ভবত এগুলোর ভেষজ গুণাগুণের জন্য। ভেষজ কারণে ফুল খাওয়ার প্রচলন অনেক পুরোনো। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে রোগপ্রতিরোধী গুণ আছে মনে করে খাওয়া হতো গাঁদা ফুল। বাঙালিও মনে করে কুমড়ো ফুল, বক ফুল, শজনে ফুল এবং কলার মোচায় রোগপ্রতিরোধী গুণ আছে।

এবার দেখা যাক মোটাদাগে ফুলগুলো কীভাবে খাওয়া হয়। কুমড়ো ফুল, বক ফুল, রক্তকাঞ্চন বেসন বা চালের গুঁড়োর মিশ্রণে মেখে ডুবো তেলে বড়া হিসেবে ভেজে খাওয়া হয়। শীতকালে ছোট আলু দিয়ে পেঁয়াজকলি ভাজা বা বিভিন্ন সবজি রান্নার অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ছাড়া সালাদ হিসেবেও এটি খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। যেসব এলাকায় কচুর চাষ হয় সেসব অঞ্চলে কচুর ফুল খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এ ফুলের গর্ভদণ্ড ফেলে দিয়ে পুরো অংশটি তরকারি হিসেবে খাওয়া হয়। ব্যাপক জনপ্রিয় ও পুষ্টিমানসমৃদ্ধ একটি খাদ্য কলার মোচা আদতে একটি ফুল। কলার মোচা রান্নার বর্ণনা ফুরোনোর নয়। বড় মাছের মাথাসহযোগে কিংবা আলু দিয়ে রান্না করে অথবা বড়া করে এটি খাওয়া যায়।

খাল–বিলের এই দেশে জলজ ফুল শাপলা খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় হবে, এটাই স্বাভাবিক। জলাভূমিতে অনায়াসে জন্মানো সাদা বা লাল রঙের শাপলার পাপড়ি থেকে কাণ্ড পুরোটাই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় খাওয়া হয়। এর সবচেয়ে জনপ্রিয় রান্না সম্ভবত চিংড়ি মাছ দিয়ে। পরিষ্কার পানির খাল–বিলে ফুটে থাকা কচুরিপানার ফুল খাদ্য হিসেবে চমৎকার। এর চাটনি বেশ সুস্বাদু। ফুলকপির কথা না বললে অন্যায় হয়ে যাবে। তবে ঠিক কতভাবে বাংলাদেশে ফুলকপি খাওয়া হয়, তার সঠিক কোনো হিসাব পাওয়া সত্যি কঠিন। এটি এতটাই জনপ্রিয় যে সবজি হিসেবে অন্যান্য সবজির সঙ্গে তো বটেই, মাছ-মাংস-ডিমের সঙ্গেও নানা প্রণালিতে রান্না করা হয় এ দেশে। মেস্তা ফুল মূলত টক বা চাটনি হিসেবে খাওয়া হয়। পাঁচফোড়নের সম্ভারে মেস্তা ফুলের চাটনি খাদ্য হিসেবে অসাধারণ। শজনে ফুলের চচ্চড়ি বা বাটি চচ্চড়ি স্বাদে অতুলনীয়।

বাঙালি এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিসত্তার মানুষদের মধ্যে খাদ্য হিসেবে ফুল ব্যবহারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেমন, চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষ হলুদের ফুল, শিমুল ফুল ইত্যাদি খেতে পছন্দ করে। গারোদের মধ্যে পেঁপের ফুল খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। বাঙালিদের মধ্যে এ ফুলগুলো খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় নয়। আরও অনেক হার্বস এবং মসলাজাতীয় ফুল আছে যেগুলো খাবার প্রচলন বাঙালিদের মধ্যে নেই। সঠিক প্রণালিতে রান্না করলে যেকোনো ফুলই সুখাদ্য হয়ে উঠতে পারে। বিকল্প খাবার হিসেবে যেকোনো ফুল একবার খেয়ে দেখতে পারেন।