ভাজাপোড়া খেয়ে খেয়ে দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ছে ছেলেটি

দৃষ্টিশক্তির অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হিসেবে চিপস ও ভাজাপোড়া–জাতীয় খাবারের নাম উঠে এসেছে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
দৃষ্টিশক্তির অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হিসেবে চিপস ও ভাজাপোড়া–জাতীয় খাবারের নাম উঠে এসেছে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস হতে পারে দৃষ্টিশক্তি হারানোর কারণ। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের ব্রিস্টলে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোরের প্রায় দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এমন তথ্য জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে দৃষ্টিশক্তির ক্ষতির কারণ হিসেবে অতিরিক্ত চিপস ও ভাজাপোড়া–জাতীয় খাবারের নাম উঠে এসেছে।

ধরা যাক, প্রায় দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়া ছেলেটির নাম স্যাম। ব্রিস্টলের চক্ষু চিকিৎসকেরা স্যামের হঠাৎ করে দৃষ্টিহীন হয়ে যাওয়ার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ছেলেটি কেবল ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, চিপস আর সাদা পাউরুটি খেত। মাঝেমধ্যে এক টুকরো মাংস বা সসেজ ছিল তার খাদ্যতালিকার অংশ। বাইরে থেকে দেখে মনে হতো, তার শরীর ঠিকই আছে। খুব রোগাও না, আবার খুব মোটাও না—এমন ছিমছাম স্বাস্থ্যের অধিকারী এক কিশোরকে দেখে কে বলবে, তার দেহে বাসা বেঁধেছে কঠিন সব অসুখ?

পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানা যায়, স্যামের শরীরে ভিটামিনের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। অপুষ্টির কারণে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না।

মাত্র ১৪ বছর বয়স থেকেই স্যাম খুব ক্লান্তিবোধ করত। কিছুই ভালো লাগত না তার। সে সময় ভিটামিন বি১২–এর অভাব শনাক্ত করে তাকে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও ডায়েট তালিকা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বেশি দিন সে ডায়েট মেনে চলতে পারেনি স্যাম। খুব শিগগিরই আবারও নিজেকে সে সঁপে দেয় চিপস আর ভাজাপোড়ার কাছে।

অ্যানালস অফ ইন্টারনাল মেডিসিন জার্নাল জানায়, এ ঘটনার তিন বছর পর, ক্রমান্বয়ে দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের কারণে তাকে ব্রিস্টল চক্ষু হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসক ডানাইজ আতান বলেন, স্যামের খাবার প্রতিদিন স্থানীয় দোকান থেকে এক প্যাকেট করে ভাজা মাছ বা চিপসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তার খাদ্যতালিকায় কোনো ধরনের ফল বা শাকসবজি ছিল না। স্যামের ভাষ্য, ওসব ঘাস-পাতা তার পেটে সহ্য হয় না। তার কখনো মনে হয়নি ফল বা শাক খাওয়া উচিত। খাবার বলতে একমাত্র চিপস বা তেলে ভাজা খাবারই তার মুখরোচক মনে হয়।

কিছু ভিটামিন অতিরিক্ত পরিমাণে ট্যাবলেটের মাধ্যমে গ্রহণ করলে শরীরের জন্য তা বিষাক্ত হতে পারে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে।
কিছু ভিটামিন অতিরিক্ত পরিমাণে ট্যাবলেটের মাধ্যমে গ্রহণ করলে শরীরের জন্য তা বিষাক্ত হতে পারে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে।

আতান এবং তাঁর সহকর্মীরা স্যামের ভিটামিন লেভেল পরীক্ষা করে দেখেন, স্যামের দেহে কপার, সেলেনিয়াম, ভিটামিন বি১২, ভিটামিন ডিসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন এবং খনিজ দ্রব্যের ঘাটতি আছে।

স্যামের ওজন বেশি বা কম ছিল না, তবে মারাত্মকভাবে অপুষ্টিতে ভুগছিল সে। তার হাড়ে খনিজের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছিল। স্যামের বয়সী একটি ছেলের এমন শারীরিক ক্ষতি কল্পনা করতেও কষ্ট হচ্ছিল চিকিৎসকদের। দৃষ্টিশক্তি কমতে কমতে এখন প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে স্যাম।

আতান বলেন, তার দৃষ্টিসীমার ঠিক মাঝখানে অন্ধত্বের রেখা দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ, সে গাড়ি চালাতে পারবে না। পড়তে, টেলিভিশন দেখতে বা কারও চেহারা চিনতে খুব কষ্ট হবে তার। চিকিৎসকেরা আশা করছেন, ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি নিয়ে কোনোমতে চলাফেরা করতে পারবে স্যাম।

স্যামের এই অসুখের নাম নিউট্রিশনাল অপটিক নিউরোপ্যাথি। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে রোগটি নিরাময়যোগ্য। তবে দেরি হয়ে গেলে নার্ভ দুর্বল হয়ে দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।

এমন বাছবিচার করে খাওয়াদাওয়া করলে শরীরের অভ্যন্তরে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে বলে জানান আতান। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতিদিনের খাবারে অন্তত দুই-তিন ধরনের খাদ্য উপাদান রাখা জরুরি। মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেটের সাহায্যে শরীরে ভিটামিনের চাহিদা কিছুটা পূরণ হলেও কোনোভাবেই তা স্বাস্থ্যকর খাদ্যের বিকল্প হতে পারে না।

বিশেষজ্ঞরা জানান, সুষম ডায়েটের মাধ্যমে ভিটামিন গ্রহণ করা ভালো। ভিটামিন এ ও আরও কিছু ভিটামিন অতিরিক্ত পরিমাণে ট্যাবলেটের মাধ্যমে গ্রহণ করলে শরীরের জন্য তা বিষাক্ত হতে পারে। এমনকি ভেগানরাও স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে। ভেগানদের শরীরে যথেষ্ট ভিটামিন বি১২ সরবরাহ না হওয়ায় দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া থেকে শুরু করে নানা রকম অসুবিধার সম্মুখীন হয় তারা। এ জন্য খাদ্যতালিকায় অল্প পরিমাণে হলেও মাংস রাখার ব্যাপারে জোর দেন আতান। তিনি বলেন, পুষ্টিকর ছত্রাকের মাধ্যমেও ভেগানরা প্রয়োজনীয় পুষ্টি পেতে পারেন।

ডায়েটিশিয়ান এবং ব্রিটিশ ডায়েটেটিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র রেবেকা ম্যাকম্যানামন বলেন, অতি নিয়ন্ত্রিত ডায়েট হতে পারে অ্যালার্জি এবং অটিজমসহ নানা অসুখের কারণ। আর ডায়েট করতে হলে বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে হবে। পঞ্চম জন্মদিন পর্যন্ত শিশুদের অবশ্যই পর্যাপ্ত মাল্টিভিটামিন সরবরাহ করতে হবে।