ত্বকে লেবুর প্যাক

নিয়ম মেনে লেবুর ব্যবহার ত্বককে করবে সুন্দর। মডেল: জেনিফার, পোশাক: বিবি প্রোডাকশন, ছবি: কবির হোসেন
নিয়ম মেনে লেবুর ব্যবহার ত্বককে করবে সুন্দর। মডেল: জেনিফার, পোশাক: বিবি প্রোডাকশন, ছবি: কবির হোসেন

‘পুকুরধারে লেবুর তলে

থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে

ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই...।’

যতীন্দ্রমোহন বাগচীর ‘কাজলা দিদি’, মোহাম্মদ নাসির আলীর ‘লেবুমামার সপ্তকাণ্ড’, নিজের পাতে দুপুরের খিচুড়ির সঙ্গে টাটকা লেবু—লিখতে বসে সবই এল। লেবুর মোহনীয় ঘ্রাণে আকুল হওয়ার দৃশ্যটা বোধ করি বাঙালি পরিবারের খাবার টেবিলে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। লেবুর ব্যবহার আছে রূপচর্চায়ও। জেনে নেওয়া যাক বিশেষজ্ঞ মতামত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্মরোগ বিভাগের অধ্যাপক হরষিত কুমার পাল বলেন, সৌন্দর্যচর্চায় লেবুর সর্বোৎকৃষ্ট উপকার পেতে হলে লেবু খেতে হবে। অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে লেবুর অ্যাসকরবিক অ্যাসিড। ফলে কোষের অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া–বিক্রিয়ায় (কোষের বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে জড়িত) স্বাভাবিক নিয়মে যে ক্ষতি হওয়ার, তা অনেকটাই কম হয়। ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতেও সহায়তা করে। তবে লেবুর রসমিশ্রিত প্যাক ত্বকে ব্যবহারের পর কারও কারও ত্বকে জ্বালাপোড়া হতে দেখা যায়, কারও কারও অ্যালার্জিজনিত সমস্যা ও প্রদাহ হতে পারে। তাই এ ধরনের প্যাক ব্যবহার করতে চাইলেও কিছু বিষয়ে সতর্কতা আবশ্যক।

ত্বক ও চুলের যত্নে লেবু উপকারী, জানালেন হার্বস আয়ুর্বেদিক স্কিন কেয়ার ক্লিনিকের আয়ুর্বেদিক রূপবিশেষজ্ঞ আফরিন মৌসুমী। তিনি বললেন, মনে রাখতে হবে, লেবুর রস সাইট্রিক অ্যাসিড। তাই এর ব্যবহার না জেনে যেকোনো ধরনের ত্বকে সরাসরি প্রয়োগ করা উচিত নয়। হিতে বিপরীত হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ত্বক লাল হয়ে যেতে পারে। বলিরেখাও পড়তে পারে। ত্বকের ধরন বুঝে নিয়ম মেনে ব্যবহার করলে ত্বক হয়ে উঠবে সুন্দর।

প্যাক হিসেবে পাতিলেবু ব্যবহার করাই ভালো। তবে এ লেবু সারা বছর পাওয়া যায় না। তাই অন্য লেবুও কাজে লাগাতে পারেন। আফরিন মৌসুমী জানালেন রূপচর্চায় লেবুর সঠিক ব্যবহার। 

মুখের ত্বকে

তৈলাক্ত ত্বক অনেক সময় কালচে ও মলিন দেখায়। ব্রণ হওয়ার প্রবণতাও থাকে। যাঁদের ত্বক তৈলাক্ত, তাঁদের জন্য এই প্যাক।

গ্রেডারের সাহায্যে লেবুর খোসার সবুজ অংশটা কুচি করে নিতে পারেন। কুচি করা খোসা বেটে নিন (পেস্ট করুন)। ১ টেবিল চামচ লেবুর খোসার পেস্ট, ৩-৪ টি পুদিনাপাতা, ৬-৭টি তুলসীপাতা ও ২ চা-চামচ মুলতানি মাটি পেস্ট করুন (পানি ছাড়া)। পুরোটা মুখে মেখে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করুন। সপ্তাহে দুই দিন ব্যবহার করলে ত্বকে উজ্জ্বলতা আসবে।

স্বাভাবিক ও শুষ্ক ত্বকের জন্য ১ চা-চামচ লেবুর রস, ১টি ডিমের কুসুম, ১ চা-চামচ মধু, ৬-৭ ফোঁটা জলপাই তেল ও ২ চা-চামচ গমের ময়দা মিশিয়ে প্যাক তৈরি করুন। ১৫ মিনিট পর মুখ ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে দুই-তিন দিন ব্যবহার করুন। এই প্যাক ত্বক উজ্জ্বল করে এবং বলিরেখা দূর করে।

অতিসংবেদনশীল ত্বকে লেবুর রস ব্যবহার করলে চুলকানি হতে পারে। অন্যান্য সমস্যাও দেখা যায়। তাই এই ত্বকে লেবুর রস ব্যবহার না করে লেবু ব্যবহার করতে হবে একটু ভিন্নভাবে। লেবুর খোসার ভেতরের সাদা অংশ (সবুজ অংশ এবং লেবুর ভেতরের সাদা পর্দার মতো অংশ বাদ দিয়ে) পেস্ট করুন। ১টি লেবু থেকে কমবেশি ১ চা-চামচ পরিমাণ পেস্ট পাওয়া যায়। ১ চা-চামচ পরিমাণের সঙ্গে ১ টেবিল চামচ মুগডালের বেসন, কয়েক ফোঁটা গ্লিসারিন ও ভিটামিন ই ক্যাপসুল (ক্যাপসুলের ভেতরে থাকা তরল ওষুধ) মিশিয়ে প্যাক তৈরি করুন।

প্যাক দিয়ে ১০ মিনিটের মধ্যে মুখ পরিষ্কার করে ফেলুন। সপ্তাহে এক-দুই দিন ব্যবহার করতে পারেন। মুগডালের বেসন অতিসংবেদনশীল ত্বকের জন্য চমৎকার ক্লিনজার। অতিসংবেদনশীল ত্বকে অনেক সময় তৈলাক্ত ভাব ও বলিরেখা একই সঙ্গে দেখা দিতে পারে। এই সমস্যা কমিয়ে আনতেও এই প্যাক উপকারী।

বডি স্ক্রাব, ক্লিনজার বা প্যাক হিসেবে
২টি লেবুর খোসা, আধা কাপ লেবুর রস (২টি লেবু থেকেই মোটামুটিভাবে এই পরিমাণ রস পাওয়া যায়), ৬ টেবিল চামচ সুজি, ৬ টেবিল চামচ হলুদের রস, ২টি ডিমের সাদা অংশ, ২ টেবিল চামচ জলপাই তেল ও ৩ টেবিল চামচ বাদামি চিনির মিশ্রণ শরীরের ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন সপ্তাহে এক দিন। ১০-১৫ মিনিট পর তোয়ালে দিয়ে ঘষে ঘষে তুলে ফেলুন। ত্বকের মৃত কোষ সরে যাবে, ত্বক উজ্জ্বল হয়ে উঠবে, ত্বকের বিভিন্ন স্থানের রঙের অসামঞ্জস্য দূর হবে। যেকোনো ধরনের ত্বকের জন্য এই স্ক্রাব কার্যকর। তবে হলুদের রস সরাসরি ব্যবহার করা ঠিক নয়। সরাসরি হলুদের রসের সঙ্গে লেবুর মিশ্রণ করা হলে ত্বকে জ্বালাপোড়া হতে পারে। তাই আগে হলুদ ছেঁচে রস বের করে নিয়ে ২-৩ মিনিট ফুটিয়ে নিন। এভাবে জ্বাল দিয়ে রাখা রস ফ্রিজে সাত দিন পর্যন্ত রেখে ব্যবহার করা যায়। ডিপ ফ্রিজে আরও বেশি দিন রাখা যায়। লেবুর খোসায় আছে এসেনশিয়াল তেল। বাদামি চিনির পরিবর্তে সাদা চিনি কাজে লাগাতে পারেন। তবে বাদামি চিনি বেশি ভালো। 

চুলের যত্নে
মাথার ত্বক তৈলাক্ত ও চুল শুষ্ক প্রকৃতির হলে, মাথার ত্বক খুব ঘেমে যাওয়ার প্রবণতা থাকলে, শ্যাম্পুর সঙ্গে কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে ব্যবহার করুন। এতে চুল ঝরঝরে থাকে, মাথার ত্বক ও চুল ঘেমে স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়ে না, ঘামজনিত দুর্গন্ধও হয় না। এ উপকার পেতে বাইরে যাওয়ার আগে এভাবে শ্যাম্পু করে নেওয়া ভালো, প্রয়োজনে প্রতিদিনই করতে পারবেন। শ্যাম্পুতে রিঠার নির্যাস থাকলেও লেবুর রস দেওয়া যায়। তবে শ্যাম্পুতে প্রকৃতরূপে রিঠাই যদি থাকে, তাহলে আর লেবুর রস দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

তৈলাক্ত মাথার ত্বকে যদি খুশকি হয়, তাহলে ২ টেবিল চামচ মেথি, ২ টেবিল চামচ লেবুর রস ও ২ টেবিল চামচ পানি মিশিয়ে সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে মাথার ত্বকে লাগিয়ে ১ ঘণ্টা পর শ্যাম্পু করে নিন। সপ্তাহে এক দিন ব্যবহার করতে পারেন। অনেক সময় এ ধরনের চুলে খুশকি হয়, যা সহজে দেখা যায় না। মাথায় ফুসকুড়ির মতো গোটা হতে দেখা যায়, চুল পড়ে যেতে দেখা যায়। খুশকি বা এ রকম সমস্যা বেশি হলে সপ্তাহে দুই দিনও ব্যবহার করা যায়।

চুলের জন্য আরেকটি প্যাক—

২ টেবিল চামচ আমলকীর পাউডার, সমপরিমাণ মেথি পাউডার ও ১টি লেবুর খোসা (সবুজ অংশ) একসঙ্গে পেস্ট করে নিন। এই মিশ্রণকে চুলের ‘খাবার’ বলা হয়। অল্প পরিমাণ (এক থেকে দেড় টেবিল চামচ) জলপাই তেল বা নারকেল তেল মিশিয়ে মাথার ত্বকে লাগিয়ে রাখুন ১ ঘণ্টা (মাথার ত্বকের সঙ্গে সঙ্গে চুলেও দেওয়া যায়)। এরপর শ্যাম্পু করে ফেলুন। সপ্তাহে এক দিন ব্যবহার করুন। এই মিশ্রণ চুলের বৃদ্ধি বাড়াতে সহায়তা করবে।

সতর্কতা

অধ্যাপক হরষিত কুমার পাল জানালেন, যে প্যাক ব্যবহার করতে চান, সেটি তৈরি করে কানের পেছনের ত্বকে খানিকটা লাগাতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়া হলে সেই প্যাক তখনই পরিত্যাগ করবেন। কোনো সমস্যা না হলে প্যাকের জন্য প্রযোজ্য সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। ১৪ দিন পর আবার একই প্যাক একই নিয়মে একই জায়গায় একইভাবে ব্যবহার করুন। কোনো সমস্যা না হলে ৭-১৪ দিন পর পুনরাবৃত্তি করুন। এরপর কোনো সমস্যা না হলে ধরে নেওয়া যায় প্যাকটি আপনার জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে না। তাহলে পরদিন থেকে প্যাকটি ব্যবহার করতে পারবেন। কোনো কোনো সমস্যা দেখা দিতে একটু বেশি সময় লাগে। তাই এই পদ্ধতি। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময়ে কানের পেছনের ত্বকে কোনো ধরনের সমস্যা হলে অবস্থানগত কারণে সেটির চিকিৎসা করাতে হবে।