মহামায়ায় কী যে মায়া

মহামায়ার লেকের পাড়েই মিলবে নানা রকমের নৌকা। ছবি: মাসুম আলী

চৌদ্দগ্রামে বিরতির পর কিছুটা তন্দ্রা লেগেছিল। হঠাৎ বাসের গাইড ডাকলেন, বারইয়ার হাট...। মুহূর্তেই তন্দ্রা পালিয়ে গেল। চলে এলাম তো, আর কিছুক্ষণ পরেই তো গন্তব্য আমাদের। মিরসরাইয়ের ঠাকুরদীঘি বাজারের আগেই নেমে গেলাম। হাতের বাঁ দিকে কিছুদূর এগিয়ে বুঝলাম কতটা বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল আমাদের জন্য। চার ঘণ্টা ভ্রমণের ক্লান্তি সবটাই নিমেষে হাওয়া!

যত গভীরে যাবেন, তত নির্জনতা। তত সবুজ, তত সৌন্দর্য। ছবি: মাসুম আলী
যত গভীরে যাবেন, তত নির্জনতা। তত সবুজ, তত সৌন্দর্য। ছবি: মাসুম আলী

মাত্র এক দিনের পরিকল্পনা। হুম, এক দিনই যথেষ্ট, যদি আপনি শুধু মহামায়া ইকোপার্ক এবং প্রাকৃতিক হ্রদ ভ্রমণের চিন্তা করেন। শুধু এই একটি জায়গা ঘুরে বেড়ানোই যথেষ্ট, পয়সা উশুল হবেই।

মনভরে ঘুরে বেড়ানোর যথেষ্ট জায়গা আছে। ছবি: মাসুম আলী।
মনভরে ঘুরে বেড়ানোর যথেষ্ট জায়গা আছে। ছবি: মাসুম আলী।

জোর দিয়ে পয়সা উশুল কেন বলছি, তা শুনুন। বলাটা যুক্তিসংগত। মহামায়া ইকোপার্কের গেটে যাওয়া যায় যেকোনো যানবাহন নিয়ে। নির্ধারিত অর্থ দিয়ে নিরাপদে নিজস্ব গাড়ি রাখারও ব্যবস্থা আছে এখানে। বর্তমান টিকিট মূল্য করসহ ১১ টাকা ৫০ পয়সা। লেকের কাছাকাছি যেতে হাঁটতে হবে সামান্য পথ। সে পথেও যথেষ্ট মায়া, দুই পাশে সারি সারি গাছ। কোথাও ফসলি জমি। এ মৌসুমে অর্থাৎ শরৎকালে গেলে মনে হবে সবুজ কার্পেট রেখে দেওয়া জমিতে। চোখজুড়ানো চারদিক!

চারদিকে সবুজে মোড়ানো পাহাড়, তার ভাঁজে ভাঁজে স্বচ্ছ জলের প্রণয়। ছবি: মাসুম আলী
চারদিকে সবুজে মোড়ানো পাহাড়, তার ভাঁজে ভাঁজে স্বচ্ছ জলের প্রণয়। ছবি: মাসুম আলী

টিকিট কেটে ঢুকে গেলাম ইকোপার্কে। দুই পাশে গাছ আর মাঝে পিচঢালা রাস্তায় কিছু পথে হেঁটে সামান্য ওপরে উঠতে হবে। অর্থাৎ ঢালু থেকে একটু ওপরের দিকে। তারপরেই মহামায়ার লেক বা হ্রদ। রীতিমতো চোখধাঁধানো। স্বচ্ছ জলরাশি, ফাঁকে ফাঁকে সবুজ পাহাড়। আবার উল্টো করে বললেও ভুল হবে না মোটেও, চারদিকে সবুজে মোড়ানো পাহাড়, তার ভাঁজে ভাঁজে স্বচ্ছ জলের প্রণয়। দেখে মনে হবে একেবারেই সুপরিকল্পিত কোনো মায়াভরা নিসর্গ। নিসর্গ আঁকায় সিদ্ধহস্ত কোনো শিল্পী খুব যত্ন করে সময় নিয়ে এঁকেছেন একটি ছবি। যে ছবির কোনো খুঁত নেই। আছে সবুজের নেতৃত্বে নানা রঙের সম্মিলন।

কোথাও কোথাও ঘন পাতায় আড়ালে দেখা যাবে লেকের স্বচ্ছ জল। ছবি: মাসুম আলী।
কোথাও কোথাও ঘন পাতায় আড়ালে দেখা যাবে লেকের স্বচ্ছ জল। ছবি: মাসুম আলী।

এটি রাঙামাটির কাপ্তাই লেকের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম লেক বা হ্রদ। লেকের কিনারে নানা আকৃতির নৌকা। নির্ধারিত মূল্য আছে বটে, তবে সেসব খুব একটা মানা হয় বলে মনে হয়নি। দামাদামি করে উঠতে হবে। আর ওঠার আগে নিশ্চিত হতে হবে লাইফ জ্যাকেট আছে কি না। ১১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের স্বচ্ছ এ লেকের চারদিকে সারি সারি পাহাড়ের ভাঁজ। পৃথক দ্বীপের মতো পাহাড় লেকের মাঝেও, সেই খণ্ড খণ্ড দ্বীপ পাহাড় যেন একেকটি দ্বীপ। যত গভীরে যাবেন মহামায়ার মায়া টানতে থাকে, টানতে থাকে। একসময় মিলবে অপূর্ব কিছু জলপ্রপাত। পাহাড়ের শরীর থেকে লেকে পানি পড়ার অপূর্ব সংগীত শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে অন্য রকম মায়া দেবে।

হাতে সময় কম কিংবা লেক পাড়ি দিতে ইচ্ছা করছে না? সমস্যা নেই। এ পাড়েও মনভরে ঘুরে বেড়ানোর যথেষ্ট জায়গা আছে। প্রকৃতির বুকে হারিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট জায়গা আছে। চাইলে মিশে যেতে পারবেন অরণ্যের নির্জনতায়।

যত দূর দেখা যায়, ঘন গাছের সারি। ছবি: মাসুম আলী।
যত দূর দেখা যায়, ঘন গাছের সারি। ছবি: মাসুম আলী।

তো চলে যান হাতের বাঁ পাশে। যত গভীরে যাবেন, তত নির্জনতা। তত সবুজ, তত সৌন্দর্য। যত দূর দেখা যায়, ঘন গাছের সারি, কোথাও কোথাও ঘন পাতায় আড়ালে দেখা যাবে লেকের স্বচ্ছ জল। জঙ্গল অথচ ঠিক জঙ্গলের মতো নয়। বেশ খানিকটা পথে পিচঢালা রাস্তা। এদিক-ওদিক বসার ব্যবস্থা, দৃষ্টিনন্দন ছাতার টেবিল, ইটের চেয়ার। যেখানে যাবেন, মনে হবে একটু বসি। ছবি তুলি। আর এই মৌসুমে কাশফুলের বাড়তি যোগ তো আছেই।

অদ্ভুত এক নির্জনতা এখানে। অবশ্য মাঝেমধ্যে চট্টগ্রামগামী কিংবা চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনের ঝিকঝিকে সব নির্জনতা ভাঙে বটে। তাতে মোটেও বিরক্ত লাগে না। সবুজের বুকে ছুটে চলা ট্রেনের ছান্দিক আওয়াজও অন্য রকম ভালো লাগে।

চাইলে মিশে যেতে পারবেন অরণ্যের নির্জনতায়। ছবি: মাসুম আলী
চাইলে মিশে যেতে পারবেন অরণ্যের নির্জনতায়। ছবি: মাসুম আলী

দেখা মিলল কয়েকজন পেশাদার কিশোর আলোকচিত্রীর। তাদের একজন রাশেদুজ্জামান নিশ্চিত করল, এখানে কোনো হিংস্র জন্তুজানোয়ার তারা দেখেনি। শুধু কানে আসবে নানা পাখির ডাক। স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রাকৃতিক লেক হলেও একটা সময়ে এ লেকের সরকারি কোনো ব্যবস্থাপনা ছিল না। এমনিতে গ্রামের গভীরে একটি মায়া ভরা গ্রাম ছিল। ২০১০ সালে মহামায়া পর্যটনকেন্দ্রটি তৈরি করে সরকার। দায়িত্বরত কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, লেকটিকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করতে কটেজ নির্মাণ করার পাশাপাশি এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের মধ্যে কেবল কার, পাহাড়ে পাহাড়ে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি শুরু করেছে বন বিভাগ। গড়ে উঠেছে উন্নত মানের খাবার হোটেল ও রেস্তোরাঁ।

ঢাকা থেকে মহামায়ায় যেভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে যেতে হলে কমলাপুর, আরামবাগ বা সায়েদাবাদ থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোনো বাসে টিকিট কাটুন। নামতে পারেন বারইয়ারহাট, মিরসরাই বা বড়তাকিয়া স্টেশনে। অবশ্যই বাসের ড্রাইভার এবং গাইডকে আগেই বলে রাখবেন। এবং অব্যশই ফেনী পার হওয়ার পর প্রস্তুতি রাখবেন। বারইয়ারহাট, মিরসরাই বা বড়তাকিয়া যেখানেই নামেন না কেন সিএনজি অটোরিকশা বা অন্য কোনো বাহনে ঠাকুরদীঘি বাজারে এসে পূর্ব দিকের রাস্তা দিয়ে মহামায়ায় প্রবেশ করতে হবে। নিজস্ব যানবাহন নিলে একেবারেই মহামায়ার গেটে নামতে পারবেন। গাড়ি ভেদে নির্ধারিত ফি দিয়ে টিকিট কেটে নিশ্চিন্তে ঢুকে যাবেন ভেতরে।

চট্টগ্রাম থেকে আসতে চাইলে বারইয়ারহাট বা ফেনীগামী যেকোনো বাসে উঠলেই হবে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই মিরসরাই বা বড়তাকিয়া স্টেশনে নেমে যেতে হবে। বাইরে বেশ কিছু খাবারের দোকান পাবেন। পাশাপাশি তিনটি রেস্তোরাঁ আছে।

মিরসরাই এলাকায় পরিবার–পরিজন নিয়ে থাকার ভালো মানের হোটেলের খোঁজ পাওয়া যায়নি। চাইলে চট্টগ্রাম শহরেই থেকে মহামায়ার মায়া উপভোগ করতে পারেন। মিরসরাই অঞ্চলে এক দিনে ভ্রমণের আরও কয়েকটি নয়নাভিরাম পর্যটনকেন্দ্র আছে। সেসবের গল্প না হয় আরেক দিন হোক।