পুতুলসাজের ইতিকথা

শৌখিন মানুষের নজর কাড়ছে ঐতিহ্যবাহী পুতুল। ছবি: নকশা, কৃতজ্ঞতা: আইডিয়াস ক্রাফট
শৌখিন মানুষের নজর কাড়ছে ঐতিহ্যবাহী পুতুল। ছবি: নকশা, কৃতজ্ঞতা: আইডিয়াস ক্রাফট

ছুটতে ছুটতে একেবারে রাস্তায়। ঘুম টুটে দে ছুট। ফেরিওয়ালার ছোট্ট ঝুড়ি থেকে এক এক করে বেরিয়ে আসছে ছোট–বড় পুতুল, হাতি–ঘোড়া, পাখির দল। নিজের জন্য পছন্দ করছে এ বাড়ির ও বাড়ির ছেলেমেয়েরা। সেই সঙ্গে মা–বাবারাও যেন ফিরে যাচ্ছেন ছোটবেলার পুতুল খেলার দিনে। কড়া দুপুর কিংবা বিকেলবেলায় পাড়ার মধ্যে এই চিত্র অতীত। কুমারের আপন হাতে মাটি ছেনে বানানো পুতুলগুলো আজ জায়গা করে নিয়েছে শৌখিন মানুষের ঘর সাজানোর উপকরণ হিসেবে। ছোট্ট মেয়ের বানানো শাড়ি, গয়নার আদর ছেড়ে মাটির পুতুল বসার কি শোয়ার ঘর সাজিয়ে তুলছে নান্দনিক উপস্থাপনায়।

মাটির পুতুল দিয়ে ঢাকার নিজের বাসা সাজিয়েছেন সংগীতশিল্পী রেবা চক্রবর্তী। তিনি বলছিলেন, ছোটবেলায় বাবা আমাকে বিভিন্ন হাট বা মেলা থেকে মাটির পুতুল এনে দিতেন। মা নিজেও কিনে দিতেন। সরাসরি কুমাররা যখন ধান ওঠার দিনে মাটির হাঁড়িকুড়ি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করতেন, তখন তাঁদের কাছে পুতুল, হাতি, ঘোড়া, মাছসহ নানা রকম খেলনা থাকত। মা ও কাকিরা ধান দিয়ে আমাদের ভাইবোনদের সেগুলো কিনে দিতেন। সারা দিন সেগুলো নিয়ে খেলতাম। পুতুলের বিয়ে দিতাম, স্নান করাতাম, সাজাতাম আরও কত কী। পুতুলের প্রতি ভালোবাসা তখন থেকেই। এই বড়বেলায় এসে বাঙালি সংস্কৃতির একটি উপকরণ হিসেবে এই পুতুল আমার অন্দরে শোভা পাচ্ছে এখন। যেখানেই যাই, পুতুল পেলেই নিয়ে আসি।

বিভিন্ন আকারের নানা নকশার পুতুল আছে রেবা চক্রবর্তীর সংগ্রহে। এমনকি অফিসের টেবিলে পেপার ওয়েট হিসেবেও ব্যবহার করেন টেপা পুতুল। অন্দরসজ্জা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান স্কেচ ইন্টেরিয়র ডিজাইনের স্বত্বাধিকারী ফারাহ্​ দিবা বলেন, ‘অন্দরসজ্জায় পোড়া মাটির পুতুল, হাতি, ঘোড়া নতুন মাত্রা যোগ করে। সময়ের আবেদনে বর্তমান অন্দরসজ্জায় ফিরেছে শতভাগ বাঙালিয়ানা। শৌখিন মানুষের নজর কাড়ছে পুরোনো ঐতিহ্যবাহী মাটির হাঁড়িকুড়ি, পুতুল ইত্যাদি।’

ঘরের সব জায়গায় সহজেই মানিয়ে যায় নান্দনিক পুতুলগুলো। বসার ঘরের কোণে গোল টুল বা টিপয়ের ওপর সুতার কাজ করা ম্যাটের ওপর কয়েকটি ছোট–বড় আকারের টেপা পুতুল রাখা যেতে পারে কিংবা দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া যেতে পারে পুতুলের চাইম। ডোকরা পুতুলগুলো রাখা যেতে পারে কাঠের ওপর। এমনই পরামর্শ ফারাহ্​ দিবার। বারান্দার কোণে সবুজ গাছের পাশে ছোট টুল রেখে তার ওপর মাটির প্লেটে দুটি বড় আকৃতির পুতুলের সঙ্গে ছোট আকৃতির কয়েকটি পুতুল সাজিয়ে রাখলে বেশ লাগবে। মনে হবে যেন একটি পরিবার গল্পে গল্পে বারান্দায় অবসর কাটাচ্ছে।

শোয়ার ঘরে বেড সাইড টেবিলেও নান্দনিক লাগবে। ফারাহ্​ দিবা জানান, পুতুল দিয়ে ঘর সাজালেই হবে না, চাই এর যত্ন–আত্তিও। পুতুলের গায়ে খাঁজকাটা নকশায় জমতে পারে ধুলাবালু, তাই কিছুদিন পরপর নরম ব্রাশ দিয়ে হালকা ঘষে এগুলো পরিষ্কার করা জরুরি। পুতুলের পোড়া মাটি বা কালচে রং ঔজ্জ্বল্য হারাবে। ভিজা কাপড় ব্যবহার না করা এবং মাটির পুতুল যেহেতু সহজেই পড়ে ভেঙে যেতে পারে, তাই এগুলো বসানোর স্থান নির্বাচনে সতর্ক হওয়া জরুরি।

ঢাকার আইডিয়াল ক্র্যাফটসের স্বত্বাধিকারী শ্যামল চন্দ্র সাহা জানান, মাটির জিনিসপত্র ভঙ্গুর হয়। বাজারে সহজলভ্য প্লাস্টিক কাপড়ের পুতুলের ভিড়ে কদর কমেছে মাটির তৈরি নানা রকম পণ্যের। বাঙালির পুরোনো ঐতিহ্য পুতুলসহ মাটির তৈরি বিভিন্ন উপকরণের প্রতি ছোটবেলা থেকেই একধরনের মমত্ব থাকায় পশ্চিমবঙ্গের বোলপুর, শান্তিনিকেতন, নদীয়া থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে টেরাকোটা সংগ্রহ করে পসরা সাজিয়েছেন তাঁর আইডিয়াল ক্র্যাফটসে। এ ছাড়া পুতুলের নকশায় কেউ হয়তো ধান ভানছে, মা তার সন্তানকে কোলে নিয়ে আছে, মসলা পিষছে, এমনধারার পুতুলও পাওয়া যাবে।

এসব মাটির পুতুলের আকার আকৃতি এবং নকশাভেদে দাম পড়বে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। এ ছাড়া আড়ং, সোর্স, দোয়েল চত্বর, বিভিন্ন মেলা বা প্রদর্শনীতে মিলবে মাটির পুতুল।