বাঘ উদ্ধারের গল্প

বাঘটিকে ঘর থেকে বের করে আনা হচ্ছে। ছবি: লেখক
বাঘটিকে ঘর থেকে বের করে আনা হচ্ছে। ছবি: লেখক

২০১২ সালের ১৫ জানুয়ারি। রাত তখন বড়জোর আটটা। আমাদের ওয়াইল্ড টিম অফিসে খবর এল, সুন্দরবন–সংলগ্ন আংটিহারা গ্রামে বাঘ এসেছে। সন্ধ্যায় বাড়ির গৃহিণী ঘরের পাশেই কাজ করছিলেন। রান্না শেষ করে শোবার ঘরের দরজার কাছে যেতেই কুপির মিটিমিটি আলোয় দেখেন, বিছানায় কিছু একটা শুয়ে আছে। আলো হাতে কাছে যেতেই তাঁর পিলে চমকে যাওয়ার অবস্থা। এ যে বাঘ, মেঝেতে পাতা বিছানায় আরামে ঘুমোচ্ছে। তিনি চিৎকার দিয়ে দৌড়ে ঘরের বাইরে আসেন। এই বৃত্তান্ত আমরা লোকমুখে শুনি। 

ততক্ষণে ইতিমধ্যে স্থানীয় বন বিভাগের কর্মীসহ সুন্দরবন নিয়ে কাজ করা সংগঠনের সদস্যরা বাঘ ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছেন। আমরা তৎকালীন বন সংরক্ষক জহির উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে ওয়াইল্ড টিমের কর্মীসহ বন বিভাগের দলটি প্রস্তুত হই ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য। খুলনা থেকে আংটিহারা গ্রামে গাড়িতে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই স্পিডবোটে শুরু হয় এক রোমাঞ্চকর যাত্রা। 

আংটিহারায় যখন পৌঁছালাম, তখন ভোর। স্পিডবোট থেকে চারপাশে তাকিয়ে দেখি, অসংখ্য উৎসুক মানুষ ভিড় করেছে। তবে সবাই বাঘের আস্তানা গাড়া ঘর থেকে দূরে। আমরা এবং স্থানীয় কয়েকজন ঘরের কাছে গেলাম। বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাঘের অবস্থান দেখলেন উদ্ধারকারী দলের সদস্যরা। আমি নিজেও একবার উঁকি মেরে দেখলাম, ঘরে খাট বা চৌকি নেই, মেঝের এক কোণে বিছানা পাতা, সেই বিছানায় কাঁথা জড়িয়ে বাঘ বেড়ার সঙ্গে গা ঘেঁষে শুয়ে আছে। বাঘের অবস্থা ও অবস্থান বুঝে চেতনানাশক ওষুধ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত হলো। 

চেতনা ফেরার পর যখন তাকাল
চেতনা ফেরার পর যখন তাকাল

সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম, সহকারী বন সংরক্ষক আবু নাছের মোহসীন হোসেন বেড়ার ফাঁক দিয়ে ডার্টগান থেকে ডার্ট ছুড়লেন। বাঘ তেমন কোনো আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখাল না। কিছু সময় পরেই বাঘটি অচেতন হয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতরে গিয়ে বন বিভাগের লোকজন ও এফটিআরটির (ফরেস্ট টাইগার রেসপন্স টিম) কর্মীরা অচেতন বাঘ কোলে করে নিয়ে বের হলেন। আমি তখন দ্রুততার সঙ্গে ক্যামেরায় উদ্ধার অভিযানের ছবি তুলছিলাম। 

এদিকে ভাটা থাকায় একটি ডিঙি বাঁধের ওপরেই প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। দুই পাশে থাকা শত শত মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাঘ নৌকায় তুলে বাঁধ থেকে কাদার মধ্যে নামিয়ে দেওয়া হলো। উঁচু বাঁধ থেকে পিচ্ছিল কাদার ওপর দিয়ে নৌকাটি দ্রুত নদীতে
নেমে গেল। উৎসুক লোকজন তখনো বুঝতে পারেনি বাঘ উদ্ধার হয়েছে। নৌকা থেকে স্পিডবোটে তোলার সময় কাছে থাকা মানুষজন বুঝতে পারল, বাঘ ঘর থেকে বের করা হয়েছে। যতক্ষণে শোরগোল শুরু হলো, ততক্ষণে বাঘ বহনকারী স্পিডবোট মাঝনদীতে। 

আংটিহারা থেকে সাতক্ষীরা রেঞ্জ কলাগাছিয়া ক্যাম্পে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগল না। পর্যটকদের বসার ঘরে তোশক বিছিয়ে বাঘকে শুইয়ে কম্বল দিয়ে ঢেকে রাখা হলো। স্ত্রী বাঘটি হাড় জিরজিরে, দুর্বল। বাঘিনীর পেছনের ডান পায়ের হাঁটুর নিচ থেকে বাকি অংশ নেই। সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে বাঘিনী সুন্দরবনের মতো কঠিন বনে স্বাভাবিক শিকার করতে পারেনি। এ কারণে দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমি বাঘিনীর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ছবি নেওয়ার পাশাপাশি খুঁজে দেখলাম আর কোথাও আঘাত বা ক্ষত আছে কি না। প্রয়োজনীয় শারীরিক সব তথ্য লিপিবদ্ধ করার পাশাপাশি ক্ষতস্থানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হলো। 

ভয়ংকর প্রাণীটির এত কাছ থেকে দেখা ও মসৃণ ডোরাকাটা লোমের ওপর দিয়ে হাত বোলানোর সময় দারুণ এক রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। সুন্দরবনের বাঘিনীর গায়ে হাত বোলানোর এমন সৌভাগ্য কজনের হয় (হোক না অচেতন)। বাঘিনীর লম্বা গোঁফ মসৃণ লোমের তুলনায় অনেক শক্ত ও খসখসে। জিহ্বার ত্বক সিরিশ কাগজের মতো ধারালো। বইপত্রে বাঘের শারীরিক গঠন নিয়ে অনেক কিছুই পড়েছি। সেদিন বাঘের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বইয়ে পড়া প্রতিটি বর্ণনা স্বচক্ষে দেখছি। কী অপূর্ব ভয়ংকর সুন্দর এই প্রাণী! কলাগাছিয়ায় আসার প্রায় আধা ঘণ্টা পর, সবাই যখন পরিচর্যার পাশাপাশি অপলক চোখে বাঘিনীর দিকে তাকিয়ে আছি, তখন হঠাৎ বাঘিনী ঈষৎ নড়ে গোল গোল গভীর চোখে আমাদের দিকে তাকাল। আমি ঠিক তখন বাঘিনীর মাথার পাশেই বসে আছি। প্রথমে কিঞ্চিৎ ভড়কে গেলেও সঙ্গে সঙ্গেই বুঝলাম বাঘিনীর স্বাভাবিক হতে এখনো অনেক সময় বাকি। 

ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্কের খাঁচায়, ২০১৩
ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্কের খাঁচায়, ২০১৩

বাঘিনীকে গোলঘরের মেঝেতে খোলা অবস্থায় রাখা আছে। একদম অচেতন অবস্থায় খাঁচায় রাখা যাবে না। কেননা, চেতনা ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিনিয়ত শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। শরীরের তাপমাত্রা ও শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়ে হবে। সামান্য হেরফের বড় ধরনের ঝুঁকি বয়ে আনতে পারে। আমরা চারপাশে ঘিরে কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে আছি। বাঘিনী আবার চোখ খুলল। সঙ্গে সঙ্গে সব্বাই দূরে সরে দাঁড়ালাম। বুঝলাম এবার সময় হয়েছে বাঘিনীর জেগে ওঠার। কিছুক্ষণ পলকহীন গভীর চোখে তাকিয়ে থেকে বাঘিনী মাথা তোলার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারকারী দলে থাকা ওয়াইল্ড টিমের কর্মী একটি কম্বল দিয়ে বাঘিনীর মাথা ঢেকে দিলেন। আর বেশিক্ষণ বাঘিনীকে খোলা রাখা নিরাপদ হবে না। 

রেঞ্জ অফিস থেকে এরই মধ্যে বাঘের জন্য খাঁচা আনানো হয়েছিল। অচেতন বাঘিনীর সম্পূর্ণ চেতনা ফিরে পাওয়ার আগেই তোশকসহ ধরাধরি করে বড় খাঁচার মধ্যে বাঘিনীকে ঢোকানো হলো। খাঁচায় রাখার কিছুক্ষণ পরই বাঘিনী উঠে বসার চেষ্টা করল। খাঁচার ফাঁক দিয়ে তাকালাম বাঘিনীর দিকে। সে–ও মাথা তুলে আমার দিকে তাকাল। কী যে গভীর শীতল সেই চাহনি। বুকের ভেতরে হিমশীতল অনুভূতি বয়ে গেল। বাঘিনীর শরীরের অবস্থা দেখে সহজেই বোঝা যাচ্ছিল, সে ক্ষুধার্ত। খাঁচার ভেতরে একটি পাত্রে পানি দেওয়া হলো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিব দিয়ে চেটে চেটে সেই পানি খেতে লাগল। কাঁচা মাংস দেওয়া হলে কিছুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে সেই মাংস খেতে শুরু করল। 

বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বাঘের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন, বাঘিনীকে সুন্দরবনে ছাড়া যাবে না। কেননা, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, আহত ও দুর্বল বাঘিনী বনে শিকার করতে পারবে না। কিছুদিন পর হয়তো না খেয়েই মারা পড়বে। তাই সিদ্ধান্ত হলো, ট্রাকে করে কক্সবাজারের ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারি পার্কে পাঠানো হবে। একটা সময় তা–ই করা হলো। 

গ্রাম থেকে সফলভাবে জীবন্ত বাঘ উদ্ধারের ঘটনা বাংলাদেশ সুন্দরবনের ইতিহাসে বিরল। তবে সেটাই প্রথম ছিল না। আমরা পরে এই বাঘিনীর নাম দিয়ে ছিলাম ‘আংটিহারার রাজকন্যা’। অচেতন অবস্থায় বাঘিনীর শারীরিক তথ্য সংগ্রহের সময় ভেটেরিনারি চিকিৎসক নিশ্চিত করেছিলেন, এখনো এই বাঘিনী বাচ্চা প্রসব করেনি। তাই এর নাম রাজকন্যা রাখা হলো। 

সর্বশেষ ২০১৩ সালে সাফারি পার্কে গিয়েছিলাম আংটিহারার রাজকন্যাকে দেখতে। রাজকন্যা তখন বেশ স্বাস্থ্যবান। চোখের সামনে নিজেদের উদ্ধার করা সুন্দরবনের রাজকীয় বাঘিনীকে দেখে মনের মধ্যে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেছিলাম। জানি না, এখন সে কেমন আছে, কোথায় আছে। 

লেখক: সুন্দরবনের বাঘ সংরক্ষণকর্মী (ওয়াইল্ড টিম) এবং সুন্দরবনে আদি সভ্যতার প্রত্নস্থলের আবিষ্কারক।