২৫ বছর ধরে চলছে আমাদের পাঠচক্র

>
এস এম কিবরিয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন পাঠচক্রের, যেখানে আলোচনা হবে, মতবিনিময় হবে নানা বিষয়ে। সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ ‘আমাদের পাঠচক্র’।
এস এম কিবরিয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন এমন পাঠচক্রের, যেখানে আলোচনা হবে, মতবিনিময় হবে নানা বিষয়ে। সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ ‘আমাদের পাঠচক্র’।
এস এম কিবরিয়া তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। চার বন্ধুকে নিয়ে শুরু করেন সাপ্তাহিক পাঠচক্রের আসর। প্রায় ২৫ বছর ধরে চলছে কিবরিয়ার উদ্যোগে পরিচালিত ‘আমাদের পাঠচক্র’। বই থেকে সাম্প্রতিক নানা প্রসঙ্গ তাঁদের পাঠের বিষয়। লক্ষ্য একটাই—পড়ার অভ্যাস তৈরি করা। জানার জগৎ বিস্তৃত করা। সেই আসরে নানা সময়ে গিয়েছেন কবি আল মাহমুদ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বরেণ্য লেখক হুমায়ূন আহমেদের মতো মানুষ। কিবরিয়ার এই পাঠচক্র নিয়ে এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।

ঢাকার আজিমপুর এলাকায় ছাপরা মসজিদ রোড ধরে সামনে এগোতেই গলির শেষ মাথায় পুরোনো দোতলা বাড়ি। সিঁড়ি ভেঙে উঠতেই নজর কাড়ল সিঁড়ির পাশের লম্বা ঘরটি। দরজা খোলা। অনেকে মেঝেতে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছেন। তাঁরা যে এক পাঠচক্রে আগত, সেটুকু আগেই জানা ছিল। তবে ঘরে ঢুকে মনোযোগ কাড়ল দেয়ালে সাঁটানো ছবিগুলো। অ্যালেন গিনসবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ কবিতার অনুবাদ। দেয়ালে আরও আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, আলবার্ট আইনস্টাইন, কার্ল মার্ক্সসহ বিখ্যাত মনীষীরা। পুরো ঘরে তাকে তাকে সাজানো বই, সাময়িকী।

এই ঘরেই ২৫ বছর আগে যাত্রা শুরু হয়েছিল এই জ্ঞানভিত্তিক আলোচনার। যার নাম ‘আমাদের পাঠচক্র’। বইপত্র থেকে সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয়—কোনো কিছুই বাদ যায় না সাপ্তাহিক পাঠচক্রের আসরে। পাঠচক্রের স্বপ্নদ্রষ্টা এস এম কিবরিয়া। বর্তমানে সেন্টার ফর আউটস্ট্যান্ডিং কনফ্লিক্ট নামের একটি বেসরকারি সংস্থায় বিশ্লেষক হিসেবে কাজ
করেন তিনি।

৮ নভেম্বরও পাঠচক্রে সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন কিবরিয়া। ঘড়ির কাঁটায় যখন রাত আটটা, তখনই ইতি টানা হলো ‘বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি’ আলোচনা পর্ব। এরপর মতামত নেওয়া হলো পববর্তী পর্বের বিষয় নির্ধারণের জন্য। এভাবেই চূড়ান্ত
হলো পরের সপ্তাহে কী বিষয়ে আলোচনা হবে, আলোচক হিসেবেই–বা থাকবেন কে। 

পাঠের আসর যখন সাঙ্গ হলো, একে একে অনেকে বিদায় নিলেন, তখন কথা শুরু হলো এস এম কিবরিয়ার সঙ্গে। বইবিমুখতার এই যুগে তিনি এখনো কীভাবে এই
আসর চালিয়ে নিচ্ছেন কিংবা শুরুটাই হলো কীভাবে—এসব নিয়েই শুরু হলো কথা। 

 কিবরিয়া তখন ছাত্র
১৯৯৫ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষার্থী এস এম কিবরিয়া। তখনো স্নাতকোত্তর শেষ করেননি। পদার্থবিদ্যার চেয়েও দেশ–বিদেশের নানা বিষয়ে জানার আগ্রহ তাঁর। এ জন্য প্রায়ই হাজির হন দেশসেরা গবেষক, শিক্ষকদের কাছে। ঋদ্ধ হন নিজের প্রশ্নের উত্তর জেনে। কিবরিয়া তখন ভাবলেন, অনেকে হয়তো নানা জিজ্ঞাসা নিয়ে ঘুরে বেড়ান, কিন্তু উত্তর পান না। 

তাহলে পাঠচক্রের আয়োজন করলে কেমন হয়?

এই স্বপ্নই অনুপ্রেরণা জোগাল। কিন্তু কিবরিয়া সেটা করবেন কী করে। তারও সমাধান বের হলো। নিজেদের বাড়ির যে ঘরটা পড়ার ঘর, সেখানেই শুরু হলো পাঠচক্রের আয়োজন। সঙ্গে পেলেন চার বন্ধুকে। যাঁরা তাঁরই মতো ভাবছিলেন। ১৯৯৫ সালের ৭ এপ্রিল বসল তাঁদের প্রথম আসর। সেদিনের বিষয় ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’। আগতরা সবাই পরিচিত বন্ধু, স্নেহভাজন, শ্রদ্ধেয়। সেদিন আলোচক হিসেবে পেয়েছিলেন নাট্যকার আবদুল্লাহ আল-মামুনকে।

সেই শুরু। প্রায় ২৫ বছর পরও আজও প্রতি শুক্রবার পাঠচক্রের আয়োজন হয়ে আসছে। এস এম কিবরিয়া বললেন, ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্য নিয়েই পাঠচক্রের শুরুটা। সব বয়সের সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসে নানাবিধ জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে নিজেকে আবিষ্কার করবে। যুক্তিতর্ক হবে, জ্ঞানের আদান–প্রদান হবে।’ 

প্রতি শুক্রবার এভােবই বসে পাঠচক্র, চলে কোনো বই বা কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা। ছবি: ছুটির দিনে
প্রতি শুক্রবার এভােবই বসে পাঠচক্র, চলে কোনো বই বা কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা। ছবি: ছুটির দিনে

এলেন অনেক গুণীজন 
শুরুর পর থেকেই প্রতি শুক্রবার চলতে থাকল নতুন বিষয় নিয়ে আলোচনা। কখনো কখনো বই নিয়েও হলো পাঠচক্র। এসব আসরে অতিথি বা আলোচক হিসেবে এসেছেন দেশবরেণ্য শিক্ষক, কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, গবেষক। পাঠচক্রের খাতা থেকে জানা গেল, এখানে এসেছেন কবি আল মাহমুদ, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, লেখক ও চিন্তাবিদ আহমদ ছফা, সরদার ফজলুল করিম, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, লেখক হুমায়ুন আজাদ, বরেণ্য কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমদ, লেখক তসলিমা নাসরিন প্রমুখ। এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে। তাঁর আসরে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় শামিল হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। 

কিবরিয়া বলছিলেন, ‘পাঠচক্রে মাঝেমধ্যে বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানানোর বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের সঙ্গে পাঠচক্রের সদস্যরা জটিল বিষয়গুলো নিয়ে, নিজেদের কৌতূহলী বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার সুযোগ পান। এতে পাঠচক্রের তরুণ সদস্যরা আলোচক হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পান।’ 

সেদিন ছিল ১২৭২তম আসর
সাপ্তাহিক আয়োজন শুক্রবার বিকেল পাঁচটায় শুরু হয়। ভূমিকার মাধ্যমে আলোচনার শুরু করেন পরিচালক কিবরিয়া। এরপর বক্তব্য দেন মূল আলোচক। আলোচনায় উপস্থিত প্রত্যেক সদস্য নিজের মতামত দিতে পারেন। ৮ নভেম্বর ছিল আমাদের পাঠচক্রের ১২৭২তম আসর। খাতার হিসাবে আরও জানা গেল, এই ২৫ বছরে ১০ হাজারের বেশি মানুষ এসেছেন এই পাঠচক্রে।

প্রতিটি আসরেই নতুন কোনো বিষয় আলোচিত হয়। বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে নিয়মিত আলোচনা তো হয়ই, সেই সঙ্গে ধারাবাহিকভাবেও আয়োজন হয় পাঠচক্রের। বাংলাদেশের ইতিহাস–ঐতিহ্য, বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা এবং উন্নয়ন, ভবিষ্যতের বাংলাদেশ, বাংলাদেশের দর্শনচর্চা, জাতিসংঘ এবং বাংলাদেশ, আন্তধর্মীয় সম্প্রীতি এবং বাংলাদেশ, বাংলাদেশের বিদ্বান সমাজ, জেন্ডার সমতা প্রসঙ্গ এবং বাংলাদেশের শিক্ষানীতি কেমন হওয়া উচিত—এসব বিষয়ে ধারাবাহিক আলোচনা হয়েছে। কিবরিয়া জানালেন, সব সময় তাঁরা দেশের সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেন। এ ছাড়া ইতিহাস, সাহিত্য, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, রাজনীতিসহ নানান বিষয়ও আলোচিত হয় পাঠচক্রে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেমন তাঁরা ৪ পর্বে পাঠচক্র করেছেন। 

 পুরোনোদের হাত ধরে আসে নতুনেরা
প্রতিটি আসরেই গড়ে ২০ জন সদস্য উপস্থিত থাকেন। নিয়মিত সদস্যদের সঙ্গে থাকেন নতুন সদস্যও। সেদিন যেমন দেখা হলো শুরুর এক সদস্যের সঙ্গে। তিনি মাহবুবুর রহমান। পেশায় ব্যবসায়ী। ১৯৯৬ সাল থেকেই পাঠচক্রে আসা এই সদস্য বলছিলেন, ‘অনেকটা অভ্যাস হয়ে গেছে। চেষ্টা করি কোনো আসর যেন বাদ না যায়। কাজের ফাঁকে জ্ঞানের চর্চার সুযোগ তো কম, এই পাঠচক্রের আসর সেই সুযোগ করে দেয়। নানা মতের, নানা ভাবনার মানুষের সম্মিলন হয় এখানে।’

নতুন এমন ভাবনার মতবিনিময় করার টানেই আসেন ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রাক্তন শিক্ষার্থী শামীম আহমেদও। তেমনি সময় পেলেই হাজির হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইলিয়াস হোসেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমার পরিচিত এক ভাইয়ের কাছে জেনেছিলাম এই পাঠচক্রের আসর সম্পর্কে। একদিন এসেই ভালো লেগে যায়। অনেক অভিজ্ঞ মানুষ এখানে নানা বিষয়ে আলোচনা করেন। ফলে নতুন কিছু জানা যায়, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলো দেখারও সুযোগ পাই।’

পরিচালক কিবরিয়াও বললেন তরুণদের আগ্রহী করার বিষয়টি। নতুন সদস্য এলেই তাঁকে অনুপ্রাণিত করেন নিয়মিত হওয়ার। উপস্থিতি খাতা দেখে নিজেই ফোন করে জানান আলোচনার বিষয় সম্পর্কে। 

 পাঠচক্রের বাইরেও
যাঁরা এসেছিলেন পাঠচক্রে, তাঁরাই হয়েছেন সংগঠিত। তাই শুধু আলোচনা নয়, আয়োজন করছেন বিভিন্ন কর্মশালার। তরুণদের দীক্ষা দিচ্ছেন জীবনমুখী বিভিন্ন বিষয়ে। এ ছাড়া চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, বৃক্ষরোপণ ও রক্তদান কর্মসূচিসহ পাঠচক্রের সদস্যরাই শীতার্ত মানুষের কাছে হাজির হন গরম কাপড় হাতে।

সবাই মিলেই পাঠচক্রের গ্রন্থাগারেও মনোযোগী তাঁরা। তাই দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়েছে বইয়ে, সাময়িকীতে। আলোচনার প্রয়োজনে সহায়ক বইয়ের প্রয়োজন হলে সেই গ্রন্থাগার থেকেই সংগ্রহ করা হয় সেসব। এস এম কিবরিয়া বলছিলেন, ‘ভবিষ্যতে এই পাঠচক্রটিকে বড় পরিসরে একাডেমিক একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যেতে চাই আমি। আমি হয়তো থাকব না, কিন্তু পাঠচক্র যেন চলতে থাকে দিনের পর দিন।’