অনন্য স্বাদের বোবার বিরিয়ানি

এই বিরিয়ানি খাওয়ার সময় আপনার মুখে পড়বে না অযাচিত এলাচ কিংবা লবঙ্গ। বিরিয়ানিতে থাকা মাংসের সঙ্গে আপনাকে কুস্তিও করতে হবে না। দীর্ঘ সময় দমে থাকার কারণে মাংসের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা রস মসলার সঙ্গে জারিত হয়ে যে রসায়ন তৈরি করবে, তা আপনার স্বাদগ্রন্থি মনে রাখবে বহুদিন।

এই অপূর্ব স্বাদের বিরিয়ানি খেতে খেতে আপনি ঘেমে উঠলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের বাতাস পাবেন না। কারণ, এটি কাচে ঘেরা ডাকসাইটে কোনো খাবারের দোকান নয়। অথচ এই দোকানে প্রতিদিন রান্না হয় ৫-৬ ডেকচি বিরিয়ানি। প্রতি ডেকচিতে থাকে ২৫-৩০ কেজি চাল, সমপরিমাণ মাংস এবং ৮-১০ কেজি আলু ও প্রয়োজনীয় তেল-মসলা। অর্থাৎ সারা দিনে এখানে প্রায় ১৫০-১৮০ কেজি চালের বিরিয়ানি রান্না হয়। আর মণের হিসাব করলে তা দাঁড়ায় চার থেকে সাড়ে চার মণ! ঢাকা শহরে বিরিয়ানি খেয়েছেন অনেক। কিন্তু সেরাটা খেয়েছেন কি এখনো? যদি না খেয়ে থাকেন তাহলে আপনাকে ঢাকা শহরের অন্যতম সেরা বিরিয়ানির দোকানের সন্ধান দিচ্ছি।

ঢাকা শহরের অলিগলিতে প্রচুর বিরিয়ানির দোকান থাকলেও এই শহরের অন্যতম সেরা বিরিয়ানি খেতে আপনাকে আসতে হবে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পের প্রথম গেটে। জায়গাটা আপনার খুবই পরিচিত। কারণ, এখানেই কখনো না কখনো আপনি খেয়েছিলেন মোস্তাকিমের চপ। মোস্তাকিমের চপের সুবাস ঠেলে ক্যাম্পের বাজারে সারি সারি কাপড়ের দোকান পেরিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকলে আপনার নাকে আসবে বিরিয়ানির সুবাস। যতই সামনের দিকে এগোতে থাকবেন ততই সুবাস ঘন হতে থাকবে। এই সুবাসই আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে ছোট্ট একটি দোকানের সামনে, যার সাইনবোর্ডে লেখা আছে ‘ফায়জানে মদিনা বিরিয়ানি হাউজ’। কিন্তু এ নামে কেউ চেনে না দোকানটি। চেনে বোবার বিরিয়ানি বলে।

চাইলে আপনি বাসায় নিয়েও যেতে পারেন আপনার পরিমাণমতো। ছবি: লেখক
চাইলে আপনি বাসায় নিয়েও যেতে পারেন আপনার পরিমাণমতো। ছবি: লেখক

১৯৯০ সালে জেনেভা ক্যাম্পের মোহাম্মদ আক্তার হোসেন তাঁর বন্ধু ভোলা বাবুর্চিকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ফায়জানে মদিনা বিরিয়ানি হাউজ’। আক্তার হোসেন ও ভোলা বাবুর্চি দুজনই গত হয়েছেন বেশ অনেক দিন হলো। এখন আক্তার হোসেনের তিন ছেলের বড় ছেলে আফতাবের নেতৃত্বে চলছে এই বিরিয়ানি হাউস। আফতাবকে সহায়তা করছেন তাঁর অন্য দুই ভাই সামসাদ ও ইমরান। ১৯৯৫ সালের দিকে এই দোকানে পরিবেশনকারী হিসেবে কাজে যোগ দেন ক্যাম্পেরই বাক্প্রতিবন্ধী উকিল নামের একজন। ‘ফায়জানে মদিনা’ নামটি স্মরণ রাখার সুবিধার জন্য এখানে বিরিয়ানি খেতে আসা লোকেরা দোকানটিকে ‘বোবা মামার দোকান’ হিসেবে ডাকতে শুরু করেন। এরপর থেকে ‘ফায়জানে মদিনা বিরিয়ানি হাউজ’ বিখ্যাত হয়ে ওঠে ‘বোবার বিরিয়ানি’ নামে। পরে কর্তৃপক্ষ তাদের সাইনবোর্ডে ‘বোবার বিরিয়ানি’ নামটি যুক্ত করে দেয়।

এখানে এসেই বসার জায়গা পাবেন না। অপেক্ষা করতে করতে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আগেই অবশ্য আপনি পেয়ে যেতে পারেন বসার সুযোগ। তারপর অর্ডার করলে পাবেন এক প্লেট বিরিয়ানি—স্পেশাল বা নরমাল। সঙ্গে পাবেন এক টুকরো লেবু। কিন্তু ভুলেও বিরিয়ানির প্লেটে লেবু চটকে নেবেন না। তাহলে বিরিয়ানির স্বাদ মাটি হয়ে যাবে। এবার খেতে খেতে অনুভব করতে থাকুন, কেন আপনি এখানে বিরিয়ানি খেতে এসেছেন।

এই সুস্বাদু কাচ্চি বিরিয়ানি রান্না হয় পরিমিত তেল ও মসলা দিয়ে। ফলে খাওয়ার সময় অপ্রাসঙ্গিক মসলা আপনার বিরিয়ানি উপভোগের বারোটা বাজাবে না। বোবার বিরিয়ানি মূলত কাচ্চি বিরিয়ানি। মাংস ও চাল দীর্ঘ সময় দমে রেখে কাঠের চুলায় রান্না হয় এই বিরিয়ানি। ফলে স্বাদ হয় অনন্য। অন্য দোকানের চেয়ে দাম কম হওয়ার ফলে এখানে মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। এখানে এক প্লেট স্পেশাল বিফ বিরিয়ানির দাম ১২০ টাকা, সাধারণ বিরিয়ানি ৮০ টাকা, হাফ ৫০ টাকা। প্রায় একই দামে খেতে পারবেন মোরগ পোলাও। সকাল ১০টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত যেকোনো দিন আপনিও আসতে পারেন জেনেভা ক্যাম্পে এই বোবার বিরিয়ানি খেতে।

সারা দিনে এখানে প্রায় ১৫০-১৮০ কেজি চাল ও মাংসের বিরিয়ানি রান্না হয়। ছবি: লেখক
সারা দিনে এখানে প্রায় ১৫০-১৮০ কেজি চাল ও মাংসের বিরিয়ানি রান্না হয়। ছবি: লেখক