৪২০ কোটি মানুষই নিজস্ব শৌচাগার-সুবিধাবঞ্চিত

আজ ১৯ নভেম্বর বিশ্ব শৌচাগার দিবস। ‘শৌচাগার দিবস’ বলে দিনটিকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই; বরং প্রয়োজন সচেতন দৃষ্টি। আজ যখন পেঁয়াজের ঝাঁজ নিয়ে সবাই কথা বলছে, তখন এটা নিয়েও কথা বলা উচিত যে পৃথিবীর প্রায় ৭৬৩ কোটি মানুষের মধ্যে আনুমানিক ৪২০ কোটি মানুষ শৌচাগার এবং পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ, প্রতি ১০ জনে ৬ জন বা বিশ্বের ৬০ শতাংশ মানুষের জন্যই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়াটা বেশ কষ্টকর। কারণ, তাদের ঘরে কোনো শৌচাগার বা পায়খানা নেই।

জাতিসংঘের হিসাবমতে, আজও প্রায় ১০০ কোটির বেশি মানুষ খোলা আকাশের নিচে নদী, খালের পাশে, পুকুরের কোনায় বা রাস্তার পাশে শৌচকর্ম (মলত্যাগ) করে। প্রায় ২০০ কোটি মানুষ পানযোগ্য পানি থেকে বঞ্চিত। ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, মানুষের দৈনন্দিন কাজে, শৌচাগারে ও বিভিন্ন শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত পানির ৮০ শতাংশই প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে কোনো পরিশোধন ছাড়া। পৃথিবীতে প্রতি পাঁচটি স্কুলের মধ্যে একটিতে কোনো শৌচাগার নেই। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে বিশেষত নারীশিক্ষায়। কন্যাসন্তানকে স্কুলে না পাঠানোর অন্যতম অজুহাত হিসেবে এই কারণকে দাঁড় করায় অনেক পরিবার। তার চেয়েও বড় কথা, বিশ্বজুড়ে ৯০ কোটি স্কুলপড়ুয়ার হাত ধোয়ার কোনো সুবিধা নেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে। এটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এক উদরাময় রোগের কারণে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে চার লাখ মানুষ অকালে প্রাণ হারায়। আর যেখানে-সেখানে মানববর্জ্যের উপস্থিতির কারণে যে দূষণ, তার সবচেয়ে বড় শিকার নারী ও শিশুরাই। এবার তো মানতে হবে যে গুরুত্ব বিবেচনায় শৌচাগার প্রসঙ্গটি পেঁয়াজের চেয়ে পিছিয়ে তো নয়ই, বরং এগিয়ে।

স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনা করেই বিশ্ব শৌচাগার দিবস পালন শুরু হয়। ২০০১ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে এলেও ২০১৩ সালে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে এর স্বীকৃতি দেয়। দিনটির উদ্দেশ্য স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সবার জন্য শৌচাগারের সুবিধা নিশ্চিত করা।

প্রসঙ্গক্রমে জানিয়ে রাখি, ‘ল্যাট্রিন’ (latrine) শব্দটি ল্যাটিন ‘লাভার’ (lavare) শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘ধৌত করা’। ইংরেজিতে এ শব্দ ব্যবহারের নজির পাওয়া যায় সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে। অন্যদিকে, ‘তয়লেত’ শব্দটি ফরাসিদের সৃষ্ট। ‘তোয়াল’ অর্থাৎ ‘টুকরো কাপড়’ থেকে এই ‘তয়লেত’ শব্দটির আবির্ভাব। চেনা যাচ্ছে কি? হ্যাঁ, চালু বাংলায় যা ‘টয়লেট’, তা–ই এসেছে এই ‘তয়লেত’ থেকে। ফরাসিতে ‘তয়লেত’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘সাজঘর’, যেখানে হাত-মুখ ধোয়ামোছা থেকে শুরু করে শৌচকর্ম এবং স্নানও করা যায়; নেওয়া যায় খানিকটা সাজও। এখানে আরেকটি কথা বলে রাখা ভালো যে ‘তয়লেত’ লিখতে বা উচ্চারণ করতে ‘ট’ নিয়ে টানাটানির কোনো কারণ নেই। অবশ্য ফরাসি উচ্চারণ মানলে। ফরাসিতে ‘ট’ নেই; আছে ‘ত’।

সে যা-ই হোক, দেশভেদে ‘ল্যাট্রিন’ বিভিন্ন নাম নিয়েছে। যেমন আমাদের দেশে শহুরে মানুষ ‘পায়খানা’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না, তাই ‘ল্যাট্রিন’, ‘টয়লেট’ ইত্যাদিকে বেছে নিয়েছে। গ্রামের মানুষের অবশ্য তেমন বাছবিচার নেই। তারা ‘পায়খানা’ বা ‘টাট্টি’ বলতেই স্বচ্ছন্দ। পশ্চিমের নানা দেশের অনুকরণে তুলনায় সমাজের উচ্চ শ্রেণি ‘রেস্টরুম’, ‘ওয়াশরুম’ শব্দ ব্যবহার করে শৌচাগার বোঝাতে। এই ‘রেস্টরুম’ শব্দের সঙ্গেও অবশ্য মজার একটি গল্প জড়িয়ে আছে। শৌচাগার বোঝাতে এই শব্দের ব্যবহারটি এসেছে ব্রিটিশদের কাছ থেকে। জীবনের অবিচ্ছেদ্য ক্রিয়াটি কোথায় সারবেন, সে প্রশ্নটি চোস্ত ব্রিটিশদের পক্ষে অন্য কাউকে করাটা ছিল ভীষণ অস্বস্তিকর। তাই তারা প্রশ্ন করতেন ‘হয়্যার ইজ দ্য রেস্ট অব দ্য রুম?’ এ প্রশ্নের অর্থই হচ্ছে, প্রশ্নকর্তা আদতে ইনিয়ে-বিনিয়ে শৌচাগারের অবস্থানটি জানতে চাইছেন। এই ‘রেস্ট অব দ্য রুম’-এরই সংক্ষিপ্ত রূপ এই ‘রেস্টরুম’। বিষয়টি মোটেই ‘বিশ্রামকক্ষের’ মতো কিছু নয়।

আমাদের দেশে এমন একটা সময় ছিল, যখন মানুষ ঘরের ভেতরে শৌচাগার রাখার কথা কল্পনাও করতে পারত না। চলতি বাংলায় ‘পায়খানা’ শব্দটি উচ্চারণমাত্রই নাক কুঁচকে যেত ঘৃণায়। অথচ ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, খ্রিষ্টের জন্মের তিন হাজার বছর আগে শৌচাগার ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। ২৮০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে মহেঞ্জোদারোতে বাড়ির আঙিনায় দেয়ালের সামনে কিছুটা উন্নত মানের শৌচাগার ছিল।

বেশি দিন আগের কথা নয়, ঢাকা নগরীর একটি এলাকার মানুষ ওয়াসার পানির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সরবরাহের পানি ঘোলা ও দুর্গন্ধযুক্ত বলে কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁরা। কর্তৃপক্ষ শুরুতে বিষয়টি আমলে নেয়নি। পরে অবশ্য অভিনব আন্দোলনের সুবাদে অভিযোগটি আমলে নিতে তারা বাধ্য হয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা বাহুল্য হবে যে প্রায় তিন দশক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সময় ঢাকা নগরীর আশপাশের পাঁচটি এলাকার নলকূপের পানি পরীক্ষা করেছিলাম। এতে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট এলাকার পানি মানুষের মলের ক্ষতিকারক অণুজীব (ব্যাকটেরিয়া) দ্বারা প্রচণ্ডভাবে দূষিত। আমি আমার অভিসন্দর্ভে পানির করুন এ চিত্র তুলে ধরেছিলাম। সাধারণত, নলকূপের পানি নিরাপদ মনে করে পান করা হয়। অথচ ভূগর্ভস্থ পানির এমন শোচনীয় অবস্থা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি বিবেচনায় তখনকার প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকাগুলো আমার গবেষণার ফলাফল ফলাও করে প্রচার করেছিল।

একটা সময় বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অধিকাংশ বাড়ির কোনায় খোলা শৌচাগার দেখা যেত। খালের পাশে, পুকুরের কোনায় থাকত মলত্যাগের স্থান। এখন পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। সরকারি হিসাব বলছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিবার স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার ব্যবহার করছে। কিন্তু আজও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারসুবিধা থেকে বঞ্চিত নাগরিকের সংখ্যা নগণ্য নয়। পানিবাহিত অণুজীব, ভাইরাসের কারণে মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান আছে কি না, তা আমার জানা নেই। তবে শুধু একটা ধারণা পাওয়ার জন্য বলছি যে মানুষের এক গ্রাম আর্দ্র মলে ১০ হাজার কোটি ব্যাকটেরিয়া স্বচ্ছন্দে বাস করতে পারে। কৃমি, ভাইরাস ও অন্যান্য অণুজীবের কথা নাহয় বাদই থাকল।

একজন মানুষ গড়ে দিনে ৪৫০ গ্রাম মল ত্যাগ করে। এই পরিমাণ মলে ৫০ শতাংশ ব্যাকটেরিয়া বেঁচে থাকলেও সংখ্যা বিচারে তা বিপুল। প্রাকৃতিক, কৃত্রিম ও ভূগর্ভস্থ জলাধারগুলো প্রতিনিয়ত মানুষের মলে দূষিত হচ্ছে। এর সঙ্গে রয়েছে শিল্পকারখানার অনিয়ন্ত্রিত বর্জ্য। সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে, এসব অণুজীব অধিক হারে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জন করছে। খোলা স্থানে, নদী-নালায়, পুকুরে মল-মূত্রত্যাগ জনস্বাস্থ্যের জন্য অতিমাত্রায় বিপজ্জনক। বিশ্ব শৌচাগার দিবস এই অধিকারবঞ্চিত বিশাল জনগোষ্ঠীর কথা মনে করিয়ে দেয়।

বিষয়টির দিকে স্বাস্থ্য খাতে হওয়া ব্যয় বিবেচনায়ও গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এক হিসাবে দেখা গেছে, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার স্থাপনে এক মার্কিন ডলার খরচ করলে তা স্বাস্থ্য খাতে সাশ্রয় করে তিন থেকে চার ডলার। ব্যাপকভাবে কমে আসে স্বাস্থ্যঝুঁকি। একটি শৌচাগারকে শুধু একটি সুবিধা নয়; সুস্থ, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য এটি অপরিহার্য। টেকসই উন্নয়নের ধারণাকে বাস্তব রূপ দিতে হলে আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের বিকল্প কিছু নেই।

লেখক: অণুজীববিজ্ঞানী ও ফরাসি বিচার বিভাগে বিশেষজ্ঞ হিসেবে কর্মরত।