বিচ্ছেদের পরও

আইনগতভাবে বিচ্ছেদ মানেই শত্রু নয়, বরং একজনের প্রয়োজনে আরেকজন পাশে থাকতে পারেন বন্ধু হয়ে। মডেল: বাপ্পা ও সোহানী, ছবি: অধুনা
আইনগতভাবে বিচ্ছেদ মানেই শত্রু নয়, বরং একজনের প্রয়োজনে আরেকজন পাশে থাকতে পারেন বন্ধু হয়ে। মডেল: বাপ্পা ও সোহানী, ছবি: অধুনা

অনেক চেষ্টা করেও সংসারটা আর টেকাতেই পারছিলেন না আসিফ আর শিলা (ছদ্মনাম)। তিন বছরের সংসারের শুরু থেকেই পারিবারিক কারণে নিজেদের মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। পরে নিজেদের সমঝোতাতেই তালাকপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আসিফ ব্যাংকার, শিলা শিক্ষকতা করেন একটি স্কুলে। বিয়ের পরপরই আসিফ যে ব্যাংকে চাকরি করেন, সেখানে একটি ফিক্সড ডিপোজিটের জন্য অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলেন। তালাকের প্রায় কয়েক মাস পর শিলা আসিফকে অনেকটা ইতস্তত ভাব নিয়েই ফোন দেন এবং বলেন যে ব্যাংকের টাকা তুলতে তার সহযোগিতা লাগবে। আসিফও বিষয়টি সহজভাবে নেন, পরদিন আসতে বলেন। শিলা পরদিন ব্যাংকে আসেন এবং আসিফ তাকে বন্ধুর মতোই সহযোগিতা করেন।

পাঁচ বছর ধরে সংসার করার পর রাশেদ ও আশার (ছদ্মনাম) বিবাহবিচ্ছেদ হয়। আশাই রাশেদকে তালাক দেন। তাদের তিন বছরের মেয়ে। রাশেদ বিচ্ছেদ মেনে নিলেও তার মেয়ের সঙ্গে দেখা করার বিষয় নিযে সন্দিহান ছিলেন। আশাকে কীভাবে বলবেন বা বলাটা যোক্তিক হবে কি না, এ বিষয়ে তিনি ভেবে উঠতে পারছিলেন না। শরণাপন্ন হলেন আইনজীবীর। আইনজীবীর কথামতো প্রথমেই মামলা মোকদ্দমায় না গিয়ে আসিফ আশাকে সরাসরিই বললেন তাঁর মেয়ের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা করতে চান। আশাও রাজি হয়ে গেলেন। তালাকের নোটিশ পাওয়ার কয়েক দিন পর থেকেই ফোনে আগে কথা বলে দেখা করার জায়গা ঠিক করে নেন দুজনই। কথামতো মেয়েকে নিয়ে হাজিরও হন আশা। মেয়ের সঙ্গে বাবার এ রকম দেখা–সাক্ষাৎ চলতে থাকে। মাঝেমধ্যে আশা থাকেন পাশেই, আবার রাশেদের কাছে মেয়েকে রেখে নিজের কাজও সামলে আসেন। মেয়ের বিষয়ে রাশেদের সঙ্গে তাঁর আলাদা একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক যেন গড়ে উঠেছে।

এ দুটি ঘটনার মতো তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের পর সাবেক স্বামী–স্ত্রীর একে অপরের সহায়তায় এগিয়ে আসার দৃশ্য খুব আস্বাভাবিক নয়। বিচ্ছেদের পরও ন্যায়সংগত বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ থাকাটা বরং ইতিবাচক। এতে অনেক ধরনের আইনগত জটিলতা থেকেও দূরে থাকা যায়। এমনকি দুই পরিবারের মধ্যেও ইতিবাচক মনোভাব থাকতেও দেখা যায়। একসময় ছিল, সমাজে সাবেক স্বামী বা স্ত্রী মানেই ধরা হতো নিষিদ্ধ কেউ। এখন এ ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। একে অপরের সহযোগিতা দরকার হলে যে কেউ সহজভাবে এগিয়ে আসতে পারেন। এ থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠতেই পারে। বিশেষ করে সন্তান যদি থাকে, তবে এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমনও হয়, দুজনের কেউ অন্যত্র বিয়ে না করলে তারা পরস্পরের ভুল বুঝতে পারে কিংবা নিজেদের আগের সম্পর্কটা উপলব্ধি করতে পারেন। এ উপলব্ধি থেকে তারা পুনরায় বিয়ের বন্ধনেও আবদ্ধ হতে পারেন।

যা জানতে হবে

আইন অনুযায়ী তালাকের নোটিশ পাঠানোর পর ৯০ দিন ইদ্দতকাল থাকে। এ সময়ে তালাক কার্যকর হয় না। এই ৯০ দিনের মধ্যে দুজনই ইচ্ছে করলে তালাক প্রত্যাহার করে নিয়ে সংসার শুরু করতে পারেন। এ সময় স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে হয়। সন্তান থাকলে তার ভরণপোষণ দিয়ে যেতে হয়—সন্তান সাবালক এবং কিছু ক্ষেত্রে কর্মক্ষম না হওয়া পর্যন্ত। আর স্ত্রীর দেনমোহর অবশ্যই প্রদান করতে হয়। তবে স্ত্রী যদি তাঁর দেনমোহরের দাবি ছেড়ে দেন, সেটা ভিন্ন। ইদ্দতকালের পর যদি স্বামী–স্ত্রী পুনরায় মনে করেন যে তারা বিয়ে করবেন, সে ক্ষেত্রে নিজেরা আবার বিয়ে সম্পন্ন করতে পারবেন।

সন্তানের কল্যাণের জন্য সাবেক স্বামী–স্ত্রী নিজেরা আলাপ–আলোচনা করে সন্তানের দেখভালের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই ভালো। সাধারণত ছেলেসন্তান সাত বছর পর্যন্ত এবং মেয়ে বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের হেফাজতেই থাকে। তবে এ বিষয় মামলা পর্যন্ত গড়ালে সন্তানের ভালোর দিকটিই আদালতের কাছে গুরুত্ব পায়। অনেক সময় সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্বের বিষয়টি আদালতে গড়ালে আদালতে দুজন মিলেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকে। নিজেরা আপসনামার মাধ্যমে মামলা শেষ করেও ফেলেন। এ ধরনের সিদ্ধান্ত সন্তান ও তার মা–বাবার জন্যও ইতিবাচক।

যা করা যাবে না

তালাক কার্যকর হওয়ার আগে অর্থাৎ ইদ্দতকালে অন্যত্র বিয়ে করা যায় না। সাবেক স্বামী বা স্ত্রীর যে কেউ অন্য কোথাও বিয়ে করলে তারা পুনরায় নিজেদের মধ্যে বিয়ে করতে পারবেন না। আইনে দ্বিতীয় বিয়ে নিষেধ রয়েছে। যদি দ্বিতীয় বিয়ে করতেই হয়, সালিস পরিষদের মাধ্যমে বর্তমান স্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে। দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মাত্রা কেমন থাকবে, এটা মূলত নিজেদের ওপরই নির্ভর করে। কোনো অনৈতিক সম্পর্ক বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের নামে কোনো ছলচাতুরীর সম্পর্ক থেকে কিন্তু অপরাধও সংঘটিত হতে পারে। এ জন্য ব্যভিচার বা দণ্ডবিধি অনুসারে বিয়েসংক্রান্ত অপরাধে অপরাধীও হতে হবে। এটা সন্তানের জন্যও মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনবে।

জীবন নদীর মতোই যেন এঁকেবেঁকে চলে। এই গতিপথে কখনো বিবাদ কিংবা ভুল–বোঝাবুঝিতে নিজেদের মধ্যে যেমন বিচ্ছেদেও ঘটতে পারে, তেমনি বিচ্ছেদের পরে একে অপরের সহায়তায় বন্ধুত্বের হাতও প্রসারিত করা যেতেই পারে। বিশেষ করে সন্তানের ভবিষ্যৎ এবং তার মানসিক বিকাশের জন্য সাবেক দুজন স্বামী–স্ত্রী বর্তমানে বন্ধু হয়ে থাকতেই পারেন। খুবই স্বাভাবিক এটা। তবে এর মধ্যে কোথাও থামতে হবে কি না কিংবা কোনো নতুন জটিলতা শুরু হবে কি না, তা নিজেদেরই বুঝতে হবে। খুঁজতে হবে সুন্দর সমাধানও।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট