দিল্লি তেমন দূরে নয়

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৭০ হাজার ব্রিটিশ ভারতীয় সেনার স্মরণে বানানো ইন্ডিয়া গেট।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৭০ হাজার ব্রিটিশ ভারতীয় সেনার স্মরণে বানানো ইন্ডিয়া গেট।

একটা কথা মাঝেমধ্যেই বলা হয়, দিল্লি অনেক দূর। সাধারণত দূরের ও বন্ধুর পথ বোঝাতে এমনটি বলা হয়। তবে যোগাযোগের এই জামানায় ভারতের দিল্লি মোটেও দূর নয়। আকাশপথে আড়াই ঘণ্টার দূরত্ব। এতে জনপ্রতি যাওয়া-আসার খরচ ২০ হাজার টাকা।

তবে কেউ যদি আগেই প্ল্যান ঠিক করে প্লেনের টিকিটটা করে ফেলতে পারেন, খরচটা আরেকটু কমবে। আবার ট্রেনে করে গেলে খরচ অনেক কমে যাবে। ঢাকা থেকে বাসে বা ট্রেনে কলকাতা গিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে করে দিল্লি যেতে পারেন। খরচের ধকল কম হলেও শরীরের ধকলটা বেশ ভালোভাবেই টের পাওয়া যায়। আর থাকার জন্য দিল্লিজুড়েই নানা মানের ও দামের হোটেল আছে। বেছে নিতে পারেন যেকোনোটি।

নতুন আর পুরোনো মিলিয়ে দিল্লি একটা মিশ্র শহর। একদিকে আধুনিক সব সুউচ্চ ভবন, অন্যদিকে শত শত বছরের পুরোনো স্থাপনা, ইতিহাসের হাতছানি। গ্রীষ্মকালে দিল্লিতে বেশ গরম পড়ে। শীত ও বসন্তকাল দিল্লি ভ্রমণের জন্য আদর্শ সময়।

প্রায় ২৪০ ফুট উচ্চতার কুতুব মিনার। এটি এখন ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।
প্রায় ২৪০ ফুট উচ্চতার কুতুব মিনার। এটি এখন ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।


১.
দিল্লিদর্শন শুরু করতে পারেন ইন্ডিয়া গেট দেখার মধ্য দিয়ে। আপনি শহরের যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, অটোচালক বা উবার চালককে বললে আপনাকে ইন্ডিয়া গেট নিয়ে যাবেন।

মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসার অপূর্ব নিদর্শন তাজমহল।
মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসার অপূর্ব নিদর্শন তাজমহল।

এটি মূলত একটি স্মৃতিস্তম্ভ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত ৭০ হাজার ব্রিটিশ ভারতীয় সেনার স্মরণে এটি বানানো হয়। উচ্চতা প্রায় ১৪০ ফুট। ইন্ডিয়া গেটের ভেতরের দিকে আছে ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ নামের একটি স্থাপনা। কালো রাইফেলের মাথায় সৈনিকের হেলমেট আর পাশে জ্বলছে আগুন। অনেকটা আমাদের শিখা চিরন্তন ও শিখা অনির্বাণের মতো। এই ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ বানানো হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সেনাদের স্মরণে। এখানে যুদ্ধের স্মৃতি রক্ষার একটি জাদুঘরও আছে।

২.
ইন্ডিয়া গেট থেকে বের হয়ে সোজা তাকালেই চোখে পড়বে বেশ দূরের রাষ্ট্রপতি ভবন। রাস্তার মাথা থেকে অটো নিতে পারেন। ১০০ থেকে ১৫০ রুপি পড়বে। রাষ্ট্রপতির ভবনের কাছে নিয়ে নামিয়ে দেবে। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান যেখানে থাকেন, তার কিছু অংশ সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত। এ জন্য আগে থেকে অনলাইনে নিবন্ধন করতে হবে। আর এই সুযোগ বৃহস্পতি থেকে রোববার সকাল নয়টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত থাকে। পাশেই আছে পার্লামেন্ট। সেটি অবশ্য বাইরে থেকেই দেখতে হবে। ভেতরে ঢোকার কোনো সুযোগ নেই।

৩.
এখান থেকে চলে যেতে পারেন পুরোনো দিল্লির জামা মসজিদে। লাল বেলেপাথর ও সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি এই মসজিদ। ষোড়শ শতকের মাঝামাঝি এটি নির্মাণ করেন মুঘল সম্রাট শাহজাহান। এটি ভারতের অন্যতম বড় মসজিদ। এখানে একসঙ্গে ২৫ হাজারের বেশি মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।

শত বছরের পুরোনো করিম’স হোটেলের মুখে জল আনা সুস্বাদু সব খাবার।
শত বছরের পুরোনো করিম’স হোটেলের মুখে জল আনা সুস্বাদু সব খাবার।


৪.
সকাল থেকে এত স্থান দর্শনের পর ক্ষুধা চরমে ওঠে যায়। পেট ভরে খাওয়ার জন্য পাশেই আছে বিখ্যাত করিম’স হোটেল। সেই ১৯১৩ সাল থেকে সাধারণ মানুষের জন্য রাজকীয় মুঘল খাবার পরিবেশন করে আসছে তারা। করিমের বিরিয়ানির পাশাপাশি কাবাব, মাংসের নানা পদ আর ক্ষীরের স্বাদ মুখে লেগে থাকার মতো। করিমের আশপাশের দোকানেও পাবেন সুস্বাদু বিচিত্র সব খাবার।

লাল বেলেপাথরের বিশাল উঁচু প্রাচীরে ঘেরা এই কেল্লা। আর এই রংটার কারণেই মূল নাম হারিয়ে এর নাম হয়ে গেছে লাল কেল্লা বা রেড ফোর্ট।
লাল বেলেপাথরের বিশাল উঁচু প্রাচীরে ঘেরা এই কেল্লা। আর এই রংটার কারণেই মূল নাম হারিয়ে এর নাম হয়ে গেছে লাল কেল্লা বা রেড ফোর্ট।


৫.
খেয়েদেয়ে কিছুটা জিরিয়ে যেতে পারেন রেড ফোর্টে। ষোড়শ শতকে মুঘল সম্রাট শাহজাহান আগ্রা থেকে যখন দিল্লিতে থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, তখন এটি নির্মাণ করেন। এর নকশা করেছেন তাজমহলের প্রধান স্থপতি আহমেদ লাহরি। শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে লাল বেলেপাথরের বিশাল উঁচু প্রাচীরে ঘেরা এই কেল্লা। আর এই রংটার কারণেই মূল নাম হারিয়ে এর নাম হয়ে গেছে লাল কেল্লা বা রেড ফোর্ট। সাধারণ মানুষের জন্য দেওয়ান-ই-আম, বিশেষ মানুষের জন্য দেওয়ান-ই-খাস, রংমহল, খাসমহল, মমতাজ মহল, হীরা মহল—কত্ত কিছু!

মহলগুলো ছিল দামি আর শৌখিন জিনিসে সাজানো। কিন্তু ইংরেজরা এসবের প্রায় পুরোটাই লুটে নেয়। কোহিনূর হীরা, বাহাদুর শাহ জাফরের মুকুট থেকে শুরু করে প্রাসাদের কক্ষের দেয়ালে থাকা দামি শিল্পকর্ম—কিছুই বাদ যায়নি এই লুট থেকে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে নজর কাড়ে নহর-ই-বেহেশত (স্বর্গের স্রোতস্বিনী)। এটি পুরো কেল্লায় নির্বিঘ্ন পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দিল্লির চরম গরমে কেল্লাবাসীকে শীতলতা উপহার দিত। এই কেল্লার ভেতরে পানি ব্যবস্থাপনার যে অসাধারণ পদ্ধতি ছিল, তা রীতিমতো বিস্ময়কর।

পদ্ম ফুলের আকারে নির্মিত এই স্থাপনা বাহা সম্প্রদায়ের প্রার্থনালয়। এটি লোটাস টেম্পল নামে পরিচিত।
পদ্ম ফুলের আকারে নির্মিত এই স্থাপনা বাহা সম্প্রদায়ের প্রার্থনালয়। এটি লোটাস টেম্পল নামে পরিচিত।

শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে ১৮৫৭ সালে ইংরেজরা বন্দী করে এই কেল্লাতেই রাখে। পরে তাঁকে রেঙ্গুনে (বর্তমান মিয়ানমার) নির্বাসনে পাঠায়। এভাবেই শেষ হয় মুঘল সাম্রাজ্যের। তবে ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকে ওই কেল্লা তার সম্মান ফিরে পেতে শুরু করে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু এই কেল্লায় স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করে ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই থেকে আজও প্রতিটি স্বাধীনতা দিবসে এখানে দাঁড়িয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী।

৬.
দ্বিতীয় দিন সকাল সকাল বের হয়ে চলে যেতে পারেন লোটাস টেম্পলে। এটি আসলে বাহা সম্প্রদায়ের প্রার্থনালয়। তবে এখানে যেকোনো ধর্মের বা বিশ্বাসের মানুষ গিয়ে নীরবে বসে প্রার্থনা করতে পারেন। ভেতরের অদ্ভুত নীরবতা আপনাকে অন্য রকম শান্তি দেবে।

৭.
এই শান্তিকে সঙ্গী করে চলে যান শহরের আরেক প্রান্তের কুতুব মিনারে। দিল্লির অন্যতম দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থাপনা প্রায় ২৪০ ফুট উচ্চতার কুতুব মিনার। দ্বাদশ শতকের শুরুর দিকে এর যাত্রা। এত পুরোনো স্থাপনা বলেই এটি ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এখন।

কুতুব মিনার।
কুতুব মিনার।

বহু শতকের পুরোনো বলে এর সঠিক ইতিহাস নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আছে। তবে প্রচলিত ইতিহাস হলো—এই মিনারের নির্মাণ শুরু করেছিলেন কুতুবউদ্দিন আইবেক। তুর্কিস্থানের (মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত) জন্ম নেওয়া কুতুবকে ছোটবেলায় দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়। তাঁর ঠাঁই হয় ইরানে। সেখানে সমরবিদ্যায় পারদর্শী হন তিনি। এরপর তাঁকে আফগানিস্তানে বিক্রি করে দেওয়া হয়। যোদ্ধা হয়ে দক্ষতা দেখাতে দেখাতে তিনি একদিন দিল্লির সালতানাতে বসেন। তাঁর হাত ধরেই নির্মিত হয় কুতুব মিনার।

৮.
দিল্লি স্বনামধন্য তার স্ট্রিট ফুড আর কেনাকাটার জন্য। এ দুটোর স্বাদ নিতে কুতুব মিনার থেকে চলে যেতে পারেন সরোজিনী মার্কেটে। এখানে পানিপুরি, পাউভাজি, দোসাসহ নানা সুস্বাদু খাবার চাখতে পারেন বেশ কম দামে। এ ছাড়া এখানে কম দামে বেশ ভালো জিনিস পাওয়া যায়। পাশের দিল্লি হাটে পাবেন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী নানা জিনিস। সরকারি ব্যবস্থাপনার এই হাটে মনের মতো জিনিস কেনা যায় উপযুক্ত দামে।

তাজমহলের শুভ্রতা মনকে স্নিগ্ধ করে।
তাজমহলের শুভ্রতা মনকে স্নিগ্ধ করে।


৯.
দিল্লি পর্যন্ত গিয়ে আগ্রার তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট ও ফতেহপুর সিক্রি না দেখে ফেরাটা ভারী অন্যায় হয়ে যায়। দুই দিন দিল্লিতে ঘোরাঘুরির পর তৃতীয় দিনটা রাখতে পারেন আগ্রা ভ্রমণের জন্য। হোটেলের লোকজনকে বললেই গাড়ির ব্যবস্থা করে দেবে। সকাল ৬টায় রওনা দিলে ১০টার মধ্যে তাজমহলে চলে যাওয়া যায়। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের ভালোবাসার অপূর্ব নিদর্শন তাজমহল মুগ্ধতার আবেশ ছড়াবেই। এত দিন যে তাজমহলকে ছবিতে কিংবা ভিডিওতে দেখেছেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে আপনার মনটাও ভালোলাগায় ভরে উঠবে।

আগ্রায় মুঘল শাসকেরা যে কেল্লায় থাকতেন, তা আগ্রা ফোর্ট নামে পরিচিত। এর স্থাপত্য শৈলীতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দিল্লির রেড ফোর্ট বানানো হয়েছিল। আগ্রার অন্যতম বিস্ময় পঞ্চদশ শতকের শেষ ভাগে মুঘল সম্রাট আকবরের বসতি ফতেহপুর সিক্রি। আকবরের নবরত্ন সভা, রানি যোধাবাঈয়ের মহল, সুলতানা রোকাইয়ার মহল, তানসেনের গানের মঞ্চ শত শত বছরের পুরোনো ইতিহাসকে আপনার কাছে জীবন্ত করে তুলবে।

ফতেহপুর সিক্রিতে মুঘল সম্রাট আকবরের নবরত্নের একজন ছিলেন গায়ক তানসেন। এই মঞ্চে গান গাইতেন তিনি।
ফতেহপুর সিক্রিতে মুঘল সম্রাট আকবরের নবরত্নের একজন ছিলেন গায়ক তানসেন। এই মঞ্চে গান গাইতেন তিনি।


১০.
তিন দিনে দিল্লি আর আগ্রা দর্শন হয়ে যায়। এরপর ফেরার পালা। তবে ফেরার আগে অবশ্যই দিল্লির লাড্ডু চেখে দেখবেন। কারণ, দিল্লির লাড্ডু খেলেও পস্তাতে হয়, না খেলেও। তাই খেয়ে পস্তানোটাই বুদ্ধিমানের কাজ। চাইলে বন্ধু-স্বজনের জন্যও নিয়ে আসতে পারেন। লাড্ডু খেয়ে তাঁরাও না হয় পস্তাল!