খাবার পাতে দেশের খাবার

বাংলাদেশের একেক অঞ্চলের খাবারের স্বাদ একেক রকম। রান্নার উপকরণ আর রন্ধনপ্রণালীর জন্য স্বাদে চলে আসে ভিন্নতা। আমাদের দেশের খাবারের বৈশিষ্ট্য এমনই। চট্টগ্রাম, খুলনা, কুষ্টিয়া, রংপুর, সিলেট ও ঢাকার কিছু খাবারের রেসিপি থাকছে এবার।

সিলেট
রেসিপি: কুমকুম হাজেরা

লাইপাতার ভর্তা
লাইপাতার ভর্তা

লাইপাতার ভর্তা
উপকরণ: লাইপাতা বা লাইশাক ২ আঁটি, পেঁয়াজকুচি ১টি, শুকনা মরিচভাজা অর্ধেকটি, কাঁচা মরিচকুচি অর্ধেকটি, ধনেপাতা আধা টেবিল চামচ, যেকোনো ভাজা মাছ ১ বা ২ টুকরা, লবণ পরিমাণমতো।
প্রণালি: লাইপাতা আস্ত ভালোভাবে ধুয়ে মাঝখানের শক্ত ডাঁটা ছাড়িয়ে নিতে হবে (যেভাবে পানের ডাঁটা ফেলা হয়)। এবার যতটা সম্ভব কুচি কুচি করে নিয়ে এক পাত্রে রেখে লবণ মাখিয়ে কচলাতে হবে। কচলে সবুজ রস বের করে ফেলে দিতে হবে। এবার ভাজা মাছের কাঁটা ফেলে ঝুরঝুরে লাইপাতা, মরিচ, পেঁয়াজ, ধনেপাতায় মাখাতে হবে। লবণের পরিমাণ বুঝতে একবার চেখে নিতে হবে। হয়ে গেল সতেজ লাইপাতার ভর্তা। শীত মৌসুমে গরম ভাতের সঙ্গে প্রথম পাতের খাবার হিসেবে সিলেটে এটি বেশ পুরোনো এবং এখনো প্রচলিত।

চট্টগ্রাম
রেসিপি : রওশন আরা বেগম

জুত্তাইন্যা মাছ
জুত্তাইন্যা মাছ

জুত্তাইন্যা মাছ
উপকরণ: লইট্যা মাছ ১ কেজি, চিংড়ি মাছ (বা যেকোনো ছোট মাছ) ২৫০ গ্রাম, মরিচবাটা ৩ টেবিল চামচ, হলুদবাটা আধা চা-চামচ, পেঁয়াজকুচি ১ কাপ, সরিষার তেল ২ টেবিল চামচ, ধনেপাতাকুচি ১ কাপ, কাঁচা মরিচ ৬টি, বিলম্বি ৪-৫টি (২ টুকরো করে কাটা) বা টমেটো ও লবণ পরিমাণমতো।
প্রণালি: দুই রকমের মাছ পরিষ্কার করে কেটে লবণ, হলুদ ও লেবুর রস দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। হাঁড়িতে মাছ নিয়ে ধনেপাতা ছাড়া অন্য সব উপকরণ দিয়ে ভালোভাবে মেখে ঢাকনা দিয়ে জ্বালে বসাতে হবে। ১০-১৫ মিনিট পর ধনেপাতা দিয়ে নামিয়ে নিন। মাঝে ঢাকনা খোলা যাবে না। বেশি জ্বাল দিলে স্বাদ নষ্ট হয়ে যাবে। মাঝারি আঁচে রান্না করতে হবে।

কাঁচা মরিচে নারকেল মুরগি
কাঁচা মরিচে নারকেল মুরগি

কাঁচা মরিচে নারকেল মুরগি
উপকরণ: মুরগি দেড় কেজি, নারকেলবাটা ১ কাপ, ধনেবাটা ২ টেবিল চামচ, জিরাবাটা ১ টেবিল চামচ, কাঁচা মরিচবাটা ৩ টেবিল চামচ (স্বাদমতো), হলুদবাটা আধা টেবিল চামচ, পেঁয়াজবাটা আধা কাপ, আদাবাটা ২ টেবিল চামচ, রসুনবাটা ১ টেবিল চামচ, এলাচি ৫টি, দারুচিনি ১ ​ইঞ্চি করে ৩-৪টা, তেজপাতা ৪টি, লং ৫-৬টি, গোলমরিচ (কালো) ১৫ থেকে ২০টি, সয়াবিন তেল ৩ টেবিল চামচ, লবণ পরিমাণমতো ও ধনেপাতা ২ টেবিল চামচ।
প্রণালি: মুরগি ছোট টুকরো করে কেটে ধুয়ে রাখতে হবে। হাঁড়িতে তেল দিয়ে ধনেপাতা ছাড়া সব উপকরণ দিয়ে ভালোভাবে কষাতে হবে। কষানো হয়ে গেলে মাংস দিয়ে আবার কষাতে হবে।
মাংস কষা হলে নারকেল দিয়ে ঢেকে মাঝারি আঁচে রান্না করতে হবে। মাংস সেদ্ধ হয়ে এলে পছন্দমতো পানি দিয়ে বলক উঠলে ধনেপাতা দিয়ে নামাতে হবে। সাদা ভাত ও রুটি দিয়ে এই মাংস খেতে ভালো লাগবে। এ ছাড়া পোলাও, ভাপা পিঠা দিয়েও খেয়ে দেখতে পারেন। এ পদ রান্নার জন্য চামড়াসহ দেশি মুরগি হলে বেশি ভালো হয়।

কুষ্টিয়া
রেসিপি : আব্দুল মজিদ

তিলের খাজা
তিলের খাজা

তিলের খাজা
উপকরণ: চিনি ৭ কেজি, দুধ মেশানো পানি আধা লিটার, পানি ৪ লিটার, তিল দেড় কেজি ও এলাচি পরিমাণমতো।
প্রণালি: তিল ছাড়া সব উপকরণ কড়াইয়ে নিয়ে অন্তত ১০ থেকে ১২ মিনিট ফুটাতে হবে। এরপর উত্তপ্ত চিনির ‘লই’ পরিষ্কার জায়গায় ঠান্ডা হওয়ার জন্য ৫ মিনিট ঢেলে রাখতে হবে। লই উঠিয়ে একটি হুকে (শিং বলে) বেঁধে টানতে হবে। কয়েক মিনিট পর দুজন ধরে সেটা টেনে টেনে লম্বা করতে হবে। এতে ভেতরে ফাঁপার সৃষ্টি হয়। ফাঁপা অংশকে বারবার ভাঁজ করতে হবে, যাতে অনেকগুলো ছিদ্র হয়। এরপর কাঠের টেবিলে কিছুক্ষণ রেখে দিন। সুবিধা আকারে কেটে নিতে পারেন। কাটা অংশগুলোয় পরবর্তী সময়ে হাত দিয়ে তিল মাখাতে হবে। ব্যস, হয়ে গেল বিখ্যাত তিলের খাজা।
আবদুল মজিদ কুষ্টিয়া শহরের মিলপাড়ায় ৪৬ বছর ধরে তিলের খাজা তৈরি করে আসছেন। ১৫ থেকে ১৬ জন নিয়ে শুরু হলেও এখন তাঁর কারখানায় ৬০ থেকে ৬৫ জন কাজ করেন। কয়েকজন অংশীদার মিলে তাঁরা খাজা তৈরি করেন। এই খাজা উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি জেলায় তাঁদের কারখানা আছে।
ছবি: তৌহিদি হাসান

সিলেট
রেসিপি : কুমকুম হাজেরা

পুঁটি মাছের ঢেফল খাট্টা (টেংগা)
পুঁটি মাছের ঢেফল খাট্টা (টেংগা)

পুঁটি মাছের ঢেফল খাট্টা (টেংগা)
উপকরণ: ঢেফল ১টি, পুঁটি ২৫০ গ্রাম, রসুনকুচি ১ চা-চামচ, রসুনবাটা ২ চা-চামচ, হলুদগুঁড়া ১ চা-চামচ, তেল ১ টেবিল চামচ, ধনেপাতা ২ টেবিল চামচ, লবণ পরিমাণমতো।
প্রণালি: ঢেফলকে ধুয়ে ওপর–নিচ কেটে এক ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এরপর ভাপিয়ে নিন। ভাপা হলে খোসা খুলে ঠান্ডা পানিতে পাঁচ মিনিট রাখতে হবে। একটি ঢেফল ৫-৬ টুকরা করে ভেতরের বিচি ফেলে দিতে হবে। চুলায় একটি ডেকচিতে তেল দিয়ে গরম তেলে রসুনকুচি দিন। রসুনকুচি বাদামি রং ধারণ করলে রসুনবাটা দিয়ে দিন। এরপর ২ মিনিট সময় নিয়ে ঢেফল ও হলুদগুঁড়া কষিয়ে পানি দিতে হবে। লবণ দিয়ে ৫ মিনিট চামচ দিয়ে একটু ঘুঁটে ঢেফল দিয়ে দিন। এরপর মাছ দিয়ে ১০ মিনিট রাখুন। পানি এমনভাবে দিতে হবে, যেন ঝোল ঝোল হয়। লবণ ঠিক আছে কি না দেখে ধনেপাতা দিয়ে চুলা থেকে নামিয়ে ফেলুন। ঢেফলের খাট্টা বা টেংগার তরকারি সিলেট অঞ্চলে খাওয়ার শেষ পাতের বিশেষ আয়োজন হিসেবে সমাদৃত।
ছবি: আনিস মাহমুদ

যশোর
রেসিপি: আঞ্জুমান আরা রোজী

খেজুর গুড়ের পায়েস
খেজুর গুড়ের পায়েস

খেজুর গুড়ের পায়েস
উপকরণ: পোলাও চাল ২ কাপ, তরল দুধ ২ লিটার, নারকেলের ফোপরাকুচি ১ কাপ, খেজুর গুড় দেড় কাপ, এলাচি ৩টি, দারুচিনি ১টি, তেজপাতা ১টি, নারকেল কোরানো কাপের এক-তৃতীয়াংশ।
প্রণালি: চাল ধুয়ে পানিতে ৩০ মিনিট ভিজিয়ে রাখুন। এরপর পানি ঝরিয়ে ফেলতে হবে। এবার একটি পাত্রে দুধ, চাল, গুড়, এলাচি, দারুচিনি ও তেজপাতা দিয়ে রান্না করুন। চাল ৯০ ভাগ ফুটে এলে নারকেলের ফোপরাকুচি ও কোরানো নারকেল দিয়ে আরও পাঁচ মিনিট জ্বাল দিতে হবে। এরপর পরিবেশন পাত্রে ঢেলে ওপরে হালকা গুড়, নারকেল ও ফোপরাকুচি দিয়ে সাজিয়ে পরিবেশন করুন।

খুলনা
রেসিপি: নাদিয়া নাতাশা

নারকেল–দুধে ইলিশ
নারকেল–দুধে ইলিশ

নারকেল–দুধে ইলিশ
উপকরণ: ইলিশ মাছ ৬ টুকরা, পেঁয়াজবাটা ২ টেবিল চামচ, আদাবাটা ১ টেবিল চামচ, রসুনবাটা আধা চা-চামচ, চিনি ১ চা-চামচ, নারকেলের দুধ ১ কাপ, টক দই আধা কাপ, জিরাগুঁড়া আধা চা-চামচ, কাঁচা মরিচ ৪-৫টি, এলাচি ১টি, দারুচিনি ১ টুকরা, লবণ স্বাদমতো, তেল আধা কাপ।
প্রণালি: মাছের টুকরাগুলো ভালো করে ধুয়ে নিন। কড়াইয়ে তেল গরম করে এলাচি, দারুচিনি ও পেঁয়াজবাটা দিয়ে হালকা ভাজুন। এবার আদা-রসুনবাটা ও জিরাগুঁড়া দিয়ে মসলা ভালো করে কষিয়ে নিন। এটিকে দই, কাঁচা মরিচ, স্বাদমতো লবণ ও চিনি দিয়ে আরও কিছুক্ষণ কষাতে হবে। এবার সাবধানে ইলিশের টুকরোগুলো বিছিয়ে এপিঠ-ওপিঠ নেড়ে নারকেলের দুধ দিয়ে ১০ মিনিট রান্না করুন। মাখা মাখা হয়ে এলে নামিয়ে পরিবেশন করুন।

ঢাকা
রেসিপি: হাজী ফরিদা বেগম

বাঁধাকপি দিয়ে গরুর মাংস
বাঁধাকপি দিয়ে গরুর মাংস

বাঁধাকপি দিয়ে গরুর মাংস
উপকরণ: গরুর মাংস ১ কেজি, বাঁধাকপি ছোট আকারের দুটি, দারুচিনি ৩–৪ টুকরা, এলাচি ৩–৪টা, তেজপাতা ১টা, আদা-রসুনবাটা ২ চা-চামচ, পেঁয়াজ ২৫০ গ্রাম, তেল ২৫০ গ্রাম, লবণ পরিমাণমতো, হলুদগুঁড়া ১ চা-চামচ, মরিচগুঁড়া ১ চা-চামচ, আস্ত কাঁচা মরিচ ৬–৭ টুকরা, জিরাবাটা পরিমাণমতো।
প্রণালি: গরুর মাংস ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। মাংসে হাড় থাকলে ভালো। বাঁধাকপি কুচি করে কেটে হালকা ভাপ দিয়ে নামিয়ে রাখুন। পেঁয়াজ কুচি করে ভেজে নিন। ভাজা পেঁয়াজে সব মসলা ঢেলে দিয়ে ভালো করে কষাতে হবে। এবার কষানো মসলায় মাংস ঢেলে দিয়ে ভালোমতো নাড়া দিয়ে ঢেকে দিন। মাংস আধা সেদ্ধ হয়ে এলে বাঁধাকপি ও আধফালি কাঁচা মরিচ ছড়িয়ে দিন। অল্প গরম পানি দিয়ে কিছু সময় নাড়াচাড়া করুন। বাঁধাকপি মজে গিয়ে ভাজা ভাজা হয়ে এলে এবং ওপরে তেল ভেসে উঠলে জিরাগুঁড়া পরিমাণমতো দিয়ে নামিয়ে ফেলুন। গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন। বাঁধাকপি গরুর মাংস যত বাসি হবে, স্বাদ তত বাড়বে।
ছবি: ফারুখ আহমেদ

রংপুর
রেসিপি: ইশরাত জাহান

আলু বেগুন শুঁটকির তরকারি
আলু বেগুন শুঁটকির তরকারি

আলু বেগুন শুঁটকির তরকারি
উপকরণ: পুঁটি কিংবা ছুরি মাছের শুঁটকি ১৫০ গ্রাম, বেগুন ২টি (লম্বা বেগুন), আলু আধা পোয়া (যেকোনো আলু), পেঁয়াজবাটা ২ চা-চামচ, রসুনবাটা ১ চা-চামচ, আদাবাটা ১ চা-চামচের এক-তৃতীয়াংশ, জিরাবাটা ১ চা-চামচের এক-তৃতীয়াংশ (ঐচ্ছিক), মরিচগুঁড়া ১ চা-চামচ, হলুদগুঁড়া ১ চা-চামচের এক-তৃতীয়াংশ, কাঁচা মরিচ ৫টি, লবণ ও তেল পরিমাণমতো।
পদ্ধতি: শুঁটকি ছোট ছোট টুকরা করে গরম পানিতে ১৫-২০ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে। ভিজে গেলে ভালো করে ধুয়ে নিন। বেগুন ছোট ছোট টুকরা করে কাটতে হবে। একই সঙ্গে আলুও ছোট ছোট টুকরো করে কেটে নিন। একটি পাত্র চুলায় চাপিয়ে তাতে তেল দিন। তেল গরম হয়ে গেলে তাতে শুঁটকিগুলো দিয়ে কিছুক্ষণ ভাজুন। ভাজা শুঁটকিতে সব মসলা ও লবণ দিয়ে আরও কিছুক্ষণ ভাজুন। এরপর এতে বেগুন, আলু ও কাঁচা মরিচ দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে পানি দিয়ে ঢেকে দিন। কিছুটা পানি থাকতে নামিয়ে ফেলুন।