সমৃদ্ধ বাঙালির খাদ্যবিলাস

শীতের অনন্য খাবার পিঠা। ছবি: নকশা
শীতের অনন্য খাবার পিঠা। ছবি: নকশা

উত্তরের হিম হিম সন্ধ্যা। উনুনের চারদিকে গোল হয়ে বসে থাকা শিশুদের চোখ চকচক করে ওঠে। মাটির কড়াই থেকে বাঁশের শলাকায় গেঁথে নামছে পুলি কিংবা পোয়া পিঠা। আমাদের শৈশবের এ দৃশ্য পিঠার, এ দৃশ্য শীতের। শীতহীন মহানগরে ঋতুচক্রের হাত ধরে আসা মেদুর সন্ধ্যায় কখনোসখনো স্মৃতির বটুয়া খুলে গেলে এসব দৃশ্য মনে পড়ে। মনে পড়ে ঋতুভিত্তিক যাপনে পিঠা আমাদের শৈশবকে কখনো ভাসিয়েছে আনন্দে, কখনো বেদনায়, অভিমানে। শোনা যায়, আবেগ ছোঁয়াচে। তাই বেদনা, অভিমানের কথা প্রকাশ্যে না বলাই ভালো। বরং বলা যাক, সমৃদ্ধ বাঙালির পিঠা খাওয়ার গল্পগাছা। 

অগ্রহায়ণে নতুন ধান উঠে গেলে সে ধান ঝাড়পোঁছ করতে পৌষ এসে যায়। পৌষের শেষে শীতটা জাঁকিয়ে পড়লে ধুম পড়ে পিঠা খাওয়ার। সে হরেক পদের পিঠা, অঞ্চলভেদে তার কত যে বাহারি নাম, কত রংবাহারি আয়োজন! সকালের পিঠা এক রকম, তো বিকেলের পিঠা আলাদা। পরিবারের সবাই খাব তো সে পিঠা এক আর স্বজন-বন্ধু-আত্মার মানুষের সঙ্গে বসে খাব, তার আয়োজন একেবারে ভিন্ন। এই ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন থেকেই বুঝে নেওয়া যায় বাঙালির সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অবস্থান। আর অর্থনীতি যদি সমৃদ্ধ হয় সেখানে আয়োজনের আড়ম্বর থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। 

 ঠাকুরমার ঝুলি না পড়া, নিদেনপক্ষে বিভিন্নভাবে ঠাকুরমার ঝুলির গল্পগুলো না শোনা বাঙালি বিরল প্রজাতির। সেসব গল্পের ঝাঁপি খুলে বসলেই পাবেন ‘কাঁকনমালা-কাঞ্চনমালা’। হাতের কাঁকন দিয়ে কিনে আনা দাসী কাঁকনমালা পাটরানি হয়ে ওঠে তার দুষ্ট বুদ্ধিতে। দুঃখী কাঞ্চনমালার কপালে বেজায় কষ্ট তখন। কিন্তু পাটরানির আভিজাত্য তো আর চলে যায়নি! হারানো সম্মান ফিরে পেতে কাঞ্চনমালাকে নামতে হয়েছিল পিঠা তৈরির এক অদ্ভুত যুদ্ধে। দাসী কাঁকনমালার দুষ্ট বুদ্ধিতে পরাজিত রানি কাঞ্চনমালা পাটরানির আসন ফিরে পেয়েছিলেন চন্দ্রপুলি, মোহনবাঁশি, ক্ষীর মুরলি, চন্দনপাতা—এসব পিঠা বানিয়ে। আর দাসী কাঁকনমালা আস্কে, চাস্কে আর ঘাস্কে পিঠা বানিয়ে বেঘোরে নিজের পৈতৃক প্রাণটা খুইয়েছিলেন জল্লাদের হাতে। গল্পের এই টুইস্টে নিহিত আছে বাঙালির সমৃদ্ধির গল্প। 

চন্দ্রপুলি, মোহনবাঁশি, ক্ষীর মুরলি, চন্দনপাতা আর আস্কে, চাস্কে, ঘাস্কে পিঠা দুই অর্থনৈতিক স্তরের মানুষের পিঠা। স্বাভাবিকভাবে এর আয়োজন দুই রকম। চন্দ্রপুলি, মোহনবাঁশি, ক্ষীর মুরলি, চন্দনপাতা এই পিঠাগুলোর নামেই বোঝা যায় কোনোটা ক্ষীরের তৈরি, কোনোটা দুধে ভেজানো আর কোনোটা কড়া করে গুড়ের মিষ্টিতে বানানো। আস্কে, চাস্কে, ঘাস্কে পিঠা অর্থনৈতিকভাবে নিচু স্তরের মানুষের পিঠা। শুধু চালের আটা ভিজিয়ে তাওয়ায় ভেজে বানানো হয় এই পিঠাগুলো। আর খাওয়ার অনুষঙ্গ? কেন, আপনিও তো খান নিয়মিত। রাস্তার ধারে মরিচভর্তা, সরিষাভর্তা, শুঁটকিভর্তা ইত্যাদি বিভিন্ন ভর্তা দিয়ে রসিয়ে রসিয়ে যে চিতই পিঠা খান, তাই আস্কে পিঠা জনাব। এবার আস্কের ভাই চাস্কে, ঘাস্কের ব্যাপারটা ভাবার চেষ্টা করুন। 

পিঠার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সুসংহত কৃষি–সংস্কৃতি ও সমৃদ্ধির গল্প। যে অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতি যত সমৃদ্ধ, সে অঞ্চলের পিঠাও তত বৈচিত্র্যময়, বর্ণিল। ধান উঠে গেলে পর এক আয়েশি ভঙ্গিতে গৃহস্থ গিন্নি পিঠা করতে বসেন। ধান উঠে যাওয়ায় গৃহস্থেরও
মন থাকে ফুরফুরে। হিম হিম শীতের মেদুর সন্ধ্যাগুলো তখন হয়ে ওঠে বর্ণিল। উঠি উঠি করে না–ওঠা সূর্যের সন্দিগ্ধ সকাল হয়ে ওঠে সুস্বাদু। জীবনের এই সুবিশাল আয়োজনে খাদ্যবিলাসি বাঙালির থালা ভরে উঠবে পিঠায়, এর কোনো বিকল্প নেই।