খাদি চলতি ধারাতেও

>মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়-খাদি। এখনো চলছে সমানতালে। খাদি মানেই আরাম। তবে চলতি ধারার সঙ্গে তাল মেলাতে মোটা খাদির জায়গায় এসেছে পাতলা খাদিও। শাল, পাঞ্জাবির পাশাপাশি শাড়ি, স্কার্ট, কুর্তিও তৈরি হচ্ছে খাদি কাপড়ে।
খাদি দিয়ে তৈরি হচ্ছে শাড়ি–ব্লাউজ, নকশায় থাকছে বৈচিত্র্য। মডেল: মুমতাহিনা টয়া, পোশাক: বিশ্বরঙ, সাজ: পারসোনা, স্থান: রেইনড্রপ গার্ডেন ক্যাফে, ছবি: সুমন ইউসুফ
খাদি দিয়ে তৈরি হচ্ছে শাড়ি–ব্লাউজ, নকশায় থাকছে বৈচিত্র্য। মডেল: মুমতাহিনা টয়া, পোশাক: বিশ্বরঙ, সাজ: পারসোনা, স্থান: রেইনড্রপ গার্ডেন ক্যাফে, ছবি: সুমন ইউসুফ

এই সময়ের মডেল ও অভিনেত্রী মুমতাহিনা টয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, খাদির তৈরি পোশাক পরে কেমন লাগল, কেমন লাগে? নকশার এই প্রতিবেদনের ছবি তোলার জন্য খাদির পোশাকের মডেল হয়েছেন তিনি। প্রশ্নের উত্তরে টয়া প্রথমেই বললেন আরামের কথা—‘খাদি সব সময় আরামের কাপড়।’

খাদি দিয়ে বানানো হয়েছে স্কার্ট ও টপ। পোশাক : বিবিয়ানা
খাদি দিয়ে বানানো হয়েছে স্কার্ট ও টপ। পোশাক : বিবিয়ানা

খাদি আর আদি শব্দের ছন্দ যেমন মিলে যায়, তেমনই খাদি শব্দ শুনলে বা পড়লে সেকেলে একটা ছবি ভাসে। কিন্তু সে ভাবনাও উবে যায় টয়ার কথায়। ‘খাদিতে বৈচিত্র্য এসেছে। আরামের এই কাপড়ে বৈচিত্র্য আনাটা বড় ব্যাপার। এবারের ফটোশুটে খাদির শাড়ি পরলাম, বেশ আরামেরই।’ টয়া এও জানালেন, খাদি কাপড়ে নতুন ধারার পোশাক তৈরি করছেন। সেগুলো তাঁর ভালো লাগে।

লম্বা কটিতে রঙিন কাজ। পোশাক: বিশ্বরঙ
লম্বা কটিতে রঙিন কাজ। পোশাক: বিশ্বরঙ

আমাদের খাদি
খাদি বা খদ্দর। এই নামের সঙ্গে কিছু ঘটনা যেন সমার্থক। খাদি তো শুধুই কাপড় নয়, এ যেন উপমহাদেশের ইতিহাসেরও অংশ। খদ্দরের কথা বললে চলে আসে ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশি আন্দোলন বা মহাত্মা গান্ধীর প্রসঙ্গ। পঞ্চকবির একজন রজনীকান্ত সেনের ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়, মাথায় তুলে নে রে ভাই...’ গানটি তো স্বদেশি আন্দোলনে জুগিয়েছিল প্রেরণা। আমাদের এই অঞ্চলে খাদির কথার সঙ্গে আসবে কুমিল্লার চান্দিনা এবং শৈলেন্দ্রনাথ গুহর গ্রামীণ খাদির কথা। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলে অরুণ গুহ ধরে রেখেছিলেন আদি খাদির ঐতিহ্য। অরুণ গুহও আর নেই। চান্দিনায় চরকায় কাটা সুতা দিয়ে এখনো হাততাঁতে বোনা হচ্ছে খাদি। এই খাদি কাপড় আমাদের একেবারে নিজস্ব।

খাদির শাড়ি, সঙ্গে কুচি দেওয়া খাদির ব্লাউজ । পোশাক: বিশ্বরঙ
খাদির শাড়ি, সঙ্গে কুচি দেওয়া খাদির ব্লাউজ । পোশাক: বিশ্বরঙ

একটা সময় খাদি প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিল। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে শৈলেন গুহের খাদি দিয়ে আবার শুরু হয় এর নবজাগরণ। ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে এই নবযাত্রায় ভূমিকা রাখেন বিবি রাসেল, রুবী গজনভী ও শাহিদ হোসেন শামীম। বিবি রাসেল বিদেশে নিয়ে যান খাদি। ইউরোপ, আমেরিকার ফ্যাশনজগতে দেখা যায় বাংলাদেশের খাদি। রুবী গজনভী খাদিকে রাঙিয়ে তোলেন ভেজিটেবলস ডাই বা প্রাকৃতিক রঙে। খাদিকে যুগোপযোগী করে তোলার কাজ শুরু করেন তাঁরা। এর আগে জাতীয় কারুশিল্পী পরিষদের উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে খাদির প্রদর্শনী করা হয় ঢাকায়। এই সংগঠনের আজীবন সদস্য মালেকা খানের কাছ থেকে জানা যায়, শৈলেন গুহের তৈরি খাদি ছিল সেই প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ।

মিস্টি রঙা খাদির লম্বা কুর্তা। পোশাক: বিবিয়ানা
মিস্টি রঙা খাদির লম্বা কুর্তা। পোশাক: বিবিয়ানা

বছরজুড়ে খাদি
খাদির পাঞ্জাবি, খাদির শাল—এ তো খাদির সেই আদি পোশাক। শীতকালে এসব চলে, কিন্তু বছরের বাকি সময়? কিংবা বর্তমান প্রজন্ম খাদি গ্রহণ করছে? এ প্রশ্নের উত্তর মুমতাহিনা টয়ার কথাতেই চলে এসেছে। ‘এখন ফ্যাশনেবল কাজ করা হচ্ছে খাদি দিয়ে।’ ফ্যাশন ডিজাইনারস কাউন্সিল অব বাংলাদেশের (এফডিসিবি) প্রেসিডেন্ট মাহিন খানের সঙ্গে কথায়ও একই সুর। তিনি বললেন, মোটা খাদি দিয়ে পর্দা, কুশন কভার, শাল, জ্যাকেট, পায়জামা তো আগে থেকেই করা হয়েছে।
এখন পাতলা খাদি দিয়ে নানা রকম পোশাক তৈরি করা হচ্ছে। ফ্যাশন শোতে দেখানো হচ্ছে খাদির তৈরি হাল আমলের পোশাক। এফডিসিবি আগামী ২৩ থেকে ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় আবার আয়োজন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকের। সেখানেও খাদির নিরীক্ষাধর্মী পোশাক দেখা যাবে। মাহিন খানের কাছ থেকে জানা গেল, পাতলা খাদির জন্য বেশি কাউন্টের যে সুতার প্রয়োজন, তা অম্বর চরকায় কাটা। এটা আমাদের দেশে হয় না। আমাদের এখানে ২০-৪০ কাউন্টের সুতা হয়, তা দিয়ে মোটা খাদি হাতে বোনা হয়। বাইরে থাকে বেশি কাউন্টের সুতা এনে পাতলা খাদি কাপড়ও কিন্তু হাততাঁতে বোনা হয়। তাই খাদিকে সম্পূর্ণ হাতে তৈরি কাপড়ই বলা যায়।

ছেলেদের নানা ধরনের পোশাকে খাদির ব্যবহার। মডেল: নিহাফ, পোশাক: বিশ্বরঙ, স্থান: হোয়াইট হাউস মিউজিক ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট
ছেলেদের নানা ধরনের পোশাকে খাদির ব্যবহার। মডেল: নিহাফ, পোশাক: বিশ্বরঙ, স্থান: হোয়াইট হাউস মিউজিক ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট

নতুন প্রজন্মের সঙ্গে
এই প্রতিবেদনের সঙ্গে থাকা ছবিগুলোতেই বোঝা যায়, খাদি নিয়ে নিরীক্ষাধর্মী কাজ করছেন আমাদের ফ্যাশন ডিজাইনাররা। বিশ্বরঙের স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বললেন, ‘বাংলার ফ্যাশনের সঙ্গে খাদি জড়িত। খাদি তৈরিতে কুমিল্লার চান্দিনার অবদানই বেশি।’ তরুণ প্রজন্ম এখন খাদির পোশাক পরছে। কারণ খাদিতে বৈচিত্র্য এসেছে। বিপ্লবের মতে, রাসায়নিক ও প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে রঙিন হচ্ছে খাদি। বুননেও বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা চলছে। খাঁটি খাদির কদর এখনো আছে।

শীতে মোটা খাদি কাপড়ের চাহিদা এখনো আছে আগের মতোই। তবে খাদি দিয়ে এই সময়ের ডিজাইনাররা যখন কটি, স্কার্ট, শার্ট, শাড়ি, কুর্তা, ব্লাউজ, জ্যাকেট, ব্লেজার, প্যান্ট, সালোয়ার তৈরি করছেন, সেগুলোর চাহিদা সারা বছরই থাকছে। আবার ফিনফিনে খাদি কাপড়ও দেখা যাচ্ছে। দেশের প্রায় সব ফ্যাশন হাউসেই খাদির পোশাক-আশাক পাওয়া যায়। খ্যাতিমান ডিজাইনারদের কমবেশি সবাই খাদি নিয়ে কাজ করছেন, আর তা এই প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে।
মায়ের দেওয়া সেই মোটা কাপড়, এই সময়ের ছেলেমেয়েরা মাথায় করেই রেখেছে। প্রকাশ করছে দেশপ্রেম। হাল ফ্যাশনেও তাই খাদি চলছে।