বড়দিন পরিবারের বন্ধুদের

বাড়িতে ক্রিসমাসট্রি সাজানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায় বড়দিনের আয়োজন। মডেল: সুমন, রুহী ও কেয়া ক্রুজ। ছবি: সুমন ইউসুফ
বাড়িতে ক্রিসমাসট্রি সাজানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায় বড়দিনের আয়োজন। মডেল: সুমন, রুহী ও কেয়া ক্রুজ। ছবি: সুমন ইউসুফ

আজ ২৫ ডিসেম্বর। খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের বড়দিন। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে দিনটি কাটবে উৎসবমুখর মেজাজে। বাড়িতে বাড়িতে সাজানো আলো-ঝলমলে ক্রিসমাসট্রির পাশাপাশি জমবে আড্ডা। এই নিয়ে এবারের প্রতিবেদন।

‘জিঙ্গেল বেলস, জিঙ্গেল বেলস...বাজতে শুরু করেছে।

বছর ঘুরে আবারও চলে এসেছে যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন, মানে বড়দিন। আর বড়দিন মানেই ছোট্ট যিশুর জন্য বিভিন্ন আয়োজন। ঠিক যেমন একটা শিশুর আগমনের আয়োজনে রমরম করে গোটা পরিবার, শুরু হয় বিভিন্ন পরিকল্পনা, রোল পড়ে যায় আনন্দের। যিশুর জন্মদিনের আজকের দিনটাও ঠিক তেমনই একটা দিন। আর এই দিনের পূর্বপ্রস্তুতিস্বরূপ ডিসেম্বর মাসেই শুরু হয়ে যায় গির্জা সাজানো থেকে শুরু করে ক্রিসমাস ক্যারল। এই সময়টাকে আমরা বলে থাকি ‘আগমনকাল’।

লিখতে বসে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। তখন থাকতাম দিনাজপুরে। ডিসেম্বর মাসের আশায় বসে থাকতাম পুরো ১১ মাস। কারণ, বড়দিনের ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে গাজীপুরে গ্রামের বাড়ি যেতাম। শীতের পিঠা তো এমনিতেই বাঙালিদের প্রিয়, তাঁর মধ্যে আলাদা আনন্দ এনে দেয় বড়দিন। সব বন্ধু আর মামাতো-চাচাতো ভাইবোনেরা মিলে ২৪ ডিসেম্বর বিকেল থেকেই বসে যেতাম কেক, পিঠা বানাতে। তবে এটার আগে যেটা করতে হতো সেটা হলো, ঢেঁকিতে চালের গুঁড়া কোটা। বসে বসে মা, কাকিমাদের দেখতাম গল্প করতে করতে ঢেঁকিতে পা রাখছেন। ছন্দের মতো দুলুনিতে সেই ঢেঁকির নিচে পড়ে চালগুলো কী সুন্দর করে গুঁড়া গুঁড়া হয়ে যাচ্ছে। আমি অবশ্য সেই চেষ্টা করতে গিয়ে কোনো দিন সফল হইনি।

বড়দিন উপলক্ষে যে নতুন পোশাক কিনতাম, সেটা লুকিয়ে ফেলতাম আলমারিতে। কেউ কাউকে নতুন জামা দেখাতাম না। একেবারে ২৫ ডিসেম্বর সকালে গির্জায় গিয়ে দেখতাম কার পোশাকটা বেশি ‘আনকমন’। তারপর গির্জার আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাড়িতে বাড়িতে ক্রিসমাস ক্যারল করতাম আর সেই টাকা দিয়ে গ্রামে একদিন পিকনিক করা হতো। তবে আমি একজনের জন্যই ক্রিসমাসের দিন গির্জায় যেতাম। সে হলো আমার সান্তা দাদু। সবাই যাকে ‘সান্তা ক্লজ’ নামে ডাকে। ঝোলাভর্তি চকলেট নিয়ে যে হাজির হতো আমাদের সামনে। তারপর সেখান থেকে বিভিন্ন রকম চকলেট আমাদের দিত। আমরা সেই চকলেট পেয়ে মহা খুশি হয়ে খেতে শুরু করতাম আর সেও টাটা দিয়ে কোন ফাঁকে যেন উধাও হয়ে যেত!

ডবল ক্রিসমাসের দিনগুলো
স্কুলজীবনে বোর্ডিং স্কুলের ক্রিসমাস আজও মনে পড়ে। ছুটিতে বাড়ি যাওয়ার আগে আয়োজন করা হতো অগ্রিম ক্রিসমাস পার্টি। সিস্টার-ফাদারদের সহযোগিতায় গির্জা, হোস্টেল, মাঠ সাজাতাম। বান্ধবীরা মিলে অনুষ্ঠানের জন্য গান, নাচের মহড়া করতাম দিনরাত। ক্লাস টেনের মেয়েদের প্রতিবছর পালা থাকত ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর। সেই নিয়মমতো আমরাও সাজালাম। আর একজন সাজত সান্তা ক্লজ। এখানেও শিক্ষার্থীদের মূল আকর্ষণ ছিল উপহার। ছুটিতে বাড়ির বড়দিনের চেয়ে এই আয়োজনও কম আনন্দের নয়। ছোটবেলার এই আনন্দগুলো আলাদা ছিল স্কুলের বন্ধুবান্ধব আর সহপাঠীদের কারণে।

গত দুই বছর পড়াশোনার জন্য ভারতে ছিলাম। তাই বন্ধুদের সঙ্গে বড়দিন উদ্‌যাপন করার সৌভাগ্য হয়েছিল সেখানে। দেখলাম বড়দিনে ওখানেও খুব আনন্দ হয়। কলকাতার পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলজুড়ে নভেম্বরের শেষেই পড়ে যায় ক্রিসমাসের ধুম। দোকানগুলোতে বিভিন্ন আকারের ক্রিসমাস ট্রি, টুপি আর চকলেটের ছড়াছড়ি। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের অনুষ্ঠান তারপর বন্ধুদের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়া ।

শান্তিনিকেতনেও বড়দিন হয়েছে একবার। এমন সময়ে পরীক্ষা শেষ হয়েছে যে আর ঢাকায় ফেরা হয়নি। বাড়ির জন্য ভীষণ মন খারাপ হলেও বন্ধুরা পুষিয়ে দিয়েছিল। ওখানে তখন পৌষ মেলা। তবে ২৫ ডিসেম্বরের বড়দিনও বন্ধুদের সঙ্গে কেটেছিল দারুণ। রবীন্দ্রনাথের উপাসনা গৃহ থেকে শুরু করে ছাতিমতলা পুরোটাই আলোর ধারায় সেজে ওঠে। অপূর্ব লাগে।

বড়দিনে কেক কুকিেজ চলে বন্ধু–স্বজনদের আপ্যায়ন। মডেল: কেয়া ক্রুজ, রুহী, ইশতিয়াক, ফ্লোরিডা, দিল আফরোজ ও সুমন
বড়দিনে কেক কুকিেজ চলে বন্ধু–স্বজনদের আপ্যায়ন। মডেল: কেয়া ক্রুজ, রুহী, ইশতিয়াক, ফ্লোরিডা, দিল আফরোজ ও সুমন

বড়দিন মানেই বন্ধুদের আড্ডা
স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোয় বড়দিন মানেই প্রিয়জন আর বন্ধুদের আড্ডা। সবে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়েছি, পার হয়ে গেছে অনেকটা সময়। তবে অনেক কিছু পাল্টে গেলেও বড়দিনে ছোট্ট যিশু কিন্তু প্রতি ডিসেম্বরেই আসে। সান্তা দাদুও আসে তার ঝোলাভর্তি উপহার নিয়ে।

ছোটবেলার ছোট হাতের অপরিপক্ব পিঠা, কেক এখন পরিপক্ব হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও আগমনকালের শুরুতেই ক্রিসমাস ট্রি বের করে বোন আর বন্ধুরা ঘটা করে সাজালাম ক্রিসমাস ট্রি। ক্রিসমাস ট্রি সাজানোর সময় যে অনুভূতিটা হয়, সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। আর সঙ্গে ক্যারল তো আছেই। তবে হ্যাঁ, বলে রাখা ভালো, বড়দিনে পশ্চিমা সংস্কৃতির সঙ্গে আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির ছোট ছোট কিছু অমিল রয়েছে। আমরা যেহেতু বাঙালি, তাই আমরা চেষ্টা করি বাংলা ভাষাতেই ক্রিসমাস ক্যারল করতে। আমরা এটাকে কীর্তন বলি। খোল, কর্তাল, হারমোনিয়াম, মন্দিরার তালে তালে আমরা এই কীর্তন করি। আগমনকাল শুরু হলেই বন্ধুরা মিলে কীর্তন করি ঘরে ঘরে গিয়ে।

আনন্দকে আরও এক ধাপ বাড়িয়ে দিতে আয়োজন করা হয় ক্রিসমাস ক্যারল প্রতিযোগিতা। ঢাকাতে বটমলি স্কুল চত্বরে প্রতিবছর এই প্রতিযোগিতা হয়, আর সেই সঙ্গে থাকে মেলা, পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হওয়া। আর সেই সঙ্গে স্টলে স্টলে বিভিন্ন রকমের কেক, পিঠা তো আছেই। বন্ধুরা কে কার পকেট ফাঁকা করব, সেই দুষ্টুমির কথা তো বাদই দিলাম। এই আনন্দগুলো কোনো দিন পুরোনো হয় না। এই তরুণ বয়সে এসেও সমান অপেক্ষা নিয়ে তাই বড়দিন উদ্‌যাপন করি।

ক্রিসমাসের আগে আমরা ঘটা করে যেটা উদ্‌যাপন করি, সেটা হলো ‘প্রি ক্রিসমাস পার্টি’। মূলত এটা একটা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। ক্রিসমাস শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে থেকে এই আয়োজন চলতে থাকে। আমরা যারা সব সময় ঢাকায় থাকি, তারা এই সময় ছুটিতে পরিবারের সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে চলে যাই। উৎসব মানে তো প্রিয়জনদের কাছে পাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে সময়ের হিসাব না করে আড্ডা দেওয়া। মজার মজার রান্না হয় প্রতিটি বাড়িতে। বিশেষ করে নানা রকম কেক, পিঠা ও পেস্ট্রি খেতে খেতে দিন পার হয়ে যায়।

২৫ ডিসেম্বরকে আমরা বড়দিন হিসেবে উদ্‌যাপন করলেও যিশুর জন্মের আনন্দ শুরু হয়ে যায় আগের দিন রাতেই। আগের দিন রাতে বা সন্ধ্যায় গির্জার অনুষ্ঠান শেষ করে সদ্য জন্মানো যিশুর ব্লেসিংস নিতে পরদিন সকালেই আবার ছুটে যাই গির্জায়। আর আমাদের ছোট্ট শিশুটিকে রাখা হয় গোশালা ঘরে। যিশু জন্ম নিয়েছিল কনকনে শীতের রাতে বেথলেহেমের এক গোয়ালঘরে। কারণ যিশুর মা মারিয়ামের তখন যাওয়ার মতো কোনো জায়গা ছিল না। তাই মারিয়ামকে নিয়ে যিশুর বাবা জোসেফ আশ্রয় নিয়েছিলেন এক জীর্ণ গোশালায়। সে জন্য আমরা ক্রিসমাসের দিন ছোট্ট গোশালাঘর বানিয়ে সেখানে যিশুকে রাখি।

পরিবারে বড়দিন
নানা প্রয়োজনে অনেকে ভিন্ন শহরে বা ভিনদেশে বসবাস করেন। বড়দিন উপলক্ষে সবাই বাড়িতে আসেন। বিদেশে থাকলে লম্বা ছুটি নিয়ে দেশে আসেন। অনেক দিন পর প্রিয় মুখগুলোর সঙ্গে দেখা হয় সে তো বড়দিনের উৎসব চলে বলেই। বাড়ির মা-কাকিরা তখন আয়োজন করে রাঁধতে বসেন। বড়দিনের কয়েক দিন আগে থেকেই বেড়ানোর পর্ব শুরু হয়ে যায়। এই বেড়ানো চলতে থাকে নতুন বছর পর্যন্ত। নানা রকম কেক আর মিষ্টিতে ঘর ভরে যায়। যে-ই বেড়াতে আসুক, হাতে থাকে কেক বা মিষ্টি। মজাদার খাবার আর ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়াতে থাকেন বাড়ির বড়রা মিলে।

বদলে গেছে আনন্দ
এখন আর কে কোন পোশাক পরছি, সেদিকে নজর থাকে কম। বরং তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কার বাসায় কখন পার্টি হবে, সেটা জানা। সময়মতো সেখানে থাকা আর হইহুল্লোড়ে মেতে ওঠা—এই হচ্ছে আমার এখনকার বড়দিন। বড়দিনের পাশাপাশি এই সময়টায় ইংরেজি নতুন বছরকে কেন্দ্র করে দেখা হয় সবার সঙ্গে। পুরোনো বন্ধুরা একত্র হওয়ার সবচেয়ে আসল সময় এটাই। চাকরি, সংসার কিংবা ব্যক্তিগত জীবনের ব্যস্ততায় চাইলেও এখন আর আলাদা সময় করে আড্ডা দেওয়া হয়ে ওঠে না। তাই এ সময় পরিবারের পাশাপাশি বন্ধুদের জন্য বরাদ্দ থাকে। উৎসবের দিনগুলোয় কে মুসলিম, কে হিন্দু আর কে খ্রিষ্টান—এসবের চেয়েও বড় হচ্ছে বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া। পরিবার তো পাশেই আছে। সেই সঙ্গে বন্ধুরা এনে দেয় বাড়তি আনন্দ।

দুই বছর পর এবার বড়দিনে দেশে আছি। তাই আমার আনন্দটা কয়েক গুণ বেশি। জানি এমন অবস্থা অনেকের মনেই। কারণ, বড়দিনে বিদেশবিভুঁই থেকেও অনেকে ছুটে এসেছেন। অনেকের হঠাৎ ফোনেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। আজ সারা দিন বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, কারও কারও সঙ্গে তো অনেক দিন পর দেখা হবে, এর চেয়ে আনন্দ আর কী হতে পারে!

শুভ বড়দিন সবাইকে।