মুক্তডানায় ডানা মেলে

কক্সবাজার বিমানবন্দরে মুক্তডানার সদস্য এবং তােদর পরিবার। ছবি: সংগৃহীত
কক্সবাজার বিমানবন্দরে মুক্তডানার সদস্য এবং তােদর পরিবার। ছবি: সংগৃহীত

সারা বিশ্বে চলছে অটিজম নামক এক বিশেষ অবস্থার সমাধান খোঁজা। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটও ভিন্ন নয়। এ অবস্থাটা এত জটিল যে কোনো একটি সমাধান সবার জন্য প্রযোজ্য নয়। সেই সমস্যার ব্যবস্থাপনা কী করে একটু ভিন্নভাবে করা যায় আর তার পাশাপশি এই মানুষদের কী করে সাধারণ মানুষের কাতারে নিয়ে আসা যায়, তারই একটি প্রচেষ্টার নাম মুক্তডানা।

মুক্তডানা চলতি মাসেই ঢাকার বাইরে একটি আনন্দ ভ্রমণের আয়োজন করে, যা শুধুই একটা ভ্রমণ বললে ভুল হবে। কেননা বাংলাদেশের ইতিহাসে উড়োজাহাজের কোনো একটি ফ্লাইটে এতজন পূর্ণবয়স্ক অটিজমে আক্রান্ত মানুষ একসঙ্গে ঢাকা থেকে কক্সবাজার গেছে কি না, তা আমাদের কারও জানা নেই। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো প্লেনের যাত্রীরা বিষয়টিতে কোনো বিরক্তি প্রকাশ করেননি। অন্যভাবে বলতে গেলে আমাদের বিশেষায়িত মানুষেরা এমন কোনো আচরণ করেননি, যা অন্য কারও অভিযোগের কারণ হয়।

অটিজমে আক্রান্ত এই মানুষদের সবার মধ্যেই হাইপার অ্যাকটিভিটি, আচরণগত সমস্যা আছে। তাদের অন্য কাজের পাশাপাশি এই ভ্রমণের সব বিষয় সম্পর্কে জানানো ও প্রশিক্ষিত করা হয় প্রায় দুই মাস ধরে। গল্প বলে, ছবি এঁকে কী হতে পারে আর কি না হলে অন্য ব্যবস্থা করতে হবে, বিকল্প ব্যবস্থা কী হতে পারে তা জানানো হয়। প্রশিক্ষণের বিষয়টি অনেকেই জানেন, যাঁরা এদের নিয়ে কাজ করেন। 

আমাদের এই ভ্রমণের দলটি ছিল ৩০ জনের। এর মধ্যে ৬ জন অটিস্টিক প্রাপ্তবয়স্ক। সঙ্গে তাঁদের পরিবার ও শিক্ষকমণ্ডলী। ইউএস–বাংলার একটি ফ্লাইটে কক্সবাজার যাওয়া–আসায় দুই বিমানবন্দর ও ফ্লাইটে থাকা যাত্রীদের সুযোগ হয় এই মানুষদের কাছ থেকে দেখার। তাদের জানার আর দেখার সুযোগ হয় এদের সক্ষমতার জায়গাগুলো। সঙ্গে এটাও তাঁরা দেখেন যে কিছু বিষয় এই মানুষদের মধ্যে আছে, যা আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক মনে হলেও সেটা কাউকে ক্ষতি করার উদ্দেশ্য নিয়ে তারা করে না। এই যে সাধারণ মানুষের কাছে আসার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল, যা এদের সম্পর্কে ভুল ধারণা ভাঙতে খুবই সহায়ক। সেমিনার বা অন্য যেকোনো আয়োজনের চেয়ে কার্যকরী বলে মনে হয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এদের সম্পর্কে ভয় ও কৌতূহল দুই–ই আছে। যেহেতু জনপরিসরে (পাবলিক প্লেস) এদের খুবই সংগত কারণে নেওয়া হয় না। তাই আমাদের দেশে সাধারণ মানুষ যাদের এমন পারিবারিক সদস্য নেই, এদের সম্পর্কে তাদের জানার সুযোগ ও সীমিত। 

সমুদ্রসৈকতেও আমাদের পুরো দল সব ধরনের খেলাধুলা ও আনন্দ আয়োজনে অংশ নেয়। একই হোটেলে অবস্থান করে সবাই। আর বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় একসঙ্গেই খাবার খায়। এই ভ্রমণে বাদাম অথবা কফি বিক্রেতা যাঁরা সৈকতে থাকেন, সবাই বিভিন্ন সময়ে এদের কাছাকাছি এসে তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের জানার চেষ্টা করে। এমন বিমানবন্দর ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে নিরাপত্তাকর্মী সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন বিভিন্নভাবে।

আগেই বলেছি, খুব সংগত কারণে পরিবারগুলো এ রকম একজন মানুষকে নিয়ে পাবলিক প্লেসে যেতে চায় না। নানা রকম বাজে অভিজ্ঞতা, মানুষের কটূক্তি অনেক সময় ভালোর চেয়ে খারাপ প্রভাব বেশি ফেলে বিশেষায়িত মানুষদের ওপর। কিন্তু যখন সবাই মিলে এই ভ্রমণে অংশ নিয়েছে, তখন কারোই মনে হয়নি আমরা আলাদা। পুরো দলের সব সদস্য এদের সঙ্গে পরিচিত, তাই এটা হয়ে উঠেছে আনন্দ ভ্রমণ। 

সৈকতে বসে চলছে ছবি অাঁকা
সৈকতে বসে চলছে ছবি অাঁকা

সাধারণ মানুষের স্বল্প ধারণা অটিজম সম্পর্কে, যা এই অটিজমে আক্রান্ত মানুষকে দূরে ঠেলে দেয় সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। যত বেশি পাবলিক প্লেসে এদের নিয়ে যাওয়া যাবে, তত বেশি মানুষ এদের সম্পর্কে জানবে। আর তত দ্রুত তাদের পাশে এদের জায়গা করে। ইউএস–বাংলার ওই ফ্লাইটের পাইলট যদি জানতেন উনি এতজন অটিস্টিক মানুষকে নিয়ে গেছেন, এমনও হতে পারত না জানার জন্য একই ফ্লাইটে না–ও নিতে চাইতে পারতেন। এ রকম অনেক ঘটনা আমরা জানি। মাত্র একজন হাইপার অটিস্টিক মানুষকে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেছে অনেক বিমান পরিবহন সংস্থা। কিন্তু সঠিক তথ্য যদি আগেই এদের দেওয়া যায় কী করতে হবে, কোথায়, তা যদি জানা না যায় অটিজম নিয়ে ও তারা অনেক কিছু করে দেখাতে পারে। এই ভ্রমণ তার একটি অন্যতম উদাহরণ।

তিন দিন–চার রাতের এই কক্সবাজার ভ্রমণে সবাই চলেছে সময়ের সঙ্গে। সময় ধরে সব কাজ হয়েছে পূর্বপরিকল্পনামতো। কারও জন্য কাউকে বসে থাকতে হয়নি এটাও একটা বিশাল ব্যাপার। এই আনন্দ ভ্রমণে দুই বিমানবন্দর, হোটেল ও সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন স্তরের মানুষদের মধ্যে যে সচেতনতা তৈরি করা গেছে, তা কখনোই সভা বা সেমিনার করে করা সম্ভব নয়।

অসাধারণ এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে মুক্ত ডানা অটিজমে আক্রান্তদের জন্য আরও আয়োজন করবে, যাতে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি এদের নিয়ে যাওয়া যায়। আর তা অবশ্যই পরিবারকে সঙ্গে রেখে। ভুলে গেলে চলবে না এরা আমাদের সমাজ ও পরিবারের অংশ। সমুদ্রসৈকতে আর দশজন মানুষের বেড়ানোর অধিকার আছে, এদেরও আছে। এদের জায়গা তা আমাদের সবাইকে মিলেই করে দিতে হবে।

লেখক: মুক্তডানার মহাসচিব এবং বেসিসের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি