ছুটি মানে খেলাধুলা

নিয়মিত খেলাধুলায় শিশুর গঠন ঠিক হবে। ছবি: অধুনা
নিয়মিত খেলাধুলায় শিশুর গঠন ঠিক হবে। ছবি: অধুনা

প্রতিদিন ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া–আসা, বাড়িতে ফিরে গোসল করে, খেয়ে আবার ছোটা কোচিং, টিউশনে নয়তো নাচ-গান শিখতে। দুপুরে খেয়ে কিছুটা ভাতঘুম দিয়ে নিজেকে কিছুটা তরতাজা করে তুলবে, এমন সময় এখনকার শিশুরা প্রায় পায় না বললেই চলে। যদি কোনো শিশু এমন অবসর পেয়েও থাকে, তাকে সৌভাগ্যবান শিশুর কাতারে ফেলাটাই যুক্তিযুক্ত। বছরের শুরু থেকে প্রায় শেষ অব্দি শিশুদের এই একঘেয়ে রুটিন ওদের হাঁপিয়ে তোলে, ক্লান্ত করে, বিষণ্নতায় ছেয়ে ফেলে। কিন্তু অবুঝ মনের চাওয়াগুলো চাপা পড়ে যায় লেখাপড়ার ভারে। মুক্তি মেলে বছরের শেষ দিনগুলোতে। বছরের এই শেষ দিনগুলোতে শিশুরা যেন হয়ে ওঠে পাখির মতো স্বাধীন, চঞ্চল, খলবলিয়ে ডানা ঝাপটায় মুক্ত সময় পেয়ে। 

মা–বাবাও যেন এই সময়টার অপেক্ষায় থাকেন সারা বছর। তাঁরাও চান শিশুর অবসরের সময়টা কিছুটা আয়েশ করে স্বস্তিতে কাটাবেন। আমান ও আতিফ দুই ভাই পড়ে অষ্টম ও পঞ্চম শ্রেণিতে। দুই ভাইয়ের জেএসসি ও পিইসি পরীক্ষা শেষে তাদের মা লাভলী ইয়াসমিন নিজেও সন্তানদের সঙ্গে কিছুটা মুক্তি অনুভব করছেন। তিনি বলেন, ‘সারা বছর ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে স্কুল, কোচিং, টিউশনি আর বাসায় ছুটে সময় কাটে আমার। ওদের তো অবসর প্রায় নেই, সেই সঙ্গে অবসর নেই আমার মতো মায়েদের। তাই অপেক্ষায় থাকি কখন ডিসেম্বর মাস আসবে। স্কুলের পরীক্ষা শেষ হলে ওদের নিয়ে দাদা বা নানাবাড়ি যাওয়া যায়, ইচ্ছেমতো ছোটাছুটি করতে পারে।’ 

খেলাধুলার জন্য ক্লাবে ভর্তি হলে সেখানে অনেক নিয়মকানুন শিখতে পারবে তো বটেই, সেই সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতের মাধ্যমে শিশুরা অনেক বন্ধুবান্ধব পাবে, খেলার সঙ্গী পাবে। ক্লাব ছাড়াও শিশুকে খেলার ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়। ইচ্ছেমতো খেলুক শিশু, এতে তার একঘেয়েমি কাটিয়ে উঠতে পারবে। পাহাড়, ঝরনা, সমুদ্র কাছ থেকে দেখলে ওদের ভাবনার জগৎ আরও প্রসারিত হবে। বই পড়ার প্রতি তার যেন আগ্রহ গড়ে ওঠে সেদিকে নজর দিন। শেখাতে পারেন সাঁতার কিংবা কারাতে। এতে করে ওদের মন প্রফুল্ল থাকবে, মানসিক বিকাশ, শারীরিক বিকাশ ঘটবে। তা ছাড়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সঞ্চালন ঘটে শিশুর শারীরিক বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। 

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের শিশু বিকাশ কেন্দ্রের শিশু মনোবিজ্ঞানী মো. খোরশেদ আলম জানিয়েছেন শিশুর অবসর কাটানোর কিছু উপায় সম্পর্কে। তিনি বলেন, ‘মোবাইল বা কম্পিউটার থেকে দূরে রাখুন শিশুকে। গল্পের বই দেওয়া যেতে পারে। যেহেতু লম্বা ছুটি, তাই যেকোনো নিকট আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেলে খুবই ভালো হয়। শিশুকে এমন খেলা খেলতে দেওয়া উচিত, যে খেলায় তার অন্য সঙ্গীর দরকার পড়বে। এতে শিশুর নড়াচড়া বেশি হয়। তাতে অন্যের সঙ্গে মেশা, সঠিক আচরণ, বন্ধুত্ব বাড়াতে সাহায্য করবে। লুডু, ক্যারম, পাজল ও আরও কিছু খেলা, যেগুলো শিশু একা খেলতে পারে সেসব যতটা সম্ভব না দেওয়া উচিত। এ ছাড়া বছরের অন্য সময় লেখাপড়ার পাশাপাশি নাচ, গান, ছবি আঁকা, বই পড়া ও বিভিন্ন সৃজনশীল দ্রব্য তৈরি করা ছাড়াও যেকোনো ভালো লাগা বা মধুময় স্মৃতি ডায়েরিতে লিখে রাখা যেতে পারে।’ 

শিশুদের লেখাপড়াই শুধু নয়, মাঝেমধ্যে স্কুলের পক্ষ থেকে শিক্ষাসফর, বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ, খোলা মাঠে খেলাধুলা, হাতে বানানো নানা দ্রব্য তৈরি ও প্রদর্শনীর ব্যবস্থা থাকা উচিত হলেও বেশির ভাগ স্কুলই তেমন সুযোগ–সুবিধা ও আয়োজন করতে পারে না। কিন্তু বিকল্পধারার শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান সহজপাঠ উচ্চবিদ্যালয় বছরে তিন-চারবার এমন আয়োজনের চেষ্টা করে থাকে। সহজপাঠ উচ্চবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ মোমেনা বেগম বলেন, ‘যদি সম্ভব হয়, অবসরে শিশু শহরের বাইরে প্রকৃতির কাছাকাছি যেকোনো আত্মীয় বাড়িতে বেড়াতে যাবে। আর অবশ্যই বই পড়বে। প্রতিটি শিশুকে তার পরিবারের লোকেরা একটি নিজস্ব জায়গা ছেড়ে দেবেন। যেখানে শিশু তার বই, খেলনা, নিজের হাতে গড়া বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে রাখবে। হাতে গড়া জিনিস তৈরির প্রয়োজনীয় উপাদান মা–বাবা জোগাড় করে দেবেন, এতে করে শিশুর হাত ও চোখ সক্ষম হবে ও সেই সঙ্গে সৃষ্টিশীল কর্মদক্ষতা তৈরি হবে। যাঁরা খুব ব্যস্ত মা–বাবা, তাঁদের যাবতীয় ব্যস্ততা তো শিশুর সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। কাজেই শুধু বাবা সন্তানকে দেখবেন বা সন্তানের যাবতীয় দেখভালের দায়িত্ব মায়ের এমন ধারণা বাদ দিয়ে যেটুকু অবসর পান সন্তানের জন্য সেটির গঠনমূলক সদ্ব্যবহার করা উচিত। যেহেতু সন্তান আপনাদের, অবসরে তাদের সঙ্গে সময় কাটানোটাও আপনার দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। কাজেই সময় বের করতেই হবে সন্তানের সুন্দর শৈশব ও কৈশোরের কথা ভেবেই।’