সততার শিক্ষা এবং শিক্ষায় সততা

নিজের গবেষণা নিয়ে কথা বলছেন জিনাত রেজা খান। ছবি: খালেদ সরকার
নিজের গবেষণা নিয়ে কথা বলছেন জিনাত রেজা খান। ছবি: খালেদ সরকার
>

সংযুক্ত আরব আমিরাতে ইউনিভার্সিটি অব উলংগং ইন দুবাইয়ের সহকারী অধ্যাপক জিনাত রেজা খান। শিক্ষার্থীরা কেন পড়ালেখার ক্ষেত্রে অসদুপায় অবলম্বন করে, এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি। মা-বাবা, শিক্ষক, স্কুল কিংবা আমাদের সমাজ কীভাবে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, গবেষণায় উঠে এসেছে তা-ও। ১ জানুয়ারি ঢাকার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে তিনি কথা বলেন এই গবেষণা নিয়ে। সেই বক্তৃতার সংক্ষেপিত রূপ থাকছে এখানে।

পরীক্ষার হলে অসদুপায় অবলম্বনের কৌশল ছোটবেলায় আমি রপ্ত করে ফেলেছিলাম। অতএব ক্লাসে খুব দ্রুতই আমার নাম হয়ে গেল। আমি নিজেকে ‘কুল’ ভাবতে শুরু করলাম। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবা আমাকে ভর্তি করিয়ে দিলেন দুবাইয়ের একটা মিশনারি স্কুলে। ভাবলাম, আগের স্কুলে এই খেল দেখিয়ে যেহেতু আমার অনেক বন্ধুবান্ধব হয়ে গিয়েছিল, এখানেই বা সেই সুযোগ হাতছাড়া করব কেন। প্রথম সেমিস্টারেই আমি অসদুপায় অবলম্বন করে পরীক্ষায় সবাইকে সাহায্য করতে শুরু করলাম। সবাই বলল, ‘ওয়াও! জিনাতের কী দারুণ বুদ্ধি!’

সেই স্কুলে আমাদের যিনি প্রধান শিক্ষক ছিলেন, তাঁকে সবাই বলত ‘টার্মিনেটর’। তো পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগে টার্মিনেটর ক্লাসে এলেন। বললেন, ‘আমি জানি এই ক্লাসে কে কে অসদুপায় অবলম্বন করেছ। তোমাদের আমি তিন দিন সময় দিলাম, এর মধ্যে আমার কাছে এসে স্বীকার করবে। আমি কিচ্ছু বলব না। আর যদি স্বীকার না করো, তাহলে সবাই ফেল করবে।’ আমি তখনো বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বসে আছি। কারণ আমি জানি যে তিনি আসলে ধোঁকা দিচ্ছেন। কিন্তু ক্লাস শেষ হওয়ার ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রায় ২৫টা মেয়ে কান্না শুরু করল। দেখলাম, মহা বিপদ! এরাই তো বলে দেবে!

অতএব আমি শিক্ষকের কাছে গিয়ে অপরাধ স্বীকার করলাম। তিনি নির্বিকার ভঙ্গিতে বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি তোমাকে কিছুই বলব না। কিন্তু একটা শর্ত আছে। তুমি আমাকে যা বলেছ, একই কথা তোমার মা-বাবার কাছে গিয়েও বলবে।’ আমি একটা বড় ধাক্কা খেলাম। শিক্ষকের কাছে বলা যায়। মা-বাবাকে কীভাবে বলি!

তখনো জানতাম না, আমার জন্য আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে। মা-বাবাকে বলার পর জানলাম, তাঁরা দুই বছর আগে থেকেই সবকিছু জানতেন। এমনকি আমার এই সমস্যা দূর করার জন্য, প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেই তাঁরা আমাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন! অর্থাৎ, প্রধান শিক্ষক ক্লাসে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তা আসলে আমার উদ্দেশ্যেই বলা! পরদিন তিনি আমাকে ডেকে নিয়ে অনেক কথা বললেন। এরপরই আমার মধ্যে
একটা পরিবর্তন এল। অসদুপায় অবলম্বনের পেছনে যে শ্রম দিতাম, তা আমার পড়ালেখার পেছনে দিতে শুরু করলাম।

পড়ালেখা শেষে আমি যখন শিক্ষক হলাম, দেখলাম আমার শিক্ষার্থীরা অসদুপায় অবলম্বন করছে। প্রতি পদে পদে তারা কোনো না কোনো অসৎ পথ খুঁজে নিচ্ছে। অতএব, ২০০৫ সাল থেকে আমি এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করলাম। ২০১৪ সালে পিএইচডি সম্পন্ন হলো। শিক্ষার্থীরা কেন অসদুপায় অবলম্বন করে—প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি ৩৯টা কারণ খুঁজে পেয়েছি। মা-বাবা বা বন্ধুদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, ভালো নম্বরের জন্য, শর্টকাট খোঁজার আশায়—আছে এমন আরও নানা কারণ।

সমাজ কী শেখায়?

পড়ালেখার ক্ষেত্রে সততা থাকা যে কতটা জরুরি, আমাদের ছেলেমেয়েরা কিংবা মা-বাবারাও আসলে এর গুরুত্ব সেভাবে বুঝতে পারেন না। কেউ বলতে পারে, ‘পরীক্ষায় নকল করে আমি তো কারও ক্ষতি করছি না’। সেটা কিন্তু ঠিক নয়। ধরুন আমি ক্লাসে একজন শিক্ষার্থীকে হিসাববিজ্ঞান শেখালাম, কিংবা এথিক্যাল হ্যাকিং শেখালাম—কিন্তু তাকে সততার সঙ্গে এর ব্যবহার শেখালাম না, তাহলে কিন্তু সে তার শিক্ষার অপব্যবহারটাই করবে। আমরা প্রত্যাশা করি, একজন শিক্ষার্থী তার বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে সততা, নিষ্ঠা, দায়িত্ববোধও শিখবে। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানও একজন কর্মীর মধ্যে এই গুণগুলো চায়। আপনি নিশ্চয়ই একজন ঠকবাজকে আপনার প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দিতে চাইবেন না।

অসদুপায় নানা রকম হতে পারে। অন্যেরটা দেখে লেখা, অন্যের লেখা নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া, অন্যের সাহায্য নিয়ে কোনো অ্যাসাইনমেন্ট করা কিংবা অন্য কাউকে পরীক্ষায় সাহায্য করা, একজনের পরীক্ষা আরেকজন দিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। ভুলভাবে একটা ফল উপস্থাপন করাও অসদুপায়। প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পড়ালেখায় অসদুপায় অবলম্বনের পরিমাণও বাড়ছে।

পড়ালেখার ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা যেন সৎ থাকে, এই শিক্ষা কি আমরা আমাদের সন্তানদের দিই? উল্টো আমাদের কাছ থেকেই তো ওরা ভুল বার্তাও পায়। আমি হয়তো বাসায় বসে টিভি দেখছি। অফিসের বসের ফোন এল। আমি ফোন ধরে বললাম, ‘আজ তো একটু শরীর খারাপ, আমি আসতে পারছি না।’ এ থেকে আমার সন্তান কী শিক্ষা পেল? আমরা ওকে শিখিয়ে দিলাম, মিথ্যা বলাটা দোষের কিছু না।

এমনকি এই ভুল বার্তা আমরা শিক্ষকদের কাছ থেকেও পাই। আমার বাচ্চাকে একবার স্কুল থেকে বলা হলো, মরুভূমির একটা ছোট্ট অংশের মডেল তৈরি করতে হবে। ওর বয়স ছয় বছর। আমি শিক্ষককে বললাম, ‘এটুকু বাচ্চা এটা কীভাবে করবে?’ শিক্ষক বললেন, ‘কেন? তোমরা ওকে সাহায্য করবে।’ যা হোক, যেদিন প্রজেক্টটা সবার সামনে উপস্থাপন করা হবে, সেদিন দেখি সব বাচ্চা উঠে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘আমার প্রজেক্ট, আমার প্রজেক্ট।’ আমার মেয়ে কিন্তু সেই ভুল করেনি। ও বলেছে, ‘প্রজেক্ট আমার, কিন্তু মা আমাকে সাহায্য করেছেন।’ আমরা নীরবে ছেলেমেয়েদের শিখিয়ে দিই, অন্যের করা কাজের কৃতিত্ব নেওয়াতে দোষের কিছু নেই। স্কুলও প্রত্যাশা করছে, ছেলেমেয়েরা মা-বাবার সাহায্য নিয়ে কাজটা করবে!

গবেষণায় দেখা গেছে, এক-তৃতীয়াংশ মা-বাবা সন্তানকে তার বাড়ির কাজে (হোমওয়ার্ক) সাহায্য করতে চান। শতকরা দশ ভাগ মা-বাবারা স্বীকার করেন, ছেলেমেয়েদের দিয়ে বাড়ির কাজ করানোর চেয়ে নিজেরা করে দেওয়াটা তাঁদের জন্য কম ঝক্কিপূর্ণ। প্রতি দশজনের সাতজন মা-বাবা মনে করেন, তাঁরা বাড়ির কাজ করে দিলে ছেলেমেয়েরা খুশি হয়। দশজনের চারজন মা–বাবা বলেন, তাঁদের করে দেওয়া অ্যাসাইনমেন্টে সন্তান ভালো নম্বর পেলে তাঁদের খুব ভালো লাগে। এমনকি এক-তৃতীয়াংশ মা-বাবা অন্য মা-বাবাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেন! এই প্রতিযোগিতার মধ্যে গিয়ে তাঁরা ভুলেই যান, সন্তানের কিছু শেখা হলো কি না।

ছেলেমেয়ে, মা-বাবা, শিক্ষকেরা কেন এমন করেন, আমরা তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছি। আমরা যা পেয়েছি তা হলো, তারা মনে করেন, শেষ পর্যন্ত তাঁরা যে ফল পেতে চান, সেখানে পৌঁছানোর জন্য এটা কোনো অন্যায় নয়। অর্থাৎ ধরুন, আমার হাসপাতালে যেতে হবে বা বাচ্চাকে স্কুল থেকে নিতে হবে, সে জন্য গতিসীমার ওপরে গাড়ি চালানোকে আমি অপরাধ বলে মনে করছি না।

এই তত্ত্বটাই যদি আমি স্কুল থেকে স্কুলের বাইরে নিয়ে আসি, তাহলে কী দেখতে পাই? চারতলা বাড়ি তৈরির অনুমতি আছে, আমি আটতলা করে ফেলছি—কারণ আমার প্রয়োজন। প্রয়োজনীয়তা থেকে এই অন্যায়টা আমার কাছে অন্যায় মনে হচ্ছে না। অথচ এর জন্য অনেক বড় মাশুল দিতে হতে পারে।

অনুলিখন: মো. সাইফুল্লাহ