আপনি কতটা খুঁতখুঁতে?

শিরোনামের প্রশ্নটির জবাব দিতে গেলে আরেকটি প্রশ্ন এসে যায় অবধারিতভাবে। তা হলো—মানুষ কি সম্পূর্ণ নিখুঁত হতে পারে? ভালোর তো কোনো শেষ নেই। কিন্তু এক জায়গায় থামতেই হয়। কোনো কাজই অনন্তকাল ধরে চলতে পারে না। কারণ, আপনার ঘাড়ে কাজের বোঝা যখন চাপছে, তখন একই সঙ্গে একটি সময়সীমাও চোখ রাঙাচ্ছে। 

একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কোনো কাজ সমাধা করার ক্ষেত্রেই আসে মানের বিষয়টি। এ ক্ষেত্রে কেউ চান কাজটি সঠিকভাবে করতে। আবার কারও লক্ষ্য থাকে, নিখুঁতভাবে কাজ করা। সঠিক আর নিখুঁত—এই দুটি শব্দের অর্থ ভিন্ন। সঠিক কাজ কখনো কখনো মানের দিক থেকে শ্রেষ্ঠ না-ও হতে পারে। তাই বলে খুঁতখুঁতে হতে গিয়ে একটি কাজ নিয়ে দীর্ঘ সময় পড়ে থাকলে দেখা যাবে—কাজটির আসল উদ্দেশ্যই অপূর্ণ থেকে যাবে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিখুঁত হতে চাওয়ার বাসনা এমন এক তলোয়ার, যার দুই পাশেই সমান ধার। এই প্রবণতা একদিকে নিজের মানোন্নয়ন করতে আপনাকে উৎসাহী করবে। অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এই খুঁতখুঁতে স্বভাব আপনাকে দেবে একরাশ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। 

মনোবিদ ও দ্য হেলদি মাইন্ড টুলকিট নামক বইয়ের রচয়িতা অ্যালিস বয়েস বলছেন, নিজের ভালোর জন্যই কিছু চাপ কমিয়ে ফেলতে হবে। যদিও এটি বলা যতটা সহজ, করা ততটাই কঠিন। তবে যদি কেউ জীবনে অর্জনের বিষয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হন, তবে তাঁকে অবশ্যই কিছু কাজ খুঁত রেখেই করতে হবে।

মানুষ কেন খুঁতখুঁতে হয়? 

অনেকে মনে করেন, একটি মানুষ জন্ম থেকেই খুঁতখুঁতে হতে পারে। আবার কারও মতে, শৈশব থেকে শুরু করে তরুণ বয়স পর্যন্ত সময়সীমায় যখন মানুষের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠতে থাকে, তখনো একজনের স্বভাব খুঁতখুঁতে হয়ে উঠতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, এই দুটি কারণই যৌক্তিক। বংশগতির প্রভাবে যেমন একজন খুঁতখুঁতে হতে পারে, তেমনি বাবা-মায়ের মানসিক প্রবণতা এবং পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশও এতে প্রভাব রাখে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, সন্তানের প্রতি মা–বাবার অত্যধিক চাহিদা, সমালোচনা প্রভৃতি একজনের মধ্যে খুঁতখুঁতে হওয়ার প্রবণতা গড়ে তুলতে পারে।

খুঁতখুঁতে হওয়ার লক্ষণ এবং বিপত্তি 

সাধারণত অতিমাত্রায় খুঁতখুঁতে মানুষ কখনোই ভুল করতে চান না। যে কাজটি মাত্র শেষ হয়েছে, তাতেও তাঁদের পূর্ণ সন্তুষ্টি থাকে না। নিজেদের কাজের মান উঁচু তারে বাঁধার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদের কাছ থেকেও একই প্রত্যাশা থাকে তাঁদের। হয়তো ওই ধরনের উচ্চ মান অর্জন কখনোই সম্ভব নয়, কিন্তু তবু তাঁরা সেই প্রত্যাশা থেকে সরে আসেন না। এর ফলে যে উদ্বেগের পাহাড় তৈরি হয়, তা আবার দৈনন্দিন জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, খুঁতখুঁতে ব্যক্তি হয়ে ওঠেন নিজের সবচেয়ে বড় সমালোচক। কখনো কখনো সেই সমালোচনা অযৌক্তিকও হয়ে ওঠে। 

২০১৮ সালে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, খুঁতখুঁতে স্বভাব একজন মানুষকে অসুখী করে তুলতে পারে। এই গবেষণা চালান ইউনিভার্সিটি অব বাথ-এর গবেষকেরা। উত্তর আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যের প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর ওপর সমীক্ষা করে দেখা গেছে, তরুণেরা নিখুঁত হতে অযৌক্তিক জোর দিচ্ছেন। এর পেছনে উচ্চাকাঙ্ক্ষী মা–বাবার অবদান সবচেয়ে বেশি। আর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতা বাড়তেই থাকে। ফলে চাপ পড়ে মনে, সুখ যায় পালিয়ে। 

লিডারশিপ ট্রেইনার ও ফোর্বস কাউন্সিল সদস্য আন্দ্রেজ স্মিখ বলছেন, সব সময় নিখুঁত হতে চাওয়ার ইচ্ছা একজনের শরীর ও মনে প্রচণ্ড ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এর তালিকায় আছে অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি থেকে শুরু করে মাত্রাতিরিক্ত উদ্বেগ, বিষণ্নতায় ভোগা ইত্যাদি। এ কারণে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে একজন ব্যক্তি সম্পূর্ণ একা হয়েও যেতে পারেন। কারণ, খুঁতখুঁতে স্বভাবের কারণেই তাঁদের পক্ষে একটি দলের অংশ হয়ে যূথবদ্ধভাবে কোনো কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

যেভাবে সামলানো যায়

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েসলেয়ান ইউনিভার্সিটির শিক্ষক রেবেকা নাইটের মতে, কোন কাজটি নিখুঁতভাবে করা প্রয়োজন, আর কোনটি নয়—সে বিষয়ে সঠিক বিচার করা জরুরি। কারণ, পরীক্ষার খাতায় একটি প্রশ্নের উত্তর খুব সুন্দরভাবে লেখার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর দেওয়াও পাস করার জন্য জরুরি। খুঁতখুঁতে স্বভাবের ব্যক্তিরা প্রায়ই নিজের ভুলে খুব বেশি মাত্রায় ভেঙে পড়েন। নিজেদের ব্যর্থতা তাঁরা মেনে নিতেই পারেন না। এসব বিষয়ে সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। 

খুঁতখুঁতে চরিত্রকে সামলাতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। প্রথমত, অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা বন্ধ করতে হবে। এতে নিজের ব্যর্থতা একজন ব্যক্তির কাছে আরও বড় হয়ে উঠতে পারে। ফলে নেতিবাচক মানসিকতা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। তখন আমের সঙ্গে সঙ্গে ছালাও হাওয়া হয়ে যেতে পারে। তাই সুফল বা কুফল, যা–ই আসুক, মেনে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে। বিশেষ করে নিজের ব্যর্থতা মেনে নেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর, কর্মক্ষেত্রে ভুল বা ব্যর্থতা মেনে নিয়ে নতুন উদ্যমে কাজে নামার বিকল্প নেই। তবে তাই বলে ব্যর্থতার কথা ভেবে ভেবে মন ভেঙে ফেলবেন না যেন! ইতিবাচক থাকতেই হবে। 

দ্বিতীয়ত, লক্ষ্য বাস্তবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতে হবে। অবাস্তব কোনো লক্ষ্য কখনো নিখুঁতভাবে পূরণের কথা ভাবলে, তা বাস্তবায়নে নিরাশ তো হতেই হবে। অর্থাৎ, অর্জনযোগ্য কোনো লক্ষ্যকেই নিশানা করতে হবে। দরকার মনে করলে, এসব নিয়ে আস্থাভাজন কারও সঙ্গে মন খুলে আলোচনাও করা যেতে পারে।

তৃতীয়ত, খুঁতখুঁতে স্বভাবের মানুষের জন্য একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো বেশ কষ্টসাধ্য। শুরুতে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে হবে। এরপর বিকল্প সব পথ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। শেষ কাজ একটাই—সিদ্ধান্ত নেওয়া ও কাজে নেমে পড়া। প্রয়োজনে তালিকা করে কাজ করুন। এই পুরো প্রক্রিয়ায় বিশ্বাস হারালে চলবে না। বিশ্বাস রাখুন, কাজে দেবে।

তথ্যসূত্র: হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, ফোর্বস, জর্ডান টাইমস ও দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস