বয়স যখন ১২০ ছুঁই-ছুঁই

রাই শশী নিবাসের সিংহদ্বার। ছবি: লেখক
রাই শশী নিবাসের সিংহদ্বার। ছবি: লেখক

ক্ষয়ে যাওয়া পলেস্তারা, আর পরজীবী উদ্ভিদ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এসব বাড়ি একেকটা ধূসর পাণ্ডুলিপি। এদের পরতে পরতে গল্প আর ইতিহাস। কখনো কোনো নির্জন দুপুরে এই ধূসর বাড়িগুলো যদি একসঙ্গে কথা বলে উঠতে পারত, তাহলে লেখা যেত না জানা কত গল্প, কত হাসিকান্নার দিনযাপনের কাহিনি। সে জন্যই হয়তো প্রাচীন বাড়িগুলো মানুষকে আকর্ষণ করে ভীষণভাবে। তেমনই একটি পুরোনো বাড়ির কাছে গিয়েছিলাম। নাম তার রাই শশী নিবাস। বয়স প্রায় ১২০ বছর হতে চলল। কোথায় এই রাই শশী নিবাস?

আমাদের জাদুর শহর থেকে খুব কাছে রাজা হরিশ্চন্দ্রের রাজধানী বলে খ্যাত সাভার অঞ্চলে। রাই শশী নিবাসের কথা বলার আগে ঐতিহাসিক অঞ্চল সাভারের কথা একটু বলে নিই। ঢাকা অঞ্চলের প্রাচীন জায়গাগুলোর মধ্য অন্যতম সাভার। যুগে যুগে এই অঞ্চলে ছিল হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজা, মুসলিম শাসক ও জমিদারদের বসবাস। ঢাকা থেকে ২৪ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে বংশাই নদের বাঁ তীরে এর অবস্থান। ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালী এখানে জরিপ চালিয়েছিলেন ১৯২১ সালে; সে সময় প্রাচীন কিছু ধ্বংসাবশেষ খনন করে দেখা মেলে বিভিন্ন বিষ্ণুমূর্তি, মুদ্রা আর পাত্রের ভগ্নাংশের। সেসব প্রত্নতাত্ত্বিক উদাহরণ দেখে অনুমান করা হয়, সাভার অঞ্চল ১ হাজার ২০০ বছরের পুরোনো। যদিও সেসব ধ্বংসাবশেষের খুব অল্পই বর্তমান, এমনকি আঠারো ও উনিশ শতকের বাড়িঘরও হাতে গোনা দু-চারটিই এখনো আছে। আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিক ‘সম্ভার’ নাম থেকে সাভার নামের উৎপত্তির কথা বলেছেন এবং সভার, সেউরা বা সুরা নামে এক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জনগোষ্ঠী বসবাসের আলামতের সঙ্গে যুক্ত করে এই অঞ্চলকে প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো বলছেন তাঁরা। তবে এ সম্পর্কে নৃতাত্ত্বিক কোনো সূত্রের কথা জানা যায় না।

মূল ভবনে নামফলক। ছবি: লেখক
মূল ভবনে নামফলক। ছবি: লেখক

মূল প্রসঙ্গে আসি, রাই শশী নিবাস সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে খুব বেশি দূরে নয়। আড়াপাড়া এলাকায় এই বাড়ির অবস্থান হওয়ার কারণে স্থানীয় লোকজন একে আড়াপাড়া জমিদারবাড়ি বলে। প্রায় ১২০ বছর আগে সাভার উপজেলায় আড়াপাড়া নামক জায়গায় এই জমিদারবাড়ি তৈরি করা হয়। এখানে দুটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল। একটি করা হয়েছিল ১৯০০ সালে। পরবর্তী সময়ে আরেকটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। মূল প্রাসাদটিতে লেখা রয়েছে ‘রাই শশী নিবাস’। আর পরে যে প্রাসাদ তৈরি করা হয়েছিল, সেটিতে লেখা রয়েছে ‘রাই নিকেতন’। রাই নিকেতনের একদম ওপরে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে RM House। শুনেছিলাম দ্বিতীয় বাড়িটিতে সরকারি একটি হোল্ডিং নম্বর দেওয়া আছে, সেটাও পাওয়া গেল খুঁজে। সেই হোল্ডিং নম্বর অনুসারে এই এলাকার নাম ‘সুতার নোয়াদ্দা’। তবে স্থানীয় কিছু কিছু দোকানের সাইনবোর্ড, ব্যানারে আড়াপাড়া লিখে বন্ধনীতে সুতার নোয়াদ্দা নামটি লেখা আছে দেখলাম।

খুব কম তথ্যই পাওয়া গেছে রাই শশী নিবাস সম্পর্কে। রাস্তা থেকে প্রথমে চোখে পড়বে একটি মন্দির, এটি এই বাড়ির রাধা–গোবিন্দ মন্দির। মন্দিরের প্রবেশদ্বারটি কাঠের এবং কারুকাজ করা—যদিও এখন কিছুটা জৌলুশহীন, যত্নের অভাবে। সামনে একটি রাস্তা চলে গেছে মূল বাড়ির দিকে। মন্দিরের সামনের পুকুরটিও তার নিজস্ব কমনীয়তা হারিয়েছে বেশ আগেই।

কাঠের দরজা গলে মন্দির দেখা যাচ্ছে। ছবি: লেখক
কাঠের দরজা গলে মন্দির দেখা যাচ্ছে। ছবি: লেখক

মন্দিরের সেই ফটক থেকে বেশ বড় মূল মন্দিরটি চোখে পড়ে। দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম দুজন বয়স্ক নারী মন্দিরের সিঁড়িতে বসে কাজ করছেন। কাছাকাছি গিয়ে কথা বলতে চাইলাম। তাঁদের মধ্যে একজন কথা বলে উঠলেন। নিজের নাম বললেন লক্ষ্মী রানী। তিনি এই মন্দির দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন প্রায় ৫০ বছর। আরও জানালেন, তাঁর মা, ঠাকুরমাও এই মন্দিরে কাজ করেছেন। বংশপরম্পরায় তাঁরা এই বাড়ির মন্দিরের দেখভাল করছেন। লক্ষ্মী রানীর বয়স এখন ৮৫। উনি বেশ শুদ্ধ ও স্পষ্ট ভাষায় কথা বলেন। লক্ষ্মী রানী অল্প কিছু তথ্য দিলেন এই রাই শশী নিবাস সম্পর্কে।

রাইমোহন ও শশীমোহন সাহা ছিলেন দুই ভাই। শশীমোহনের ঘরে ছিল তিন ছেলে এবং রাইমোহনের ঘরে ছিল চার ছেলে। বর্তমানে বাড়িতে জমিদার বংশের কে বা কারা আছেন, জানতে চাইলাম। লক্ষ্মী রানী জানালেন, বংশের তৃতীয় পুরুষ বসবাস করছে এখন। রাইমোহন ও শশীমোহনের নাতির ঘরের পুতিরা আছেন এখানে। তিনি আমাদের ভেতরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে জানালেন, ভেতরে গেলে আরও কিছু জানতে পারব। লক্ষ্মী রানীর কথামতোই কাজ করলাম।

মূল ভবনের দিকে অগ্রসর হলাম। সেখানে মূল ফটকের ধ্বংসাবশেষ এখনো আছে। বাঁ দিকের গেটের পুরোনো লোহার কবজা আর ডান দিকে জীর্ণ এক সিংহমূর্তি অভিবাদন জানাল। গেটের দুপাশের রাস্তার রোমান স্টাইলের দণ্ডায়মান নারীমূর্তিগুলো খুবই নান্দনিক। যদিও তাদের কারও এক হাত, কারও নাক, কারও থুতনি বিলুপ্ত। তারপর আর একটি ফটক, মূল প্রবেশদ্বারের পর আরও একটি প্রবেশদ্বার। সেখানে দেখলাম কয়েকজন নারী আর একজন পুরুষ কথা বলছেন। নিজের পরিচয় দিলাম। জানা গেল, তাঁরা এ বাড়িতে ভাড়া থাকেন। এটাও জানা গেল, বাড়ির মালিক ভেতরেই আছেন।

রাধা–গোবিন্দ মন্দিরের প্রবেশদ্বার। ছবি: লেখক
রাধা–গোবিন্দ মন্দিরের প্রবেশদ্বার। ছবি: লেখক

ভেতরে যেতে থাকলাম। অল্প দূর গিয়েই দেখলাম আরেকজন নারী বসে আছেন মূল ভবনের বারান্দায়। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার জমিদারবাড়িতে ঢোকার পূর্বাভিজ্ঞতা থেকে আগেভাগেই বললাম, ‘ঢাকা থেকে বেড়াতে এসেছি, বাড়িটা দেখে ভালো লাগল, তাই ঢুকলাম।’ অনুমতি নিলাম ছবি তোলার। ওই নারী সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি দিলেন। বললেন, অনেক মানুষই দেখতে আসে, ছবি তোলে। মূল ভবনের সিঁড়ির দুপাশেও দুটি নারীমূর্তি, একই রকম জীর্ণ। বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ঘোরার সময় স্বল্পসংখ্যক জমিদারবাড়িতে আমি দেখেছি রোমান স্টাইলের নারীমূর্তি। এই মুহূর্তে মনে পড়ছে ময়মনসিংহ জেলার শশী লজ আর নাটোর জেলার উত্তরা গণভবনের নারীমূর্তি দুটির কথা।

আমি যখন বাড়িটা ঘুরে দেখছিলাম, সে সময় বাড়িতে কোনো পুরুষ লোক ছিলেন না কথা বলার মতো। বারান্দায় বসে থাকা একজন নারী তাঁর পরিচয় দিলেন, এ বাড়ির নাতবউ বলে। তাঁর স্বামী ছেলে ও ছেলের বউ বাস করেন এই ভবনে। রাইমোহন ও শশীমোহন কোথা থেকে এখানে এসেছিলেন, এ ভবন তৈরি হওয়ার আগে এই পরিবার কোনো পেশায় নিযুক্ত ছিল, কোনো তথ্যই ভদ্রমহিলা দিতে পারলেন না।

রাই নিকেতন ভবন। ছবি: লেখক
রাই নিকেতন ভবন। ছবি: লেখক

তারপর এগিয়ে গেলাম পরের ভবনটির দিকে। নাম আগেই বলেছি, রাই নিকেতন। ভবনটির ওপরে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে RM House. সেখানে পাওয়া গেল ৩০ থেকে ৩৫ বছরের এক যুবককে। তিনি বলেন, ‘এই জমিদারবাড়ির পূর্বপুরুষ এসেছিলেন বংশাই নদের ওপাশ থেকে।’ নিজেদের তাঁরা জমিদারের বংশধর বলে পরিচয় দেন। সময়টা সন্ধ্যা হবে হবে করছিল। যুবকটি বললেন, এখন পূজার সময়, আর সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তাই ভেতরে না ঢোকাই ভালো। কী আর করা, ভেতরে না ঢুকে বারান্দা থেকে রাই নিকেতনের কিছু ছবি তুলে ফেরার পথ ধরলাম।

রাই শশী নিবাসে যাবেন যেভাবে
সাভার বাসস্ট্যান্ডের ফুটওভারব্রিজের পশ্চিম পাশ থেকে হেঁটে অথবা ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় সাভার বাজার। সাভার বাজার থেকে আবার অটোরিকশায় আড়াপাড়া নেমে একটু হেঁটে পৌঁছানো যাবে আড়াপাড়া জমিদারবাড়ি বা রাই শশী নিকেতন। অথবা রিকশাযোগে সাভার বাসস্ট্যান্ড থেকে একবারে আড়াপাড়া।