সন্তানের প্রযুক্তি আসক্তি কমাতে

ক্লাস নাইনে পড়ুয়া মনন (ছদ্মনাম)। একটা সময় বইয়ের পোকা ছিল। গোগ্রাসে গল্পের বই পড়ত। কিন্তু বছরখানেক আগে মায়ের একটি পুরোনো মুঠোফোনের মালিকানা পেয়ে সে ডুবে গেছে নানান ধরনের গেমে। আর বই পড়ে না, বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটায় না, মা-বাবার সঙ্গে কোনো দাওয়াতে যেতে চায় না, সারা দিন মুখ গুজে থাকে মুঠোফোনে।

ইদানীং স্কুলের রেজাল্টও খারাপ হচ্ছে, সারা রাত জেগে থাকে আর অনেক বেলা অব্দি ঘুমায়। খাবারের প্লেট নিয়ে নিজের ঘরে বসে গেম খেলতে খেলতে খায়। মননের মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে গেছে, কথায় কথায় রেগে যায়।

মননের মতো আরও অনেক কিশোর–তরুণ রয়েছে, যারা ইন্টারনেট বা মুঠোফোনে আসক্ত। কেউ গেমে আসক্ত, কেউবা ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, আবার কেউ পর্নোগ্রাফিতে। এই আসক্তির বিষয়টি সারা পৃথিবীতেই গুরুত্বপূর্ণ মনোস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনলাইন গেম, মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

নিষিদ্ধ কোনো বিষয় নয়, তবে...

ইন্টারনেট বা গেম খেলা কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নয়। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইন্টারনেটে দক্ষ হতেই হবে, প্রযুক্তি জানতেই হবে। কিন্তু এর ক্ষতিকর, অযৌক্তিক, অপরিমিত ব্যবহার বা গেম খেলার বিষয়টি যখন কারও চিন্তা আর আচরণের ওপর খারাপ ধরনের প্রভাব ফেলে, সামাজিক দক্ষতা কমিয়ে দেয় বা দৈনন্দিন জীবনযাপনের মান খারাপ করে দেয়, তখন সেটাকে আসক্তি বলা হয়।

মুঠোফোনের আসক্তি কমাতে বাবা–মায়েরা যা করতে পারেন

* শিশুকে গুণগত সময় দিন। অর্থাৎ যতটুকু সময় সন্তানের সঙ্গে থাকবেন, ততটুকু সময় তার সঙ্গে কথা বলুন, খেলুন। ইন্টারঅ্যাকটিভ থাকুন।

* বাড়িতে একটি ছোট লাইব্রেরি গড়ে তুলুন। মা–বাবা নিজেরা বই পড়ুন, বই কিনুন। বই নিয়ে বাসায় পারিবারিক আলোচনা করার চর্চা করুন। কোন বইটি কেমন লাগল, নিজেরা আলাপ করুন, সন্তানকেও তার পড়া একটি বই নিয়ে কথা বলতে উৎসাহিত করুন।

* পরিবারের সবাই মিলে বাসায় ক্যারম, লুডু, দাবা, মনোপলি ইত্যাদি খেলুন। নিয়ম করে সবাই মিলে বেড়াতে যান। মাঠের খেলার প্রতি উৎসাহ দিন। পরিবারের সবাই মিলে গান শুনুন, সিনেমা দেখুন। সবাই একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসে খান।

* মা-বাবা নিজেরাও যদি প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত থাকেন, তবে সবার আগে নিজের আসক্তি দূর করুন। আর সন্তানের চেয়ে প্রযুক্তিজ্ঞানে একধাপ এগিয়ে থাকুন। ‘আমার সন্তান আমার চাইতে অনেক বেশি ইন্টারনেটের খুঁটিনাটি জানে’ বলে আত্মতৃপ্ত হবেন না। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ নিয়ে আপনি নিজে সেগুলো জানুন, বুঝুন।

* সন্তানকে গ্যাজেট আর ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিলে তার একটি সময়সীমা বেঁধে দিন। সন্তানের সঙ্গে চুক্তিতে আসুন, যাতে সময়সীমা মেনে চলে।

* প্রয়োজনে আপনি নিজে সন্তানের সঙ্গে মাঝেমধ্যে মুঠোফোনে গেম খেলুন। নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গেম খেলা বন্ধ করে দিন। এতে তার সময় ব্যবস্থাপনা (টাইম ম্যানেজমেন্ট) ভালো হবে।

* বাসায় একটি বড় সাদা বোর্ড বা সাদা কাগজে সন্তানের প্রতিদিনকার মুঠোফোন/গ্যাজেট ব্যবহারের সময়ের একটা গ্রাফ তৈরি করুন। সন্তানের কাছে দৃশ্যমান হবে যে সে কতটা সময় এই কাজে ব্যয় করছে।

* আপনার সন্তান নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে কতটুকু সক্ষম, তা আগে বিবেচনা করে এরপর তার হাতে মুঠোফোন বা গ্যাজেট তুলে দিন।

* সন্তান যদি নিজে এই আসক্তি থেকে বের হয়ে আসতে চায়, তবে তাকে ব্যঙ্গ–বিদ্রূপ না করে, টিপ্পনী না কেটে সহায়তা করুন।

* প্রযুক্তি বা ইন্টারনেট-আসক্তি কিন্তু মাদকাসক্তির মতোই একটি সমস্যা। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে এই আসক্তি দূর করুন।

আহমেদ হেলাল : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।