আঁকায় বাড়ুক শিশুর সৃজনশীলতা

শিশুকে তার মতো করে আঁকতে দিতে হয়। মডেল: মৃন্ময়ী, ছবি: সুমন ইউসুফ
শিশুকে তার মতো করে আঁকতে দিতে হয়। মডেল: মৃন্ময়ী, ছবি: সুমন ইউসুফ

আমার মেয়ে ও তার তিন বন্ধু আয়েশ করে ছবি আঁকছে। আর নিজেরাই কী সব বলাবলি করে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। ওরা ব্যস্ত থাকায় আমি হাতের কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ ওরা চারজনই হুড়মুড়িয়ে ছুটে এল। বলতে হবে কার আঁকা ছবি কেমন হয়েছে। ওদেরই বলতে বললাম কে কী এঁকেছে তার বিবরণ দিতে। একজন এঁকেছে, সবুজ রঙের সূর্য আর একজনের আঁকা আকাশটা পুরোপুরি কালো। কেন এমন এঁকেছে, প্রশ্ন করে জবাব পেলাম, গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্য দেখা যাচ্ছে বলে সূর্যের আলো সবুজ হতে হতে সূর্যটাই সবুজ হয়ে গেছে। অন্যজন বলেছে, সে রাতের আকাশ এঁকেছে বলেই আকাশের রং কালো। 

একবার ভেবে বলুন তো, ওদের মতো করে আসলেই আমরা ভাবতে পারি? প্রতিটি শিশু সাধারণত প্রতিটি উপাদান খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে, নিজের মতো করে ভাবে আর ওর নিজস্ব ভাবনাটাকেই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে ছবি আঁকার মাধ্যমে। রং দেখলেই ওরা আনন্দিত হয়। উপহার হিসেবে নানান মাধ্যমের রং পেতে ও তা দিয়ে আঁকতে শিশুরা খুব ভালোবাসে। আর রংতুলির অসাধারণ গুণ হচ্ছে, সেটির নেশায় ডুবে একবার আনন্দের স্বাদ পেয়ে গেলে শিশুকে অনায়াসেই মুঠোফোন ট্যাবে আসক্তি থেকে দূরে রাখা সম্ভব। আঁকিবুঁকির সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর মধ্য দিয়ে শিশুর মধ্যকার সুপ্ত সত্তা যেমন জেগে ওঠে, সেই সঙ্গে শিশুর শারীরিক ও মানসিক উভয়েরই বিকাশ ঘটে। ওদের ছোট ছোট হাতের ছোঁয়ায় তুলি থেকে রঙের নড়াচড়াতেই সাদা কাগজের ওপর প্রকাশ পেতে থাকে তাদের বলতে চাওয়া কথা, কল্পনা, ভাবনা, স্বপ্ন, রাগ, দুঃখ, অভিমান, চেনা-অচেনা জীবনের নানা বিষয়। এক রঙের সঙ্গে অন্য রঙের বন্ধুত্ব তৈরি করে ওরা নিজের মতো করে আগামী দিনের স্বপ্নগুলোকে সাজিয়ে ফেলে মনের অজান্তে বুঝে কিংবা না-বুঝেই। 

কার্টুনিস্ট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের ফলিত কলা বিভাগের প্রভাষক সাদাতউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, সাধারণত শিশুরা দুরন্ত প্রকৃতির হয়। মনোযোগ দিয়ে কোনো কাজ করার যে চর্চা, সেটি মূলত ছোটবেলায় ছবি আঁকার মাধ্যমেই হয়। বড় হয়ে যে পেশাতেই সে যাক না কেন, প্রতিটি জিনিস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা, মনোযোগ দেওয়া, নিজের মতো করে বুঝে করতে পারার ক্ষমতাটাই তৈরি হয় ছবি আঁকার মাধ্যমে, যা পরবর্তী সময়ে সে কাজে লাগায় মাত্র। তাই ছোট থেকেই ছবি আঁকতে দেওয়া উচিত সব শিশুকে। শিশুকে তার নিজের মতো করে আঁকার উপাদান ও পরিবেশ দিয়ে আঁকার জন্য প্রশ্রয় দিতে হবে। একেবারেই আঁকার হাতেখড়িতে প্যাস্টেল বা ক্লেয়ন রং দিলেই ভালো। অনেকে কাঠপেনসিল দিয়ে শুরু করলেও যেহেতু এমন রঙের মুখটা বেশ সরু ও শক্ত ধাঁচের, কাজেই সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। শিশু তার ইচ্ছামতো যা খুশি আঁকবে। কিছু কাগজ নষ্ট করবে, সে ক্ষেত্রে তাকে বকাঝকা একেবারেই করা উচিত নয়। সব আঁকাই যে পরিপূর্ণ নিখুঁত ছবি হবে, এমনটা বড়দের কিছুতেই আশা করা উচিত নয়। 

শিশুরা যেহেতু রং ভালোবাসে, তাই রঙিন ছবি আঁকতেও ভালোবাসে। তাই তারা আঁকবে তাদের ইচ্ছেমতো। ‘যখন শিশু পেনসিল ধরা শেখে, তখন থেকেই তাকে ছবি আঁকতে দেওয়া যায়। এমনকি স্কুলে যাওয়ার আগে হলেই বরং ভালো। ছয় বছর বয়স পর্যন্ত একেবারেই ছবি আঁকানো বা রং করা বড়দের মতো করে শিশুদের শেখানো উচিত নয়। এতে ও ভালোভাবে হাত ঘুরিয়ে লেখা রপ্ত করতে পারে, হাতের লেখাও সুন্দর হয়। শিশু তার নিজের মতো করে ইচ্ছেমতো যা খুশি আঁকবে, সেটিই ভালো। বরং যেকোনো বিষয় শিশুকে বুঝিয়ে দেওয়া ও শিশু তার মনের কল্পনার মিশেলে আঁকাটাই শিশুর সৃজনশীলতা।’ জানালেন চিত্রশিল্পী ও স্কলাস্টিকা স্কুলের ছবি আঁকার শিক্ষক ফারেহা জেবা। 

এভাবেই রঙের খেলায় মেতে থাকলে শিশুর শৈশব হবে রঙিন। আর যেহেতু সে নিজের কল্পনা থেকে কিছু চিত্রে ফুটিয়ে তুলবে, তাই সেটাতে উৎসাহ দিতে হবে। এতে শিশুর ভাবনার জগৎও বড় হবে।