শুধু মেয়েদের বেড়ানোর গল্প

মেয়েরা এখন দল বেঁধে ঘুরছেন দেশ–বিদেশে। ছবি: সংগৃহীত
মেয়েরা এখন দল বেঁধে ঘুরছেন দেশ–বিদেশে। ছবি: সংগৃহীত

আমরা। মানে নন্দিনী, পদ্মা, লোপা আর আমি। চার বন্ধু। চাকরি-সংসার-সন্তান নিয়ে নিত্য–অভ্যস্ততায় বাঁধা। ভ্রমণটা সেখানে বিলাসিতা বৈকি! তবু অনেকটা সময় ধরে চারজনের শিডিউল মিলিয়ে পৌঁছে গেলাম হিমালয়–কন্যা নেপালে। ক্যাম্পাস জীবনের সুখ–দুঃখ ভাগ করে নেওয়া বন্ধুরা একসঙ্গে ২৪ ঘণ্টার ছকে। যাপিত জীবনে দীর্ঘ বিরতির পর যেন অবসরের হাতছানি। আর সে জন্য বোধ করি, চারপাশের অনেক মানুষের ‘একা একা চারটা মেয়ে যাবা!’ ধরনের মন্তব্য অনায়সে এড়িয়ে যেতে পেরেছি। অথবা চারজন কীভাবে একা হই, সেই বোধ জাগ্রত করার প্রয়োজনই অনুভব করলাম না।

নেপাল বেছে নিয়েছিলাম। কারণ, আমাদের সবারই নিস্তব্ধতা উদ্​যাপন জরুরি ছিল। আর সে সুযোগ পাহাড় ছাড়া আমাদের আর কে দেবে! দেশের ভেতরে ভ্রমণে মেয়েদের কিছু সীমাবদ্ধতা ও নিরাপত্তার ঘাটতির কারণে আমাদের নেপালে যাওয়া। অবশ্য আমরা চারজনই নিজেদের পেশায় প্রতিষ্ঠিত। ফলে সহজ হয়েছে দেশের বাইরে ভ্রমণের খরচ বহন করা।

মনে প্রশ্ন আসছে? চারজন নারীই কেন, পুরুষ বন্ধু কিংবা স্বামী-সন্তানসহ নয় কেন? সহজ কথায় বললে, মনের মিল আর নিত্যজীবনের ক্লান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার বাসনা ছিল আমাদের। যেখানে আমরা একেকজনের একেক রঙের আনন্দ–বেদনা আপন মনে ভাগ করে নিতে পারব। এসব থেকেই আকাশে ওড়ার বাসনা ছিল আমাদের। নেপালের পোখরাতে ভয়–সংকোচ পেছনে ফেলে তাই তো প্যারাগ্লাইডিং করে ফেললাম। আকাশে উড়তে উড়তে উপলব্ধি করছিলাম, আমরা মেয়েরা কতো আনন্দ–অনুভূতি থেকে নিজেদের বঞ্চিত করি! সারা দিন আড্ডা আর পাহাড়ের স্বর্গীয় দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে নিজেদের উদ্​যাপন করেছি। গোধূলি পেরিয়ে অন্ধকার নেমে এলেও পোখরার ফেওয়া লেককে পর মনে হয়নি। কেউ এসে বলেনি, রাতের বেলা মেয়েরা কেন অসীম নীরবতায় খোলা আকাশের নিচে!

মা হওয়ার কারণে বার বার মনে পড়ছিল ছেলের কথা। অবশ্য ভিডিও কলে কথা বলে মন খারাপ কিছুটা কমানোর চেষ্টা করলাম। তবে জীবনসঙ্গী যখন নিত্যদায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মুক্ত মনে বলে, ‘তুমি নিশ্চিন্তে উপভোগ করো সময়’, তখন কিন্তু সেটা টনিকের মতো কাজ করে।

সব শংকা দূর করে নেপালে প্যারাগ্লাইডিং করছেন লেখক
সব শংকা দূর করে নেপালে প্যারাগ্লাইডিং করছেন লেখক

পাঁচ দিনে একবারের জন্যেও মেয়ে হিসেবে ঘুরতে এসে কোনো সমস্যা অথবা প্রতিবন্ধকতায় পড়তে হয়নি। পাচঁ দিনের অনাবিল আনন্দ শেষে যখন ঢাকায় ফিরি, তখন পরিচিত একটি গানের দুটি লাইন আমরা চার বন্ধু বার বার গাইছিলাম, ‘ভাবি শুধু এখানেই থাকবো, ফিরে যেতে মন নাহি চাইছে...’।

ভ্রমণনামা এখানেই শেষ করা যেত, কিন্তু আমাদের মতো ঘর হতে দু পা ফেলিয়া দুনিয়া দেখার আরও দল আছে। তাদের গল্পটা লেখার লোভ সামাল দিতে পারলাম না।

কাজী শান্তা। স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বয়স মাত্র ২৫ বছর। এরই মধ্যে প্রায় ২৪-২৫ বার নারীদের নিয়ে ভ্রমণের আয়োজন করে ফেলেছেন। নিজেও নারী দল নিয়ে কেওক্রাডংয়ের মতো দেশের অপরূপ সব জায়গায় ঘুরে বেড়ান অবলীলায়। বলেন, ‘সমস্যায় তো পড়তে হয়েছে অনেক, নিরাপত্তাশঙ্কা নিয়েই ঘুরে বেড়াতে হয়। যৌন হয়রানির মতো খারাপ অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তবু দেশের যেখানেই গেছি, সব বয়সী মেয়েদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।’

এমনকি ষাটোর্ধ্ব নারীরা, যাঁরা পুরো জীবনে সংসার নামের চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে ‘চক্ষু মেলিয়া’ সুন্দর দেখেনি, তাঁরাও ভ্রমণে যাচ্ছেন। ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ (ভ্রমণকন্যা) নামে মেয়েদের ভ্রমণবিষয়ক একটি ফেসবুক গ্রুপের অ্যাডমিন শান্তা। সবাইকে আপন আনন্দে ঘুরে বেড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, মেয়েরা নিজেরাই আত্মরক্ষায় নানা উদ্যোগ নিয়ে ভ্রমণে যাচ্ছেন।

চাকরিজীবী অনামিকা তাসমিন, সুমাইয়া তাসনিম অথবা শিক্ষার্থী আভা কখনো পাহাড়ে, কখনো সমুদ্রে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, দেশের মধ্যে নিরাপত্তাশঙ্কা থাকবেই, সমাজ মেয়েদের আনন্দ–ভ্রমণ নিয়ে কটু কথাও হয়তো বলবে। এতে মেয়েরা থেমে থাকবে না, বরং প্রতিরোধ আর প্রতিবাদ করে এগিয়ে যাবে। এভাবেই পরিবর্তন আসবে পরিবার থেকে সমাজ বা দেশে।

মানসিকতা মিলে যায়, এমন বিভিন্ন বয়সী নারীও একসঙ্গে দল বেঁধে বেড়াতে যাচ্ছেন। গণমাধ্যমকর্মী মোহসিনা শাওন জানান, মেয়েরা ঘুরে বেড়াতে গেলে নানা ধরনের সমস্যা হয়, সেগুলো জয় করে তাঁরা কিন্তু দেশ ও দেশের বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তবে দেশের বাইরে সহযোগিতা বেশি পেয়েছেন এবং নিরাপদ বোধ করেছেন। তাঁদের দলে ছিলেন গৃহিণী সাবিনা ইয়াসমিন। তাঁর স্বপ্নের বাইরে ছিল পরিবার ছাড়া একা ঘুরতে যাওয়া। বাচ্চার জন্য খারাপ লাগা ছিল, সেটাকে খুঁচিয়ে আরো বাড়িয়ে দেওয়ার কাজটা করেছেন চারপাশের মানুষ। এই সময়ে পরিবার ও স্বামীর পাশে থাকার ঘোষণাও বেশ কাজ করেছিল। তাই ভুটানে গিয়ে সাবিনা হঠাৎ নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন ভিন্নভাবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী