রিমঝিমের প্রথম পাঠ

৪ মার্চ প্র অধুনায় একটা লেখা পড়লাম ‘রনন যেভাবে বইপোকা হলো’। রননের মা ও বাবা সন্তানের মুঠোফোনে আসক্তি কমিয়ে বইয়ের দিকে আগ্রহ বাড়িয়েছেন। তাঁদের সেই অভিজ্ঞতা পড়তে গিয়েই মনে হলো, আরে আমার মেয়ে রিমঝিমের গল্পটাও তো বলতে পারি। ছোটবেলা থেকেই রিমঝিমের নানা সময়ের কথা নোট করে রেখেছি। সেখান থেকে কিছুটা নিয়ে আর বর্তমান গল্প দিয়ে এই লেখা। 

সবে টুকটুক করে হাঁটতে শিখেছে কিংবা হয়তো তারও একটু আগে। এ রকম সময়ে রিমঝিম যখন আমাদের শোবার ঘরে আসত, দেখত, আমি বসে আছি বা বিছানায় শুয়ে পত্রিকা পড়ছি। শিশুরা তো খু-উ-ব অনুকরণপ্রিয়। রিমঝিমও যথারীতি পত্রিকা টেনে নিয়ে বালিশে মাথা দিয়ে পত্রিকায় তাকিয়ে থাকত আর কী কী সব বলত। গল্পের বা কবিতার বই টেনে নিয়েও একই কাজ করত। কখনো–বা কোলে চড়ে বসে পত্রিকা বা বই বা ডায়েরিতে তর্জনী দেখিয়ে নির্দেশ করত নিঃশব্দে। বোল ফুটল যখন, তখন একইভাবে আঙুল ঠেকিয়ে বলত ‘এতা’। আমি ওর নির্দেশিত বাক্য পড়ে শোনাতাম। পছন্দ হলে বলত, ‘আবাল’। আমি আবার পড়তাম। এভাবে একটানা তিন থেকে চারবার পড়ে শোনাতে হতো আমাকে। কোনো একদিন আগ-পাছ না ভেবেই রিমঝিমকে কোলে নিয়ে বসলাম মোড়ায়। বিছানায় পত্রিকা রেখে তর্জনী নির্দেশ করে বললাম, ‘বাবু বলো প্র-থ-ম প্রথম, আ-লো আলো’। রিমঝিম বার কয়েক শুনল। তারপর থেকে প্রতিদিন ওর অঙ্গুলিনির্দেশ চলতে থাকল ‘প্রথম আলো’ শব্দটির ওপর। আমি বলি রিমঝিম শোনে, কখনো কখনো বলে। তত দিনে রিমঝিম বাবু ‘হাঁটাহাঁটি’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। 

কোনো কিছু জেনে-বুঝে যে আমি এটা করেছি, তা নয়। তবে তারপর থেকেই ছোট ছোট গল্প, ছড়া-কবিতা রিমঝিমকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে পড়ে শোনাতাম। ওর পছন্দ হলে বলত, ‘আবার’। বিপদে পড়তাম তখন, যখন বড় কোনো গল্প সে একাধিকবার শুনতে চাইত। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে (নালন্দা বিদ্যালয়ের) বাসায় বসে থাকায়, সকালটা ওর সঙ্গেই কেটে যেত। 

বিটিভির এক অনুষ্ঠানে ‘নদী’ কবিতা আবৃত্তি করতে হবে। আমি ঘুমাতে যাওয়ার আগে আর ঘুম থেকে উঠে মুখস্থ করতে চেষ্টা করছি ‘নদী’। রিমঝিম কখনো কোলে বসেছে, কখনো বিছানার বালিশে গা এলিয়ে দিয়েছে। বিটিভির কাজ শেষে গেলাম গাইবান্ধা আর টাঙ্গাইলে আবৃত্তির ক্লাস নিতে। চার দিন পর বাসায় ফিরলাম। রিমঝিম এত দিন পর আমাকে দেখে প্রথম ধাক্কা সামলেই বলে উঠল নদী কবিতার লাইন, ‘লাই সস্সের্ ক্ষে-ত সকালে উজল্ হলো, দু-পু-রে বিবর্ণো হয়ে গেল—তারি পাশে নদী। নদী, তুমি তোন তথা তও?’ এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা! 

‘নদী’ কবিতার চার ভাগের প্রায় তিন ভাগ ওর মুখস্থ হয়ে গেছে। এ রকম অনেক ঘটনা আছে। রিমঝিম এভাবেই একটু একটু করে বইয়ের দিকে ঝুঁকছে। কীভাবে যেন খুব দ্রুতই সে পাঠ করতে শিখে গেছে। প্রথম আলোর গোল্লাছুট পাতা দেখিয়ে বলতাম—এটা তো তোমার পাতা; তারপর পড়ে শোনাতাম। প্রতিদিন না হলেও প্রায়ই গল্প পড়ে শোনাতাম। 

পাঁচ বছর বয়সে রিমঝিম ভর্তি হয়েছিল তক্ষশীলা বিদ্যালয়ে। তখন থেকেই অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, যেকোনো বই দেখলেই পড়তে টেনে নিত। সাড়ে ছয় বছর বয়সে প্রথম উপন্যাস পড়ল রিমঝিম। ‘কিশোর আলো’তে ছাপা হওয়া আনিসুল হকের ‘ইটি, তুমি কেমন আছ।’ একবারে না, গল্পের মতো কয়েক পৃষ্ঠা ধরে। উপন্যাস পাঠ শেষ করে রিমঝিম বলল—কিছুই বুঝি নাই। অবশ্য এই বয়সে বোঝার কথাও না। রিমঝিম এখন পড়ছে ধানমন্ডির কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। এখন তার পড়ার ঝুলি বেশ চওড়া। প্রযুক্তির এই যুগে আমার মেয়ে এখনো গল্প–উপন্যাস পড়তে খুব ভালোবাসে। মাঝে বিভিন্ন সময় তার মুঠোফোনে খেলা দেখা আর ল্যাপটপে সিনেমা দেখার প্রবণতা বেড়ে যায়। তখন তুলনামূলকভাবে বই পড়ার অভ্যাস কমতে থাকে। তবে সেসব সামলে উঠেছি বই পড়ানোর দিকে আরও আগ্রহী করেই। 

লেখক: আবৃত্তিকর্মী