আমরা দিনে কতবার মুখে হাত দিই

প্রথম আলো প্রতীকী ছবি
প্রথম আলো প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ব্যক্তিগত একটি বিষয়কে সবার সামনে নিয়ে এসেছে। তা হলো মুখে হাত দেওয়ার অভ্যাস। কারণে-অকারণে বা মুদ্রাদোষে আমরা দিনে কতবার মুখে হাত দিই, হিসাব নেই। অথচ এই অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে পারলে করোনার মতো ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধে কার্যকর ফল পাওয়া সম্ভব।

কতবার মুখে হাত দিই
একজন মানুষ দিনে কতবার মুখে হাত দেয়, এর একটি জরিপ করেছে সিডনি ইউনিভার্সিটি। বিশ্ববিদ্যালয়টি ২৬ জন হবু চিকিৎসকের ওপর একটি ভিডিও জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, একজন মানুষ প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ২৩ বার তার মুখে হাত দেয়। এখানে মুখ বলতে ব্যক্তির ঠোঁট, জিহ্বা, নাক, কপাল, গাল, চোখ, থুতনি—এসব জায়গাকে বোঝানো হয়েছে। ২০১৫ সালে জরিপটি করা হয়েছিল।

কতবার মুখে হাত দিলে জীবাণু ছড়ায়
নোংরা হাত একবার মুখের সংস্পর্শে এলেই কেল্লাফতে। বারবার হাত ছোঁয়ানোর প্রয়োজন নেই। কারণ, আঙুলে অসংখ্য জীবাণু সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এতে শরীরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ার জন্য মাত্র একবারই নাক, চোখ বা মুখে আঙুলের স্পর্শ যথেষ্ট।

যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডন মুনি বেকার বলেন, ভাইরাস শ্বাসতন্ত্রে সরাসরি আঘাত করে। এতে শ্বাসতন্ত্রকে প্রভাবিত করে, এমন ভাইরাস শ্লেষ্মার মাধ্যমে (পিচ্ছিল নিঃসরণ বা মিউকাস) শরীরে প্রবেশ করে। এসব শ্লেষ্মা থাকে নাক–মুখের গহ্বর ও ঠোঁটে। ফলে অপরিষ্কার বা তুলনামূলক কম পরিচ্ছন্ন হাতই এ ধরনের সংক্রমণের জন্য যথেষ্ট।

মুখে হাত না দেওয়া কতটা সহজ
‘মুখে হাত না দেওয়া’ কথাটা বলা যত সহজ, মেনে চলা তত সহজ নয়। যেমন, গত শুক্রবারই ক্যালিফোর্নিয়ার একজন স্বাস্থ্য কর্মকর্তার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, ওই নারী এক প্রেস ব্রিফিংয়ে করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকতে জনগণকে আহ্বান জানাচ্ছেন। সেখানে তিনি বলছেন, মুখ, নাক বা চোখে হাতের স্পর্শ এ ভাইরাস শরীরে ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ। কিন্তু একটু পরই দেখা যায়, তিনি সংবাদ ব্রিফিংয়ের নথির পাতা ওল্টাতে ঠোঁটে হাত দিচ্ছেন।

এই তো গত সপ্তাহেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প করোনাভাইরাস–সচেতনতা প্রসঙ্গে ঘোষণা দেন যে তিনি কয়েক সপ্তাহ ধরে নিজের মুখ স্পর্শ থেকে বিরত রয়েছেন। তিনি নিজের মুখকে ভীষণ মিস করছেন। কিন্তু গত সোমবার তোলা তাঁর একটি ছবি গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ছবিতে দেখা যায়, তিনি বাঁ হাতের তর্জনী গালে ঠেকিয়ে বসে আছেন। মজার ব্যাপার হলো, ওই ছবি হোয়াইট হাউসের করোনাভাইরাস–সম্পর্কিত টাস্কফোর্সের বৈঠকে তোলা।

কারণ ছাড়া মুখে হাত দেওয়ার কারণ
খাওয়া, চুলকানো বা ময়লা পরিষ্কারের মতো প্রয়োজন ছাড়া মানুষ কেন মুখে হাত দেয়? এর একটা সহজ উত্তর হতে পারে বদভ্যাস বা মুদ্রাদোষ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত একটি গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা। ২০১৪ সালের ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, মুখে হাত দেওয়ার এই অভ্যাস ব্যক্তির মানসিক চাপ ও অস্বস্তি কমাতে সাহায্য করে।

ব্যক্তির এই আচরণ সাধারণত তার ছোটবেলা থেকে গড়ে ওঠা অভ্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত। গবেষণা বলছে, এর শুরু হয় মানসিক চাপ থেকে। আবার অনুকরণও একটি কারণ। বিশেষ করে শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা বয়োজ্যেষ্ঠ কাউকে দেখে দেখেও এ ধরনের আচরণে অভ্যস্ত হতে পারে। একাডেমিকভাবে বিষয়টিতে ‘এলটুএল বা লার্নিং টু লার্ন’ বলা হয়ে থাকে।

মুখ স্পর্শের নিরাপদ পদ্ধতি
সচেতনতাই পারে ব্যক্তিকে অকারণে মুখে হাত দেওয়ার অভ্যাস থেকে মুক্ত করতে। তবে একেবারে মুখে হাত না দিয়ে তো চলা সম্ভব নয়। এ জন্য চিকিৎসক ডন মুনি বেকার একটি টিপস দিয়েছেন। আর তা হলো টিস্যু বা রুমাল ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তোলা।

করোনাভাইরাসের মতো সংক্রমণ এড়াতে এই টিপস খুব কাজ দেবে। বিশেষ করে নাক স্পর্শের ক্ষেত্রে এটা বেশ কার্যকর। হাঁচি বা কাশির ক্ষেত্রে এই টিস্যু–অভ্যাস ব্যক্তি ও তাঁর কাছের মানুষকে সংক্রমণ এড়াতে সহায়তা করবে।

হাত পরিষ্কারের পদ্ধতি
সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড হাত ধুতে হবে। আর পানি না থাকলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। এই স্যানিটাইজারে অ্যালকোহলের পরিমাণ কমপক্ষে ৬০ শতাংশ থাকতে হবে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, হ্যান্ড স্যানিটাইজার জীবাণুমুক্ত করলেও ময়লামুক্ত করতে পারে না। এ জন্য হাত পরিষ্কারের ক্ষেত্রে সাবান-পানিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষ করে টয়লেট ব্যবহারের পর ও হাঁচি-কাশি হাতের স্পর্শে এলে।

হাতে জীবাণু আসার নানা গতি
টাকা, মুঠোফোন, চাবি, দরজার লকের মতো নানাবিধ জিনিস রয়েছে, যেখানে জীবাণুদের স্বর্গবাস। আর এসব স্থানে আমাদের হাত না দিয়ে উপায়ও নেই। এ ছাড়া কত জিনিসই প্রতিদিন আমাদের হাতের সংস্পর্শে আসে, যেগুলোয় থাকা জীবাণুর পরিমাণ আমাদের চিন্তারও বাইরে। এসব জিনিস থেকে শরীরে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া আর অ্যালার্জির সঞ্চালন হয়ে থাকে। এই সংক্রমণ এড়াতে তো আর মুখ বা ঘাড় কেটে ফেলা সম্ভব নয়। ফলে এ ধরনের সংক্রমণ এড়াতে ব্যক্তিগত সচেতনতার বিকল্প নেই।