করোনা নিয়ে ভুল তথ্য ঠেকাবেন যেভাবে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সারা বিশ্বে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। তার চেয়েও বেশি গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস নিয়ে নানা ভুল তথ্য। ইন্টারনেট অন করে ফেসবুক, মেসেঞ্জার, টুইটার বা হোয়াটসঅ্যাপ খুললেই পিং করে চলে আসছে করোনাভাইরাস নিয়ে ভিডিও বার্তাসহ নানা ধরনের বার্তা। যার বেশিরভাই আপনাকে বিভ্রান্তিতে ফেলছে। আতঙ্কিত করে তুলছে। এ সব বার্তার অধিকাংশই গুজব বা ভুয়া তথ্যে ভরা। তবে এই মুহূর্তে করোনাভাইরাস ঠেকানোর সরাসরি কোনো উপায় নেই। আইটি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাস নিয়ে ছড়ানো এ সব বার্তা ঠেকানোর পন্থা রয়েছে। আর সেটা আপনারা নিজেরাই পারেন।

২৭ মার্চ শুক্রবার বিবিসি অনলাইন এক প্রতিবেদনে করোনাভাইরাস নিয়ে এসব ভুল তথ্য, গুজব বা আতঙ্কিত হওয়ার মতো তথ্য ঠেকানোর কিছু উপায় বাতলে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকেই কিছু উপায় এই প্রতিবেদনে প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

১. অপেক্ষা করুন, ভাবুন

পরিবার বা বন্ধু-স্বজনদের সুরক্ষিত রাখতে আপনি যেকোনো তথ্য দ্রুত তাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। ইমেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক বা টুইটারে যখনই স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বা করোনাভাইরাস নিয়ে কোনো পরামর্শমূলক বার্তা পান ঠিক তখনই তা পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের একইভাবে দ্রুত ফরোয়ার্ড করে দেন।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, না, এত দ্রুত কোনো বার্তা কাউকেই ফরোয়ার্ড করবেন না। কারণ বার্তাটি গুজব হতে পারে বা সেটা মিথ্যা তথ্য-পরামর্শ হতে পারে। তা পাঠালে হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই বার্তা পেলেই পাঠাবেন না। একটু থামুন। বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবুন। সন্দেহ হলে তা কোনোভাবে যাচাই করার চেষ্টা করুন। সত্য হলে ফরোয়ার্ড করুন। আর তা না হলে, আটকে রাখুন, কাউকেই পাঠাবেন না। এতে আপনার পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের কাছে ভুল বার্তাটি আর গেল না।

২. সোর্স যাচাই করুন

যখন কেউ আপনাকে এ ধরণের কোনো বার্তা পাঠাবে, সেই বার্তা হুট করে কাউকে ফরোয়ার্ড করবেন না। আগে সেই সোর্সকে কিছু প্রশ্ন করুন। জানতে চান, তিনি এই তথ্য কোথায় এবং কীভাবে পেয়েছেন। যদি তিনি বলেন, এই বার্তা তিনি তাঁর বন্ধুর বন্ধু বা চাচীর সহকর্মীর প্রতিবেশির মাধ্যমে পেয়েছেন-তাহলে বার্তাটির বিষয়ে সোজা সন্দেহ করুন। কারণ সোর্স নিশ্চয়ই এই বার্তা জানানোর জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ নয়।

এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ফ্যাক্ট-চেকিং অর্গানাইজেশন ফুল ফ্যাক্টের ডেপুটি এডিটর ক্লেয়ার মিলনে বলেন, গণস্বাস্থ্য নিয়ে যেকোনো তথ্যের জন্য নির্ভরযোগ্য সূত্র হলো এনএইচএস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা আমেরিকার সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন। এদের পাঠানো যেকোনো তথ্যের ওপর নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যায়। অন্তত হোয়াটসঅ্যাপে কোনো অপরচিতি ব্যক্তির পাঠানো বার্তার চেয়ে তো বটেই।

৩. মিথ্যা বা প্রতারণা হতে পারে

মনে রাখবেন, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যে কেউ কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান বা নির্ভরযোগ্য সংস্থার অ্যাকাউন্ট ক্লোন করতে পারে। এই ক্লোন করা অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো বার্তা পেলে প্রাথমিকভাবেই ভাববেন যে এটা তো নির্ভরযোগ্য তথ্য। কিন্তু না, এই সব ক্লোন অ্যাকাউন্টের উদ্দেশ্য থাকে অন্যদের বিভ্রান্তিতে রাখা এবং মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতারণা করা। তাই কোনো প্রতিষ্ঠানের সঠিক অ্যাকাউন্ট ও ওয়েবসাইট সম্পর্কে ধারণা থাকা জরুরি। সেখানে গিয়ে আগে তথ্যটি যাচাই করতে হবে। যদি আপনার কাছে পাঠানো বার্তার বিষয়ে মূল ওয়েবসাইটে গিয়ে সহজে ওই তথ্যের যথার্থতা খুঁজে না পান তাহলে ভাবতে হবে আপনার কাছে আসা বার্তাটি একটি হোক্স বা ধাপ্পাবাজি।

এ ব্যাপারে ফুল ফ্যাক্টের ডেপুটি এডিটর ক্লেয়ার মিলনে বলছেন, এ ধরনের অ্যাকাউন্ট থেকে পাঠানো বার্তায় ক্যাপিটাল লেটার ও ফন্টের মিল না থাকলে ফ্যাক্ট-চেকার ওই বার্তাটিকে ভুয়া বার্তা বা প্রতারণামূলক বাতা হিসেবে শনাক্ত করার নিশানা মনে করে।

৪. সত্যতা না পেলে শেয়ার নয়

কারও পাঠানো বার্তার যদি সত্যতা যাচাই করতে না পারেন বা বার্তাটি সম্পর্কে নিশ্চিত না হতে পারেন, তাহলে কখনোই ওই বার্তা কারও কাছে ফরোয়ার্ড বা শেয়ার করবেন না। কারণ আপনি হয়তো ভালোর জন্য পাঠালেন। কিন্তু হয়ে গেল উল্টোট। যাকে পাঠালেন তাঁর হয়তো অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো বার্তা পেলে শুরুতেই তথ্য সম্পর্কে সন্দেহ করুন। যাচাই করার চেষ্টা করুন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে সত্যতা পেলে অন্যের কাছে শেয়ার করুন। আর সত্যতা না পেলে খবরদার! ভুল করেও এমন বার্তা আপনজন তো নয়ই দূরের কাউকেও পাঠাবেন না।

৫. প্রতিটি বিষয় যাচাই করুন

সম্প্রতি বিবিসির কাছে একটি ভয়েস নোট আসে। এই ভয়েস নোটটি হোয়াটসঅ্যাপে ভাইরাল হয়ে যায়। ওই ভয়েস নোটে একজন ব্যক্তি কিছু উপদেশ পরামর্শ অনুবাদ করে ভয়েস রেকর্ড করেছেন। এই তথ্য তিনি পেয়েছেন তাঁর সহকর্মীর এক বন্ধুর মাধ্যমে। সেই বন্ধু নাকি কোনো এক হাসপাতালে কাজ করেন। ভয়েস রেকর্ডটিকে সঠিক পরামর্শের পাশাপাশি ভুল পরামর্শও রয়েছে। বড় একটি বার্তায় অনেক সঠিক পরামর্শের সঙ্গে একটি ভুল পরামর্শই সমূহ বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই এমন পাওয়া বার্তা যদি কাউকে পাঠাতেই চান তাহলে অবশ্যই বার্তাটির প্রতিটি বিষয় আলাদা আলাদা ভাবে সত্য নাকি মিথ্যা তা যাচাই করে নিতেই হবে।

৬. আবেগমূলক পোস্টে সাবধান

আবেগমূলক পোস্ট যেমন আতঙ্ক, রাগ, উদ্বিগ্ন বা অতি আনন্দের যেকোনো পোস্ট সহজেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। তাই এ ধরনের পোস্টের ব্যাপারে খুব সাবধান থাকতে হবে।

অনলাইনে ভুল তথ্য দিয়ে সাংবাদিকদের বিভ্রান্ত করা থেকে ঠেকানোর সংগঠন ফার্স্ট ড্রাফটের কর্মকর্তা ক্লেয়ার ওয়ার্ডল এ ব্যাপারে বলেন, ভয় বা আতঙ্কিত হওয়ার মতো যেকোনো পোস্ট সহজেই ভুল বার্তা ছড়ানোর একটা বড় মাধ্যম। তাই এ ধরনের বার্তা কাউকে পাঠানোর ব্যাপারে খুব সাবধানী হতে হবে।

ক্লেয়ার ওয়ার্ডল বলছেন, মানুষ তার আপনজনদের সব সময় নিরাপদে রাখতে চায়। এ কারণে ‘ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায়’ বা ‘উপকারী স্বাস্থ্য তথ্য’ এই ধরনের বার্তা পেলে মুহূর্তেই তা আপনজনদের কাছে শেয়ার করে দেয়। কিন্তু না, এমনটা কখনোই করা যাবে না। শেয়ার করার আগে অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।

৭. পক্ষপাতমূলক তথ্য কিনা ভাবুন

যেকোনো তথ্যমূলক বার্তা পেলে আপনি মনে করছেন যে এসব তথ্য সঠিক বা আপনি এই তথ্যের সঙ্গে একমত? না, শুরুতেই এমন ভাবনা ভাবা যাবে না। তথ্যটি পক্ষপাতমূলক কিনা সেটাও কিন্তু আপনাকেই ভাবতে হবে, যদি আপনি আপনার আপনজনদের সুরক্ষিত রাখতে চান।

এ বিষয়ে সেন্টার ফর দ্য অ্যানালাইসিস অব সোস্যাল মিডিয়া অ্যাট থিঙ্ক ট্যাংক ডেমোসের রিসার্চ ডিরেক্টর কার্ল মিলার মনে করেন, মূলত আমরা নিজেরা যা বিশ্বাস করি বা যে তথ্যের সঙ্গে একমত হই, দ্রুত সেসব বার্তা বা তথ্য অন্যের কাছে শেয়ার দিই। এটা এক ধরনের পক্ষপাত। নিজে যার সঙ্গে একমত অন্যরা তার সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন। নিজে যা বিশ্বাস করেন, অন্যকে পাঠালেন তা অন্যের চরম ক্ষতির কারণও হতে পারে-এটা সবার আগে ভাবতে হবে। তাই অনলাইনে যেকোনো বিষয় শেয়ার করার আগে সময় নিতে হবে, ভাবতে হবে ও সত্যতা যাচাই করতে হবে।