করোনা মোকাবিলায় ফ্যাশন দুনিয়া

বেইজিং সংক্রমণের সময়। ছবি: রয়টার্স
বেইজিং সংক্রমণের সময়। ছবি: রয়টার্স

বলা হয়ে থাকে, ছায়ায় সঙ্গে যুদ্ধ করা যায় না। কিন্তু করোনাভাইরাসের বাস্তবতায় সেটাও বুঝি এখন সম্ভব। চোখে দেখা যায় না, এমন এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু অবলীলায় বিশ্ব কাঁপিয়ে চলেছে মানুষকে উপহাসের পাত্র করে। গোটা বিশ্বকে আতঙ্কের সুতোয় বেঁধেছে। নড়িয়ে দিয়েছে অর্থনীতির ভিত। প্রকৃতির এই জিঘাংসা থেকে রেহাই মেলেনি মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম বস্ত্র ভুবনেরও। বৈশ্বিক ফ্যাশন পরিমণ্ডল পার করছে অভূতপূর্ব ক্রান্তিকাল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফ্যাশন খাত। দুই মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। ফ্যাশনের দুনিয়া কীভাবে মোকাবিলা করছে এই পরিস্থিতি?

বৈশ্বিক ফ্যাশন শিল্পের বার্ষিক আয় ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন (১ লাখ ৫০ হাজার কোটি) ডলার। এই খাত থেকে কেবল যুক্তরাজ্যের বার্ষিক রাজস্ব আয় হয় ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। বিনিয়োগ ব্যাংক জেফারিজের মতে, এই বাজারের ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে চৈনিক ক্রেতারা। গত এক দশকে উচ্চবিত্তের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাদের ক্রয়ক্ষমতা। ফলে ২০০৩ সালে যেখানে তাদের কেনাকাটার পরিমাণ ছিল ৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ শতাংশে। গত বছর কেবল চীনেই বিক্রি হয়েছে ১০৪ বিলিয়ন (১০ হাজার ৪০০ কোটি) ডলারের পণ্য। আন্তর্জাতিক বিলাসী (লাক্সারি) ফ্যাশন পণ্যের বাজারের আয় গত বছর ছিল ৩১৭ বিলিয়ন (৩১ হাজার ৭০০ কোটি) ডলার। এর মধ্যে ৪০ শতাংশই আসে চৈনিক ক্রেতাদের পকেট থেকে।

এমনকি ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত নিউইয়র্ক, লন্ডন, মিলান আর প্যারিস ফ্যাশন উইক চলাকালে চৈনিক ফ্যাশন অনুরাগীরা হাজির থাকেন কেনাকাটার জন্য। কিন্তু সেই ছবিটা এবার ছিল একেবারেই বিপরীত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মাত্রা ছাড়ানোয় তারা গৃহবন্দী হয়ে পড়ে। ফলে ইউরোপের মহামূল্যবান পণ্যের বাজারে ব্র্যান্ডগুলোর মাছি তাড়ানো ছাড়া গত্যন্তর ছিল না।

চাঞ্চল্য ফিরেছে বেইজিং শপিং ডিস্ট্রিক্টে। ছবি: রয়টার্স
চাঞ্চল্য ফিরেছে বেইজিং শপিং ডিস্ট্রিক্টে। ছবি: রয়টার্স


ব্র্যান্ডগুলোর মাথায় হাত
সংগত কারণেই বিশ্বের শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলোর এখন মাথায় হাত। কারণ, গত এক দশকে তারা নানাভাবে চীনের মুখাপেক্ষী হয়েছে। কেবল পণ্য সেখান থেকে বানিয়ে নেওয়া নয়, বরং চীনের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির উন্নতির কারণে সেখানে তাদের শাখাও ছড়িয়েছে। কেবল চীন নয়, দক্ষিণ আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্ভাবনাময় বাজার তাদের চারণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। মুনাফাও লুটেছে যথেষ্ট পরিমাণে। কিন্তু এক করোনাভাইরাস তাদের ভয়াল দুঃস্বপ্নের কারণ হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে সংক্রমণ শুরুর পর থেকে শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলো তাদের শাখা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। বারবেরি এক-তৃতীয়াংশ শাখা বন্ধ করে দিয়েছে। মাইকেল করস, জিমি চু আর ভারসাচি—এই তিন ব্র্যান্ডের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান ক্যাপ্রি চীনে তাদের ২২৫টির মধ্যে ১৫০টি শাখা বন্ধ করে দেওয়ায় বছরের প্রথম তিন মাসে বিক্রি কমেছে ১০ কোটি ডলার। ট্যাপেস্ট্রির রয়েছে তিনটি ব্র্যান্ড: কোচ, কেট স্পেড আর স্টুয়ার্ট উইটজমান। তাদের বিক্রি হ্রাস পেয়েছে ২৫ কোটি ডলার। গ্যাপের ক্ষতির পরিমাণ ১০ কোটি আর অ্যাডিডাসের লোকসান ১০০ কোটি ডলার। এই সংকটে অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাইও করছে। একইভাবে এইচঅ্যান্ডএম পৃথিবীজুড়ে তাদের ৫ হাজার ৬২টি দোকানের মধ্যে ৩ হাজার ৪৪১টি বন্ধ করে দেওয়ায় তার ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে প্রতিষ্ঠানের আয়ে। ফলে কর্মী ছাঁটাইয়ে যেতে হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সর্বশেষ তথ্যে প্রকাশ, চলতি বছর প্রথম তিন মাসে বিলাসী পণ্যের বিক্রি কমেছে অন্তত ১ হাজার ৮০ কোটি ডলার। এ বছর বিক্রি আরও অন্তত ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি ডলার বা তার বেশি কমতে পারে। ফলে এই খাতের মূল্য (ভ্যালু) কমবে সাড়ে ৩৩ হাজার ডলার।

বেইজিং শপিং ডিস্ট্রিক্ট। ছবি: রয়টার্স
বেইজিং শপিং ডিস্ট্রিক্ট। ছবি: রয়টার্স


বাতিলের তালিকা লম্বা হচ্ছে ক্রমেই
এ মাসের সাংহাই আর বেইজিং ফ্যাশন উইক বাতিল করা হয়েছে। অন্যদিকে, প্যারিস ফ্যাশন উইকে অংশ নেয়নি চীনের শীর্ষ ব্র্যান্ড মাশা মা, শিয়াটজি চেন, উমা ওয়াং, কেলভিন লুও ও মেইসন মাই। মাত্র ২৪ ঘণ্টার নোটিশে আমন্ত্রণ বাতিল করেন জর্জিও আরমানি। পরিবর্তে তিনি ইতালির মিলানে শো করেন শূন্য হলে। এমনকি প্যারিসেও তিনি যাননি।

বেইজিং শপিং ডিস্ট্রিক্ট। ছবি: রয়টার্স
বেইজিং শপিং ডিস্ট্রিক্ট। ছবি: রয়টার্স

১৯ এপ্রিল থেকে ২৫ মে সংযুক্ত আরব-আমিরাতের দুবাইতে অনুষ্ঠেয় ‘ক্রুজ শো’ বাতিল হয়েছে। মে মাসের ‘রিসোর্ট শো’ বাতিল করেছে প্রাদা। বাতিল হয়েছে মস্কো, সিউল আর টোকিওর শো। তবে টোকিও এবার সেই ফ্যাশন শো করেছে বদ্ধ মিলনায়তনে। আর তা ওয়েবে সরাসরি (লাইভ স্ট্রিমিং) প্রচার করেছে। হবে না এবার মেটগালাও। এর বাইরেও ভারসাচি, শ্যানেল, হারমিস, বারবেরিসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ড তাদের নির্ধারিত বার্ষিক শো না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এরই মধ্যে বাতিল হয়েছে বাণিজ্য প্রদর্শনী বা ট্রেড শো। এমনকি এপ্রিলে ঢাকায় অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ ডেনিম এক্সপোও হচ্ছে না।

নীরব বার্লিন। ছবি: রয়টার্স
নীরব বার্লিন। ছবি: রয়টার্স


চীন ও ইতালির বস্ত্র উৎপাদন
চীনের বস্ত্র খাতের আয় বছরে ২৮ হাজার কোটি ডলার। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে তা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একইভাবে ইতালির লোম্বারদি বিখ্যাত তুলা উৎপাদনের জন্য। কিন্তু এই পরিস্থিতি সেখানেও থাবা বসিয়েছে। ইতালির ১০ হাজার কোটি ডলারের ফ্যাশন শিল্পের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়েছে এই সংক্রমণ। নিদারুণ সংকটের মধ্যে পড়েছে ইতালির একাধিক ব্র্যান্ড, যারা সে দেশেই তাদের পণ্য তৈরি করে থাকে। এই তালিকায় ওপরের দিকে থাকা দুটি ব্র্যান্ড হারমিস ৪২টি আর গুচি ৬টি উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। এর প্রভাব সামনের দিনগুলোতে আরও প্রকট হবে।

ঝাঁপ বন্ধ লন্ডনের মধ্যবিত্তের শপিং মল প্রাইমার্ক। ছবি: রয়টার্স
ঝাঁপ বন্ধ লন্ডনের মধ্যবিত্তের শপিং মল প্রাইমার্ক। ছবি: রয়টার্স


ওদের কথা শোনাই
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় পোশাক আর সৌন্দর্য পণ্যের বিশ্বের শীর্ষ ব্র্যান্ডগুলো এগিয়ে এসেছে। নিয়েছে নানা ধরনের উদ্যোগ। লুই ভুতোর মতো হেনেসি (এলভিএমএইচ) আর ল’রিয়েল তাদের সুগন্ধি বিভাগ থেকে শুরু করেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি। এলভিএমএইচ আবার এগুলো বিনা মূল্যে বিতরণ করছে ফ্রান্সের হাসপাতালগুলোতে। চীন থেকে তারা ৪ কোটি মাস্ক আনিয়েছে ফ্রান্সে বিতরণের জন্য।

নিস্তব্ধ মাদ্রিদ। ছবি: রয়টার্স
নিস্তব্ধ মাদ্রিদ। ছবি: রয়টার্স

নাইকি এরই মধ্যে তাদের কর্মীদের জন্য দান করেছে দেড় কোটি ডলার। স্পেনের রোগী আর চিকিৎসাকর্মীদের জন্য মাস্ক দিয়েছে ইন্ডিটেক্স। টেকসই ফ্যাশন ব্র্যান্ড এভারলন তাদের লাভের পুরোটাই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের করোনা মোকাবিলা তহবিলে। অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তহবিলে মুনাফার ২০ শতাংশ দিয়েছে কেনেথ কোল।

মাস্ক তৈরি হচ্ছে মেক্সিকোতে। ছবি: রয়টার্স
মাস্ক তৈরি হচ্ছে মেক্সিকোতে। ছবি: রয়টার্স

এখানেই শেষ নয়, এলভিএমএইচ ২২ লাখ ডলার দিয়েছে চীনের রেডক্রস সোসাইটিকে। এই প্রতিষ্ঠান আরও ১০ লাখ ডলার পেয়েছে গুচি, ওয়াইএসএল আর আলেকজান্ডার ম্যাককুইনের মতো ব্র্যান্ডের মূল প্রতিষ্ঠান কেরিংয়ের কাছ থেকে। কার্তিয়ের, ভ্যান ক্লিফ, ক্লোয়ির মতো ব্র্যান্ডের কনগ্লোমারেট রিচমন্ট ১৪ লাখ ডলার দান করেছে করোনা মোকাবিলা তহবিলে। অন্যদিকে ফ্যাশন ডিজাইনার জর্জিও আরমানি সমপরিমাণ অর্থসহায়তা দিয়েছেন ইতালির বিভিন্ন হাসপাতালকে। চীনের একটি ফাউন্ডেশনকে ৭ লাখ ডলার দিয়েছে হারমিস। ভারসাচির সাবেক স্বত্বাধিকারী দোনাতেল্লা ভারসাচি ২ লাখ ইউরো দান করেছে ইতালির রাফায়েল হাসপাতালকে। প্রায় দেড় লাখ ডলার দিয়েছে চীনের রেডক্রস সোসাইটিকে। মিউসিয়া প্রাদা আর তাঁর সহকর্মীরা রোমের একটি হাসপাতালকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। পক্ষান্তরে, বিখ্যাত ডিজাইনার জুটি ডলচে ও গ্যাবানা করোনা গবেষণার জন্য অনুদান দিয়েছে হিউমানিটাস ইউনিভার্সিটিকে।

এভাবেই বন্ধ রয়েছে নিউইয়র্কের ম্যাকিজ। ছবি: রয়টার্স
এভাবেই বন্ধ রয়েছে নিউইয়র্কের ম্যাকিজ। ছবি: রয়টার্স


অকুস্থল বাংলাদেশ
এ বছর বৈশাখ আর ঈদ পিঠাপিঠি। তাই মার্চের প্রথম সপ্তাহেই বৈশাখ সংগ্রহ সাজানো হয়ে যায় বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসের দোকানগুলোয়। বিক্রিও শুরু হয়েছিল। কিন্তু বিধি বাম। বাংলাদেশের আবহাওয়া উষ্ণ, তাই করোনা কিছু করতে না পারা পূর্বাভাস ধোপে টেকেনি। ৮ মার্চ ঢাকায় প্রথম আক্রান্ত শনাক্তের পর থেকেই মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দানা বাঁধতে শুরু করে। সেই প্রভাব পড়ে বিক্রিতে। ভাটার টান লক্ষ করা যায় এ মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার থেকে। তৃতীয় শুক্রবারে এসে বিক্রি নেমে আসে একই সময়ে অন্য বছরের তুলনায় অর্ধেকের কমে। ২৫ মার্চ থেকে বিপণিবিতান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তাদের মাথায় হাত দিয়ে বসে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বিপুল বাজার একেবারে মাঠে মারা গেছে; যা কাটিয়ে ওঠা রীতিমতো দুষ্কর। কারণ, ২৩ এপ্রিল থেকে রোজা শুরু হলে সমান্তরালেই শুরু হওয়ার কথা ঈদবাজার। কিন্তু পরিস্থিতি তত দিনে কতটা শান্ত হয়, তা এখনই অনুমান করা যাচ্ছে না। বরং মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত সময়কে সংকটকাল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এবারের বৈশাখ তাই লাল-সাদা নয়, কালো বৈশাখ হিসেবেই ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে।

অক্সফোর্ড সার্কাসের এই দৃশ্য বিরল। ছবি: রয়টার্স
অক্সফোর্ড সার্কাসের এই দৃশ্য বিরল। ছবি: রয়টার্স


শেষ কথা
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে অনলাইনে বিক্রি বেড়েছে ৮১ শতাংশ। তবে পৃথিবীর অন্য সব দেশ যখন করোনার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে, চীন তখন উতরে গেছে সংকট। অন্যরাও সামলে উঠবে পরিস্থিতি—দুই দিন আগে বা পরে। বাংলাদেশের জন্য অভিন্ন প্রত্যাশা আমাদের; কিন্তু ক্ষতি যা হলো, তা কাটিয়ে ওঠা কত দ্রুত সম্ভব হবে, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

প্যারিসে বন্ধ দিওর শপ। ছবি: রয়টার্স
প্যারিসে বন্ধ দিওর শপ। ছবি: রয়টার্স
বার্লিনের কাছে শুলজেনডর্ফের একটি সুপার মার্কেটে ঢোকার জন্য দীর্ঘ লাইন। ছবি: রয়টার্স
বার্লিনের কাছে শুলজেনডর্ফের একটি সুপার মার্কেটে ঢোকার জন্য দীর্ঘ লাইন। ছবি: রয়টার্স
সিডনিতে বন্ধ শপিং মল। ছবি: রয়টার্স
সিডনিতে বন্ধ শপিং মল। ছবি: রয়টার্স
জীবাণুনাশ ছিটানো হচ্ছে ডুওমো স্কয়ারে। ছবি: রয়টার্স
জীবাণুনাশ ছিটানো হচ্ছে ডুওমো স্কয়ারে। ছবি: রয়টার্স