চলুন শুনি ভর্তার বার্তা

ছবি : নকশা
ছবি : নকশা

ভর্তাকে একবার গরিবের খাবার বলে দেখুন তো, কিল একটাও মাটিতে পড়বে না।

যখন ছোট ছিলাম, তখন চোখের খিদে ছিল বেশি। চোখ চকচক করত পোলাও–মাংসের দিকে তাকিয়ে। বাজার থেকে বড় মাছ আনা হলে ভিড় হয়ে যেত বঁটির সামনে। যিনি ছাই দিয়ে মাছটি কাটবেন, তাঁর চোখেমুখে বেশ একটা গর্বের ভাব ফুটে উঠত।

এই মাছ–মাংসের রমরমার মধ্যে ভর্তার কোনো দাম ছিল কি? আমার মতো খাদ্য বিষয়ে তখন পর্যন্ত অজ্ঞ অনেকের কাছে ছিল না।

প্রচলিত ছিল, ভর্তা গরিবের খাবার। কথাটা খুব একটা মিথ্যে নয়। ডলে, পিষে, দলাই-মলাই করে তৈরি হচ্ছে যে খাবার, ভাতের সঙ্গে মিশে তা যে অমৃতের স্বাদ দেবে, সে কথা শৈশবে জানতামই না।

যেদিন আলুভর্তা, ডিম ভাজি আর ডাল হতো বাড়িতে, বুঝতাম বাড়ির খাজাঞ্চিখানার ট্যাকে টান পড়েছে। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করতাম, আলুভর্তা আর ডাল একসঙ্গে মাখিয়ে একটু একটু ডিম ভাজি দিয়ে খেতে খারাপ লাগছে না। অভাবের ফুটো দিয়েই আমাদের বাড়িতে ভর্তার আবির্ভাব হয়েছিল কি না, সে এখন বলতে পারব না। কিন্তু আলুভর্তা, বেগুনভর্তা, আর কলা–ডিমভর্তা যে আমাদের রসনাকে একটু একটু করে পরিবর্তন করছিল, সে কথা বলতে পারি।

এরপর এল কিছু অভিজাত ভর্তা। একটা হলো শুঁটকি, আরেকটা টাকি মাছের ভর্তা। শুঁটকিভর্তা নিয়ে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে ফেলা যাবে। শুনেছি মাছের প্রাচুর্যে বাংলা সব সময়ই ঋদ্ধ ছিল। এত মাছ একবারে খেয়ে ওঠা যেত না। সে মাছের কিছু অংশ শুঁটকি করা হতো। শুঁটকি দিয়ে সে আমলের আধা সের চালের ভাত খেতে পারতেন, এমন অনেক মানুষই ছিলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য, গরিব বাঙালির ক্যালরির একটা বড় অংশই আসত চাল থেকে। ভাত সেই আমল থেকেই বাঙালির অতি প্রিয় খাবার।

আমি ভুল বলছি কি না জানি না, পৃথিবীর আর কোনো ভাষায় দুপুর বা রাতের খাবার কেউ খেয়েছে কি না জানতে হলে সরাসরি কি এই প্রশ্ন করা হয়, ভাত খেয়েছ?

ভাত খাওয়া মানে যে ভাতের সঙ্গে আনুষঙ্গিক কিছু, প্রশ্নে সেটা থাকে না। উত্তরেও থাকে না। এ ক্ষেত্রে উত্তর হয়, খেয়েছি বা ভাত খেয়েছি।

অন্য অনেক ভাষায় প্রশ্ন করা হয়, ‘দুপুরের খাবার খেয়েছ?’, ‘রাতের খাবার খেয়েছ?’ ইত্যাদি। বাঙালি তাই, শুধু ‘ভাত খেয়েছি’ বলে সঙ্গে খাওয়া ভর্তা, সবজি, তরকারি, মাছ বা মাংসকে ওই একটি শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে রাখে।

তারুণ্যে যখন টিএসসি থেকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম পুরান ঢাকায়, তখন আকর্ষণের একটা জায়গা ছিল নীরব হোটেল। কত ধরনের ভর্তার সমাহার যে ছিল সেখানে, তা বলে শেষ করা যাবে না। এখনো তারা তাদের সেই ঐতিহ্য বজায় রেখেছে। ইদানীং যদি কখনো বাইরে রেস্তোরাঁয় খাওয়া হয়, লক্ষ করে দেখেছি, মেনুতে ভর্তার আধিক্য রয়েছে। কোনো কোনো রেস্তোরাঁয় অন্য কিছু চাওয়ার আগেই ভাতের সঙ্গে কয়েক ধরনের ভর্তা চলে আসে। সে–ও বড় বিচিত্র ভর্তা।

পয়লা বৈশাখের খাবার হিসেবে ভাত আর ভর্তার প্রচলন সেই আদি যুগ থেকেই। হঠাৎ করে কয়েক দশক হলো পান্তা-ইলিশ এসে আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। বৈশাখ ইলিশ খাওয়ার উপযুক্ত সময় কি না, সে সময় ইলিশ দিয়েই উদ্‌যাপন করতে হবে কি না, সেসব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে আমরা বলতে পারি, নববর্ষে ভর্তা-ভাত বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার। এখনো গ্রামাঞ্চলে সে খাবারের ঐতিহ্য মরে যায়নি। কালিজিরার ভর্তা অনেকের বাড়িতেই প্রাত্যহিক খাবারে পরিণত হয়েছে।

একটা সত্য গল্প বলে লেখাটা শেষ করি। সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াকালে বন্ধু শাম্মী বলেছিল, তার মা খুব ভালো খোসাভর্তা করতে পারেন।

খোসাভর্তা! শুনে খুবই অবাক হয়েছিলাম। শাম্মী বলেছিল, খোসাভর্তার মতো উপাদেয় খাবার সে জীবনে খায়নি। দেশে গেলে খাওয়াবে। শাম্মীরা থাকত খুলনায়। একবার পড়ার মধ্যে দেশে বেড়াতে এসে খুলনায় গিয়েছিলাম। শাম্মী সেবার দেশে আসেনি। কিন্তু আমার খুলনায় যাওয়ার কথা শুনে ও খালাম্মাকে বলে রেখেছিল যেন আমার জন্য খোসাভর্তা করেন।

খালাম্মা খুব আদর করে বসালেন। শুরুতেই বললেন, খুলনার বিখ্যাত পারশে মাছ, আইড় মাছ আর মুরগির মাংস আছে। ডাল আছে। তাই শুধু খোসা দিয়ে পেট ভরালে চলবে না।

আমি তো খেতে বসলাম। তিনি বলে যেতে লাগলেন, এটা আলুর খোসা, এটা পটোলের খোসা, এটা কুমড়ার খোসা, এটা লাউয়ের খোসা—এভাবে মোট সাত ধরনের খোসাভর্তা দেখিয়ে দিলেন আমাকে।

খাওয়া শুরু করলাম আর বুঝলাম, অমৃত কাকে বলে। বহু বলা সত্ত্বেও সেদিন খোসাভর্তা আর ডাল ছাড়া কিছুই খাইনি। মাছ-মাংসেরা আমার দিকে হয়তোবা বিরস নয়নে তাকিয়ে ছিল, কিন্তু ভর্তা–ভাত খেতে যে এত ভালো লাগতে পারে, সে কথা সেদিনই বুঝেছিলাম প্রথম।

তাই গরিবের খাদ্য বলে ভর্তাকে বাঙালি কোনোদিন পাত থেকে সরিয়ে রাখতে পারবে বলে আমি মনে করি না। এমনকি এখন দাওয়াতের কথা কেউ বললে স্রেফ বলে দিই, ‘পোলাও–টোলাও খেতে পারব না বাবা! সাদা ভাত, ভর্তা, ডাল করতে পারবে তো?’