বৈশাখ এল দুঃসময়ে

আজ নববর্ষে মাটির বাসনকোসনে দেশি খাবার পরিবেশন করা যেতে পারে বাড়িতেই।  এক বৈশাখে নকশার জন্য বাঙালিয়ানায় এভাবে খাবার টেবিল সাজিয়েছিলেন নৃত্যশিল্পী সামিনা হোসেন প্রেমা। ছবি: নকশা
আজ নববর্ষে মাটির বাসনকোসনে দেশি খাবার পরিবেশন করা যেতে পারে বাড়িতেই। এক বৈশাখে নকশার জন্য বাঙালিয়ানায় এভাবে খাবার টেবিল সাজিয়েছিলেন নৃত্যশিল্পী সামিনা হোসেন প্রেমা। ছবি: নকশা

বৈশাখ এলেই কালবৈশাখীর কথা মনে হয়। তবে এ বছর বৈশাখ আসার অনেক আগেই করোনা নামের ভাইরাস-ঝড় সারা বিশ্বকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। তবু বৈশাখ এসেছে, হয়তো মুমূর্ষকে জাগিয়ে তুলতেই এসেছে। জীবনের আবর্জনা দূর করতেই এসেছে।

প্রতিবছর বাংলা নববর্ষ এলে কথায় বা লেখায় আমরা ‘শুভ’ শব্দটি যোগ করি। আজ কেন যেন পারছি না। মন থেকে চাইছি সবার জীবন শুভ হোক, কিন্তু মনে জোর পাচ্ছি না।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সময়ের বড় অভাব। জীবনযাপনের নকশায় বড় ব্যস্ত সবাই। আপনজনদের সঙ্গে সময়ই মেলে না। স্বামীর অফিস, নয়তো স্ত্রীর বিদেশে সেমিনার। ছেলের ফাইনাল পরীক্ষা, নয়তো মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তোড়জোড়। বাবার হার্ট অপারেশন, নয়তো মায়ের চোখ অপারেশন...চলছেই। এখন পরিবারের সদস্যরা বাধ্য হয়ে একসঙ্গে ঘরে সবাই, কিন্তু মনে যে অশা‌ন্তি। এই মিলন তাই সম্মিলন হয় না।

অন্দরে বৈশাখী আমেজ। ছবি: নকশা
অন্দরে বৈশাখী আমেজ। ছবি: নকশা

আজ পয়লা বৈশাখ। সড়কে সড়কে, প্রান্তরে প্রান্তরে রঙিন এই উৎসব বড় বিবর্ণ আজ। খরতাপেও ঘামতে ঘামতে যাঁরা পরিবারের সঙ্গে বৈশাখ উদ্‌যাপনে বেরিয়ে পড়তেন, তাঁরা সবাই গৃহবন্দী। থাকুন, নিয়ম মেনে ঘরেই থাকুন। আজ যদি ঘরে থাকি, তাহলে ভবিষ্যতে আবার দল বেঁধে গাইতে পারব—মেলায় যাই রে...।

বৈশাখ এবার হোক ঘরেই। মনের জোর বৃদ্ধি করাই হোক বৈশাখ উদ্‌যাপনের প্রথম ধাপ। সচেতনতা আর সতর্কতায় আতঙ্ক–উদ্বেগ হোক পরাস্ত। ঘরে যা আছে, তা–ই দিয়ে করি চলুন আয়োজন। বাঙালির আয়োজনে ঘটা আছে সত্য, তাই বলে ঘনঘটায় মুছে যাবে সব?

আমাদের এক সাবেক সহকর্মী বিয়ে করেও মেস জীবনযাপন করতেন কিছুকাল—বিয়ের আনুষ্ঠানিক পর্ব শেষ হয়নি বলে। এর মধ্যেই নববধূ এক দুপুরে ঢাকার মগবাজারের সেই মেসে স্বামীর সহকর্মীদের নেমন্তন্ন করলেন (হয়তো আমাদের চাপে পড়েই)। বাড়ি থেকে টিফিন ক্যারিয়ারে করে আনলেন খাবার রান্না করে। শুধুই ভর্তা। ভর্তার ওপর ভর্তা, ভর্তা দেখা যায়। কত যে ভর্তা! আহা, কী সুস্বাদু! আলু থেকে ডাল, কচু থেকে বেগুন, কালিজিরা থেকে শুঁটকি, টমেটো থেকে বরবটি...। অগণিত। সঙ্গে ছিল মেসের চুলায় রান্না করা গরম ভাত আর ডিমভাজি।

হাতে ৈতরি ঘর সাজানোর নানা কিছু
হাতে ৈতরি ঘর সাজানোর নানা কিছু

আজ সত্য কথাটা অকপটে বলি। ওদের বিয়ের আয়োজনেও গিয়েছিলাম পরে। নিশ্চয়ই পোলাও–রেজালা খেয়েছিলাম। নাকি কাচ্চি? মনে নেই। কিন্তু স্মৃতিতে জ্বলজ্বল সেই ভর্তা–দুপুর। জীবনের কয়েকটি তৃপ্তিকর খাবারের মধ্যে সেটি একটি। ধন্যবাদ ডলি (ঘটনাটা যে কাল্পনিক নয়, তা বোঝাতে হবে না?)।

আজ হোক না সেই ভর্তা–দুপুর! যা বাড়িতে আছে, তা–ই দিয়ে!

‘মা জুস আছে ঘরে?’ সময়ে–অসময়ে সন্তানের এই আবদার হতেই থাকে। আজ নাহয় তেঁতুলের শরবত আর লেবু–পুদিনার শরবতই হোক।

ছেলেমেয়েদের স্কুলের বৈশাখবরণ অনুষ্ঠানের জন্য গেল বছরের কেনা কাপড়গুলো খুব কি ছোট হয়ে গেছে? বাড়িতেই তো পরবে। আর ওই যে শখ করে কেনা মাটির থালাগুলো, ওদের তো আর রোজ ব্যবহার করা হয় না, আজ নাহয় তাতেই পড়ুক পাত।

বৈশাখী খাবার পরিবেশনে মাটির পাত্র
বৈশাখী খাবার পরিবেশনে মাটির পাত্র

কাগজ কেটে চড়কি কিংবা হাতি–ঘোড়া বানানোর নানান কৌশল এই নকশাতেই ছাপা হয়েছে বহুবার। মনে আছে? তাহলে ছেলেমেয়েদের নিয়ে নাহয় তা–ই বানিয়ে ঘর সাজিয়ে ফেলুন। পরিবারের সবাই মিলে লুডো খেলুন জমিয়ে।

একটা নতুন বছর এলে মনে যে আনন্দ–আশা জাগে, সেই বাস্তব পরিস্থিতি এবার নেই। সারা পৃথিবীর মানুষ আজ অসহায়–বিপন্ন। আমাদের মতো দেশে এ যে গোদের ওপর বিষফোড়া । তাই বলে কি মরার আগেই মরে যাব? বিশ্বকবির কথাই বলি—‘বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’

কাগজ কেটে সাজানো যায় ঘরের দেয়াল
কাগজ কেটে সাজানো যায় ঘরের দেয়াল

এই সাহস যেন পাই বৈশাখ থেকে। নিজে সাহস সঞ্চয় করতে পারলে তবেই না অন্যকে সাহস দেওয়া যায়, সহযোগিতা করা যায়। এবার বৈশাখে নাই–বা হলো বর্ণিল আনন্দ উৎসব। যদি পারি, পরিচিত–অপরিচিত অসহায় মানুষকে একটু সহযোগিতা করতে, হয়তো তাতেই শা‌ন্তি পাবে মন।

আপনার রান্না করা খাবারে যদি সামাজিক দূরত্ব মেনেও পেট ভরে কজন অভুক্তের, মুঠোফোনে পাঠানো কটা টাকায় প্রয়োজনীয় ওষুধ কেনা যায়, তবে এর েচয়ে বড় আনন্দ কি হয়?

ভালো কথা, পরিবারের প্রবীণদের খোঁজ নেওয়া নতুন বছরের চল। আর এই দুঃসহ দুর্যোেগ তাঁরাই সবচেয়ে ঝুঁকিতে। বাঙালি সংস্কৃতি মেনে আজ নাহয় তাঁদের খোঁজটাই আগে রাখি। স্পর্শ না করেও তো হাতে হাত রাখা যায়!