ঘরবন্দী সম্পর্কের রসায়ন

করোনার সংক্রমণ শেষে উহান অবমুক্ত করে দেওয়ার পর অনেক দম্পতি প্রথমেই যে কাজটা করেছেন, তা হলো তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন। অনেক সন্তানই মা–বাবার সঙ্গে ভবিষ্যতে যোগাযোগ না করার পণ করে বাড়ি ছেড়েছে। আমরা যাঁরা দেশে এখনো ঘরবন্দী, তাঁরাও ভুগছি সম্পর্কের নানা জটিল টানাপোড়েনে। লকডাউন উঠে যাওয়ার পর আমাদেরও এখানে কী হবে, সেটা হলফ করে বলা যাচ্ছে না। আমাদের সন্তানেরাও যে পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাড়ি ছাড়বে না, সেটাই–বা বলি কীভাবে!

করোনা মহামারির কারণে ঘরবন্দী আমাদের সঙ্গী এখন ঘরের মানুষ আর জানালা দিয়ে দেখা আর একটি বিচ্ছিন্ন একলা বাড়ি। ফলে সম্পর্কের রাসায়নিক মিথস্ক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এই কঠিন সময়ে প্রিয়তম মানুষগুলোর সঙ্গে গড়ে ওঠা দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে, এ আশঙ্কা এখন অনেকেরই। এগুলো যে খুব সচেতন কোনো সিদ্ধান্ত বা পারস্পরিক ঝগড়াবিবাদ, কলহের জেরে হচ্ছে, তা নয়, বরং এক দিন করে বাড়তে থাকা বাজে দিন কাটানোর ফলে মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক আর ভবিষ্যতের জন্য হতাশা তৈরি হয়েছে, সেটাও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী।

মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন ঘরবন্দী একাকী দিনগুলোতে অনেকেরই সবচেয়ে খারাপ ও বাজে দিকগুলো বেরিয়ে আসছে এখন। এ বিষয়ে কোনো পূর্বপ্রস্তুতি না থাকায় বিষয়টা অনেকের জন্য বোমা বিস্ফোরণের মতোই আকস্মিক। লকডাউনের সপ্তাহগুলোর পাশাপাশি অন্যদের সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ বাজে আচরণ করাও দীর্ঘতর হচ্ছে। শুধু যে বন্দীঘরে একসঙ্গে থাকা মানুষদের সঙ্গেই আমরা বাজে আচরণ করছি, তা নয়; যেসব প্রতিবেশী, সহকর্মী ও পরিচিতদের সঙ্গে আমাদের ফোন, ই–মেইল কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমে যোগাযোগ হয়, তাঁদের সঙ্গেও এমন আচরণ করে ফেলছি। এই ভয়াবহ সময়ে কী করে অন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে চলা যায়?

বাস্তবতাটা বুঝুন
সাধারণত আমাদের আবেগীয় বিষয়গুলো দ্রুতই ঠিক হয়ে যায়, তারপর আমরা আবার অন্য দিনের মতোই খাই, ঘুমাই, কাজকর্ম করি। কিন্তু এবারের এই ঘরবন্দী অবস্থার বাজে মানসিক অবস্থা থেকে এত সহজে মুক্তি মিলবে বলে মনে হয় না। তাই আমাদের একসঙ্গে দুটি কাজ করার একটা উপায় খুঁজতে হবে—প্রথমত, এই মহামারি যেভাবে আমাদের মনস্তত্ত্বকে চেপে ধরেছে, সেটা সত্যিকার অর্থেই অনুভব ও স্বীকার করে নেওয়া এবং দ্বিতীয়ত, মানসিক সংকটে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে একটু বেশি আন্তরিক হওয়া।

স্বাভাবিক জিনিসগুলোর প্রতি আর একটু মনোযোগী হোন, নতুন করে আবিষ্কার করুন

এই নতুন শুরুর একটা জায়গা হতে পারে, যা কিছুকে আমরা স্বাভাবিক মনে করি, সেই জিনিসগুলোর প্রতি আরেকটু মনোযোগী হওয়া। নতুন করে পরিচিত জিনিসগুলোকে আবিষ্কার করা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে পারে। বাড়িটির দিকে তাকান। কিংবা বইয়ের তাকগুলোর দিকে। অথবা বারান্দাটার দিকে ফিরে তাকান নতুন করে। কিংবা পুরোনো রাস্তাটার দিকেও তাকাতে পারেন, যেটা দিয়ে আপনি এতবার হেঁটে গেছেন যে ফিরে তাকানোর কথা কখনোই ভাবেননি। এবার ফিরে তাকান এবং নতুনভাবে আবিষ্কার করুন।

আর ফিরে তাকান ঘরে থাকা মানুষদের প্রতি। প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততার কারণে যে মানুষগুলোর দিকে তাকানোর সময় হয়নি খুব একটা, সেই ঘরের মানুষদের দিকে আর একটু মনোযোগী হোন। কারণ, সবাই একই রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা।

সম্মান দিন, কাউকে তুচ্ছ করবেন না
এ সময় কাউকে তুচ্ছ করে কোনো কিছু বলা বা করা উচিত নয়। কারও ওপর রাগ, হতাশা, দুঃখ, ক্ষোভ জন্মাতেই পারে। কিন্তু কাউকে কোনোমতেই তুচ্ছ করা যাবে না। কেউ নিজের বাড়ি থেকে এই দোষারোপ করার অভ্যাস দূর করলেন মানেই হলো তিনি পরিবারে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। যখন অন্য কেউ আপনার সঙ্গে আপনার অপছন্দের ব্যবহার করছে, সেটা কঠিনভাবে তাকে জানিয়ে দেওয়ার চাইতে আপনি বরং তার সে কথায় অবাক হয়েছেন, এমন ভাব করতে পারেন। আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক থেকে আমরা যা আশা করি, সেগুলো আমরা খুব ইতিবাচক উপায়ে প্রকাশ করতে পারি আশ্চর্য হওয়ার মাধ্যমে। আর বাস্তবেই ‘এটা হওয়া উচিত নয়’ বলবার চেয়ে ‘এটা স্বাভাবিক নয়’ অথবা ‘বিষয়টা নিয়ে আর একবার ভাবি/ভাবুন’ বলাটা অনেক কাজে দেয়।

মানুষের পারস্পরিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতার বিষয়ে মনোযোগী হোন
সংকটমুহূর্ত সম্পর্কে অন্যদের প্রতিক্রিয়া আমরা সত্যিই ভালোভাবে বুঝি না। অন্য লোকজন যদি আমাদের প্রত্যাশামতো প্রতিক্রিয়া না দেখায়, আমরা মনে করি, হয়তো তাঁরা আমাদের ভাবনাটা উপেক্ষা করছেন। কিন্তু একেকজন মানুষ যে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে কোনো কিছুর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, সে বিষয়টার অনেক শক্তিশালী দিক আছে।

হয়তো আপনার বাসার ফ্রিজে অতিরিক্ত খাদ্য মজুত করা আছে। কিন্তু নিম্ন আয়ের মানুষের কথা ভেবে আপনি সেটা মানতে পারছেন না। কিংবা হয়তো আপনার সঙ্গী এই সময়েও প্রাত্যহিক জীবনে আগের মতোই রুটিন মেনে চলছেন, যা নিয়ে আপনি খুব বিরক্ত। কিন্তু আপনি যদি একটু অন্যভাবে ভাবেন যে এমন সংকটের সময়েও আপনার পরিবারের দায়িত্বশীল মানুষটি আপনাদের খাবার জোগানোর বিষয়ে চিন্তিত। সে কারণেই বাসায় অতিরিক্ত খাদ্য মজুত করেছেন। কিংবা এমন স্থবির দিনেও আপনার সঙ্গী শুধু আপনাদের সবাইকে চলমান রাখার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছেন, তাহলে সেই মানুষগুলো একাকী বোধ করবেন না। মহামারির এই সময়টা আসলে আমরা যা পারি না, কিন্তু সেগুলো যাঁরা পারেন, তাঁদের সঙ্গে একত্রে মিলে কাজ করার সময়।

কথা বলুন
আর কথা বলুন। আমাদের কথা বলতে হবে। কথা বললে অনেক কিছু দূরে ঠেলে দেওয়া সম্ভব, অনেক ভুল বোঝাবুঝির অবসান করা সম্ভব। যাঁদের কোনো বিষয়ে সাহায্য প্রয়োজন, তাঁরা যদি সে বিষয়ে সরাসরি কথা বলতে না পারেন, তাহলে হয় তাঁরা অন্যদের সঙ্গে এটা নিয়ে অসত্য বলবেন অথবা তাঁকে কেউ বুঝবে না বলে সত্যটা নিজের কাছেই রেখে দেবেন। এখন তাই সত্যি সত্যি অন্যের কথা জানতে চান এবং সত্যি কথাটাই তাঁদের বলুন। একজন আরেকজনের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলুন যেন সেটা আসলেই কাজে দেয়।

এই ঘরবন্দী দিনে আমরা যে কেউই অদ্ভুত আচরণ করতে পারি, যেগুলো হয়তো আমাদের পছন্দ নয়। কিন্তু এই সময়ে কেবল একে অপরকে পছন্দ করার কথা ভাবলে হবে না, এই সময়ের বৃহত্তর লক্ষ্য হলো পরস্পরকে ভালোবাসা, যা আরও বেশি কঠিন এবং এ কঠিন কাজটি সবাইকে মিলেই করতে হবে।

‘গার্ডিয়ান’ অবলম্বনে।