আপনার নিজের জগৎ খুঁজে নিন

কলম্বিয়ার এক জাদুঘরে শতাব্দীপ্রাচীন শিকারিপোশাকে তারেক অণু, ডিসেম্বর ২০১৯। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
কলম্বিয়ার এক জাদুঘরে শতাব্দীপ্রাচীন শিকারিপোশাকে তারেক অণু, ডিসেম্বর ২০১৯। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
>

যাঁদের নেশাই ঘুরে বেড়ানো, পাহাড়ে-সাগরে-বনে রোমাঞ্চের পেছনে উদ্দাম ছুটে বেড়ানো সেই অভিযাত্রী ও পর্যটকেরা এখন ঘরবন্দী। অনেকে বাতিল করেছেন পাহাড়ে, ট্রেইলে, গিরিখাতে তাঁদের আসন্ন ভ্রমণ, করোনার জন্য পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁদের ভ্রমণসূচি। করোনাকালে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে কী বলছেন তাঁরা শুনে নেওয়া যাক।

দেশ-বিদেশের বন্ধুরা বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে খবর নেওয়ার জন্য বার্তা পাঠান, ‘তা দাদা, আপনার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে এই করোনাকালের লকডাউনে বাসায় বন্দী থাকতে। আপনি তো ঘরে থাকেন না আদৌ! কী করছেন এই সময়ে?’

আজ্ঞে না, আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছে না।

দেখুন, হ্যাঁ, আমাদের বেশ কটা ভ্রমণপরিকল্পনা মাঠে মারা গেছে, বিশেষ করে এপ্রিলের শেষে হিমালয়ে যে পর্বতারোহণ অভিযানে যাওয়ার কথা ছিল, সেটিও বাতিল। এটা কষ্টের। কিন্তু আমাদের চেয়ে বহুগুণ কষ্টে আছে কোটি মানুষ, যাদের পরিবারের কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, কিংবা অসুস্থ। যাদের প্রতিনিয়ত এই দুঃসহ অবস্থাতেও সংক্রমণের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে যেতেই হচ্ছে কাজের জন্য; আর দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা বিশাল জনগোষ্ঠী, যাদের এক দিন পরিশ্রম না করলে খাবার জোটে না। ধরে নিচ্ছি, আপনি যেহেতু এই লেখা পড়ছেন, তাই তাদের অনেকের চেয়ে আপনি এবং আমি কিছুটা ভালোভাবে বেঁচে আছি, আমাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে না, যদি আমরা লকডাউনের নিয়ম মেনে চলি।

কিন্তু বন্দী থাকতে তো কারওই ভালো লাগে না! কী করতে পারেন এই ঘরবন্দী সময়ে? বিশ্বজুড়ে শত শত কোটি মানুষের জীবন এখন স্থবির, যে ২ দিনের ছুটি ছিল পরম আরাধ্য, এই ছুটি এখন বিষবৎ হয়ে গেছে অধিকাংশের কাছেই। মানুষ খুঁজছে বিনোদনের উপায়, বা সত্যি বলতে নিছক সময় কাটানোর উপায়। কী করবেন এই অস্থির সময়ে সুস্থির থাকতে?

অনেকের মধ্যেই শখের চর্চা ফিরে এসেছে বিপুল বিক্রমে, মানুষ এত দিনে ফুরসত পেয়েছে মাথার কাছে জমানো বইগুলো একে একে পড়ে ফেলার, হার্ডডিস্কে জমিয়া রাখা সিনেমা আর তথ্যচিত্রগুলো দেখে ফেলার, গান শোনার ও শোনানোর (মানে গেয়ে নেটে আপলোড করার)। অনেকেই লিখছেন পুরোনো সব স্মৃতি, বিশেষ করে জমে থাকা ছবি দেখে দেখে পুরোনো ভ্রমণ নিয়ে। আর বিপুল পরিমাণ সময় ব্যয় করছে ইন্টারনেটে সার্ফ করে, খবর দেখে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে।

এই অবরুদ্ধ সময়ে সুস্থ থাকাটা সবচেয়ে জরুরি। আপনি সুস্থ থাকলে তবেই না এই সময়ে এবং এই করোনাকাল কাটলে অপরের উপকারে আসতে পারবেন। তাই শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা বজায় রাখা আপনার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব এখন, আপনি নিজেই আপনার ডাক্তার, আপনার ট্রেনার, আপনার উৎসাহদাতা।

পেরুর মাচুপিচু ভ্রমণ, ২০১৩। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
পেরুর মাচুপিচু ভ্রমণ, ২০১৩। ছবি: ফেসবুক থেকে সংগৃহীত

আপনি নিজে কী করছেন মানসিক স্থিরতা বজায় রাখতে? আপনার কি নিজস্ব একটি জগৎ আছে, যেখানে চাইলেই আপনি ডুব মেরে থাকতে পারছেন? একান্ত নিজের জগৎ, একাকিত্বের নয় কিন্তু! যেখানে আপনি সুখী, যেখানে দিন, সপ্তাহ, মাস পেরিয়ে গেলেও আপনি সুখীই থাকেন, একা এবং আশপাশের সবাইকে নিয়েই।

করোনাকাল আপনার সামনে এই অখণ্ড অবসরের সুযোগ এনে চিন্তা করার অবকাশ দিচ্ছে যে এত দিন যেভাবে আমরা জীবন চালিয়েছি, যেভাবে চলেছি, তার কী কী ঠিক ছিল না, কিসের কিসের অভাব আছে আমাদের জীবনে ও মননে? একটু তলিয়ে চিন্তা করলেই তা পাবেন হয়তো। হয়তো খুঁজে নিতে পারবেন একান্ত আপনার পৃথিবী কোনটা, যেখানে আপনি শান্তি পান, যেখানে আপনি স্বস্তি পান।

সেই একইভাবে গৎবাঁধা বই পড়তে হবে, সিনেমা দেখতে হবে, লিখতে হবে, চ্যাট করতে হবে, ইউটিউব দেখতে হবে, ফেসবুকে লড়তে হবে—এটা আপনার জন্যও প্রযোজ্য নাও হতে পারে। চেষ্টা করবেন নাকি আপনার নিজস্ব একান্ত জগৎ এই ফাঁকে চিহ্নিত করতে? তাতে লোকসান নেই কারও, কিন্তু তার খোঁজ পেলে শতভাগ লাভ আপনার! আর সেটার সন্ধানে থাকা অবস্থায় অন্তত নিজের পুরোনো শখগুলোর চর্চা জারি রাখুন, হোক সে সেলাই করা বা বারান্দায় বাগান করা, কবিতা আবৃত্তি বা অরিগ্যামি। সময় যেহেতু পেয়েছেন, এত দিন সময়ের অভাবে আশপাশে মানুষদের সঙ্গে যে সম্পর্কগুলোয় মরচে পড়ে যাচ্ছিল, এখন কি সময় নয় সেগুলোকে নতুন রূপ দেওয়ার?

দিনের শেষে ভালো থাকার চেষ্টা করুন, নিরাপদে থাকুন।

লেখক: ভূপর্যটক।